সকল শিল্প সংস্থাকে আইন দ্বারা বাধ্য করতে হবে সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনে

সামাজিক সমস্যাকেও সঠিক প্রচেষ্টা ও প্রযত্নের মাধ্যমে যে সম্পদে পরিণত করা সম্ভব তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা(সিএসআর) প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় শত শত পরিবারের সদস্যগণ বিভিন্ন পেশার দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে উঠছে এবং আর্থিক ভাবে সাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।তাদের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে সমবায় সমিতি।

সমস্যার শুরু যে ভাবে : খুলনা মহানগরীর সাত নম্বর ওয়ার্ডের কাশিপুর এলাকায় খুলনা পাওয়ার কোম্পানী লিঃ (কেপিসিএল)’র উদ্যোগে ১৯৯৮ সালে গড়ে ওঠে ভাসমান বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ২০১১ সালে ১১৫ মেঃওঃ’র কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি গড়ে ওঠার পর এর শব্দ ও কম্পনে সাত নম্বর ওয়ার্ড সহ এর আশপাশের এলাকার প্রায় ৪৩০০টি পরিবার বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত হয় যা এক সামাজিক সমস্যায় রূপ নেয়। পরবর্তীতে বেসরকারী সংস্থা পরিবর্তন’র উদ্যোগে এলাকাবাসী ও কেপিসিএল কর্তৃপক্ষ যৌথ সিদ্ধান্তে উপনিত হয় ‘সিএসআর’ বা কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা মূলক প্রকল্প গ্রহণে, যা মূলত ক্ষতিগ্রস্তদের এক ধরনের ক্ষতিপূরণ প্রদান মূলক ব্যবস্থা। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বেসরকারী সংস্থা ‘পরিবতর্ন।’

সিএসআর প্রকল্প : এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়েতোলা। এ লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত হয় সুবিধা বঞ্চিত মহিলাদের দর্জি প্রশিক্ষণ ও ছেলে-মেয়েদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পেশাদার কর্মী হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এ উদ্দেশ্যে প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ফেব্রুয়ারী ২০১৩ থেকে। প্রতি ব্যাচে ৬০ জন মহিলাকে দর্জি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে ২৬০ জনের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। যাদের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয়েছে তাদের কয়েকজন হলেন, সাবিনা বেগম,ফারহানা আক্তার,নাজমা,শামিমা নাছরিন,রুনায়লা। তাদের প্রশিক্ষণ পেশাদারী মান সম্মত হয়েছে কি-না জানতে চাইলে তারা বলেন,” আমরা কেউই আগে দর্জির কাজ জানতাম না কিন্তু এখন আমরা জামা-কাপড় বানানো শিখেছি,আমরা ভালোই বানাতে পারি। আমরা যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছি তারা প্রত্যেকেই এবার ঈঁদে অর্ডার পেয়েছি এবং আমাদের কাজ করতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না,আমরা প্রত্যেকেই এবার ঈঁদে কিছু রোজগার করতে পারছি যা আগে আমরা কখনও চিন্তাও করিনাই।” এ সময় তাদের কয়েক জনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় তারা প্রাপ্ত অর্ডারের পোশাকগুলি তৈরী করছেন।

পরবর্তীতে প্রতি ব্যাচের প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে সেরা ১০ জনকে বেছে নিয়ে তাদের দেওয়া হয়েছে উচ্চতর পেশাদার বাজারভিত্তিক ফ্যাশন ডিজাইন অর্থাৎ ব্লক,বাটিক,ষ্টিচিং ইত্যাদি প্রশিক্ষণ। বাজারভিত্তিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২০ জন মহিলা একটি সমবায় সমিতি ও একটি বুটিক কারখানা গড়েতুলেছেন যার নাম ‘স্বপ্নীল’ সমবায় সমিতি। ইতোমধ্যে স্বপ্নিল ১৩২৭ সেট স্কুল ইউনিফর্ম, ৩১০টি বয়লার সুট ও ৩০০টি অফিসিয়াল সার্ট তৈরী করে সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছে। স্বপ্নিল গত ৬ মাসে তাদের কাজের মাধ্যমে আয় করেছে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা।

প্রকল্পের আর একটি কার্যক্রম কম্পিউটার প্রশিক্ষণ। প্রতি ব্যাচে ১০ জন করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ১৮০ জন ছেলে-মেয়ে তাদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছে। প্রশিক্ষণের বিষয় ছিলো মাইক্রোসফ্‌ট্‌ অফিস, এ্যাডোবি ইলাষ্ট্রেটর, এ্যাডোবি ফটোশপ, ইন্টারনেট ব্রাউজিং। যারা ইতিমধ্যে এ প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছে তাদের কয়েকজন হলো লাবনী আক্তার, মনিরুল ইসলাম, নাদিমুজ্জামান, মিতু আক্তার,ফারজানা। প্রশিক্ষণ সম্পর্কে তারা জানান,”আমরা ভাল ভাবেই আমাদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছি এবং ইতিমধ্যেই আমরা অনেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ পেয়েছি যা আমাদের সাবলম্বী হতে সহয়তা করবে।”

প্রকল্পের কম্পিউটার ইন্সট্রাক্টর সৌমিত্র বিশ্বাস জানান, প্রতি ব্যাচের সেরা ছাত্রদের মধ্য থেকে ৪০ জন কে দেওয়া হয়েছে তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক পেশাদার প্রশিক্ষণ। এর ফলে তারা ওয়েবপেজ ডিজাইনিং, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডাটাএন্ট্রি সহ ওয়ার্ডপ্রেস’র বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে সক্ষম হবে এবং বিভিন্ন ধরনের ওয়েবসাইট তৈরী ও ওডেক্স’র বিভিন্ন ধরনের কাজ করে তারা আর্থিক ভাবে সাবলম্বী হতে পারবে বলে জানায় মিরাজুল ইসলাম, নাদিমুজ্জামান,লাবনী আক্তার সহ স্পেশাল ব্যাচে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীগণ।

এ প্রকল্পের অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্যে আছে স্বাস্থ্যসেবা,শিক্ষা সম্প্রসারণ,বৃক্ষরোপণ সহ বিভিন্ন কর্মকান্ড। এলাকার সুবিধা বঞ্চিত মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিৎ করতে প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে (২০১৪ সালের জুলাই) ৯৭০টি পরিবার কে স্বাস্থ্যসেবা কার্ড