বহু প্রতিক্ষিত ও গুরুত্বপূর্ণ ‘সুন্দরবন পর্যটন নীতিমালা’ অবশেষে প্রণয়ন হতে চলেছে। গত ২৫ জুন বন ও পরিবেশ মন্ত্রনালয়ে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রনালয় সভায় সুন্দরবন ভ্রমণের খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত হয়েছে যা এখন মন্ত্রী পরিষদে বিল আকারে উত্থাপন ও আইন হিসাবে পাশের অপেক্ষায় বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। তবে এই নীতিমালাই যেন দুর্নীতির হাতিয়ার বা সংশ্লিষ্টদের গলার কাটা হয়ে না ওঠে তা নিশ্চিৎ করার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ।
মনুষ্য সৃষ্ট দুষনের কারণে বিশ্বের জলবায়ুর পরিবর্তনে দেখাদিয়েছে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব, যার ফল হিসাবে সৃষ্টি হচ্ছে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আর এর শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ তথা সুন্দরবন। ঘূর্ণীঝড় সিডর এবং আইলায় সুন্দরবনের যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে তা কখনই পুরন হওয়া সম্ভব নয়। অবার সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্য ও একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন হওয়ায় মানুষের সুন্দরবন ভ্রমণ সম্পূর্ণ বন্ধ করাও যুক্তিসংগত নয়। এ অবস্থায় সুন্দরবনের সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত জরুরী একটি কার্যকর নীতিমালা যা জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব থেকে সুন্দরবন কে রক্ষাকরতে সক্ষম হবে।
উল্লেখ্য, ১৮৭৮ খৃষ্টাব্দে সমগ্র সুন্দরবন কে সংরক্ষিত বন হিসাবে ঘোষণা করা হয় এবং ১৮৭৯ খৃষ্টাব্দে সুন্দরবনের দায়িত্ব গ্রহণ করে বন বিভাগ। এর পর ১৩৫ বছর কেটে গেছে কিন্তু সুন্দরবনের জন্য কোন পর্যটন নীতিমালা অজও তৈরী হয় নি ! যদিও নীতিমালার অভাবে থেমে থাকছে না পর্যটন। প্রতিবছর হাজার হাজার দেশী-বিদেশী পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করছে, সরকারের রাজস্বও আয় হচ্ছে। তবে পর্যটন আইন না থাকায় ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুন্দরবন, আর নীতিমালার দোহাই দিয়ে দুর্নীতিও বাসা বেধেছে দেশের আমলা নির্ভর অন্য সকল খাতের মত এ খাতেও।
উল্লিখিত খসড়া খসড়ায় সুন্দরবন পর্যটন নীতিমালার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, সুন্দরবন ব্যবস্থাপনার মূল উদ্দেশ্য হ’ল জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণের কোনরূপ ব্যত্যয় না ঘটিয়ে সীমিত পর্যায়ে সুন্দরবনে পর্যটন ও অবস্থান অনুমোদন করা। পর্যটনের কারণে যাতে কোন ভাবেই জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হতে না পারে অর্থাৎ বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ, নিরাপত্তা ও স্বাবাবিক আচরণ যাতে ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিৎ করা। সুন্দরবন সংরক্ষণের স্বার্থে যে কোন সময় সাময়িকভাবে পর্যটন স্থগিত বা নিয়ন্ত্রণ করা ইত্যাদি। এর পাশাপাশি নীতিমালায় ‘সুন্দরবন ভ্রমনে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তার জন্য বন বিভাগ দায়ী থাকবে না’ বলেও ঘোষণা করা হয়েছে যা আসলে আমলাদের গা- বাঁচিয়ে চলার ফিকির বলে অভিযোগ করেছেন সংশিস্নষ্ট বিভিন্ন পক্ষ।
পর্যটন নীতিমালায় সংশিস্নষ্ট তিন পক্ষতথা বন বিভাগ, পর্যটন ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের দায়-দায়ীত্ব ও করণীয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারা সংযোজিত হয়েছে।
পর্যটকদের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, দেশী-বিদেশী সকল পর্যটক কে সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য বন বিভাগ কর্তৃক সরবরাহকৃত ফর্মে বিভাগীয় বন অফিসারের নিকট আবেদন করতে হবে। সুন্দরবনে প্রবেশের প্রাক্কালে নির্দিষ্ট বন ষ্টেশনে লঞ্চ বা জলযান সহ উপস্থিত হয়ে রাজস্ব পরিশোধ করেতে হবে। সুন্দরবন ভ্রমণকালে মাইক বা মাইক্রোফোন জাতীয় কোন উচ্চগ্রামের শব্দযন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না এবং যত্রতত্র ময়লা ফেলা যাবে না। বনাভ্যন্তরে কোন আগ্নেয়াস্ত্র, ধারালো হাতিয়ার, বিষ, ফাঁদ ইত্যাদি বহন করা যাবে না এবং কোন প্রকার বন্যপ্রাণী বা মৎস্য শিকার করা যাবে না। অভয়ারণ্য এলাকায় ভ্রমণের জন্য নির্ধারিত পৃথক এন্ট্রি ফি প্রদান করতে হবে ইত্যাদি।
পর্যটন ব্যবসায়ী বা ট্যুর অপারেটরদের দায়ীত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর কর্তৃক ফিটনেস সার্টিফিকেট ব্যতিত কোন জাহাজ পর্যটনের কাজে ব্যবহার করা যাবে না। পর্যটকবাহী জাহাজে বর্জ্য রাখার ব্যবস্থা রাখা। বনে প্রবেশের পর জলে-স্থলে কোথাও বর্জ্য না ফেলা। যে আকৃতির জাহাজই হোক না কেন কোন জাহাজেই সর্বোচ্চ ৭৫ জন’র অধিক পর্যটক বহন করা যাবে না। পর্যটকবাহী লঞ্চ চলাচরের জন্য নির্ধারিত রম্নট ব্যবহার করা। সুন্দরবন ভ্রমণে অনুসরণীয় বিষয় সম্পর্কে পর্যটকদের অবহিত করা ইত্যাদি।
অন্যদিকে বন বিভাগের দায়ীত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, সুন্দরবনে ভ্রমণের জন্য প্রাপ্ত আবেদনের বিষয়ে তিন দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। সরকারী ছুটি বা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সকাল নয় টা থেকে বিকাল পাঁচ টা পর্যন্ত আবেদন পত্র গ্রহণ ও অনুমতি পত্র প্রদানের ব্যবস্থা করা। সুন্দরবন ভ্রমনে আদায়যোগ্য সকল প্রকার কর’র একটি তালিকা বিভাগীয় বন দপ্তর এবং পর্যটকদের প্রবেশ পথের ষ্টেশনে প্রদর্শন করা। নীতিমালা পরিপন্থি কোন কার্যক্রম প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পর্যটকদের সাথে শোভন আচরণ নিশ্চিৎ করা ইত্যাদি।
এ সকল বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে একাধিক পর্যটন ব্যবসায়ী বলেন, পর্যটন নীতিমালা অত্যন্ত জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তবে এর অপপ্রোয়গের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, নীতিমালা তৈরী না হলেও একটি মৌখিক নীতিমালা কার্যকর আছে, যাতে উল্লেখ আছে যে, কোন জাহাজে সর্বোচ্চ ৭০ জন পর্যটকের বেশী বহণ করা যাবে না, কিন্তু একে পুঁজি করেই বন বিভাগের কিছু অসাধু অফিসার দুর্নীতির মৌরসিপাট্টা খুলে বসেছেন। তাদের অভিযোগ, কিছু নির্দিষ্ট জাহাজে ১৫০ জন থেকে ৩০০ জনের অধিক পর্যটক বহন করা হয়েছে এবং এ সকল জাহাজের পর্যটকদের ৭০ জনের প্রদেয় রাজস্ব বন দপ্তরে জমা হয়েছে ও বাকি টাকা সংশ্লিষ্ট বন বিভাগের কর্মীরা আত্মসাৎ করেছে এবং যা চলছে বছরের পর বছর।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগের ভিত্তিতে খুলনা তালিমপুর ফরেষ্ট রেঞ্জারের অফিসে গত সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত যে সকল পর্যটকবাহী জাহাজ রাজস্ব প্রদান করেছে তার একটি তালিকা চাওয়া হয়। আবেদনের ভিত্তিতে বন বিভাগ ২২ টি জাহাজের নামের একটি তালিকা সরবরাহ করে। এ সকল জাহাজের মধ্যে ৮টি জাহাজের (এগুলি সবই ভাড়া করা যাত্রিবাহী লঞ্চ) বিরুদ্ধেঅতিরিক্ত পর্যটক বহনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তালিমপুর ফরেষ্ট অফিসের রেঞ্জার মোঃ আব্দুল কুদ্দুস বলেন, তিনি ৭০ জনেরই রাজস্ব নিয়েছেন, তা ছাড়া কিছু চাপ তো সব সময় থাকেই, তবে মাঝ পথে যদি কেউ জাহাজে চড়ে তা হলে তাদের করার কি আছে ? এ বিষয়ে বিভাগীয় বন অফিসার বলেন, এ ধরনের অভিযোগ স্পটে উত্থাপন করা না হলে কিছুই করা সম্ভব নয়!
পর্যটন নীতিমালা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিভাগীয় বন অফিসার জহিরউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, পর্যটন নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। খুব দ্রুতই পর্যটন নীতিমালা আইনে পরিণত হবে। পর্যটন নীতিমালার সঠিক প্রয়োগ কি ভাবে সম্ভব হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সকল পক্ষকে নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ব্যাপক প্রচারাভিযান চালানো হবে যাতে সাধারণের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে কোন পক্ষনীতিমালার অপপ্রয়োগ করতে সক্ষম না হয়।
by
সর্বশেষ মন্তব্যসমূহ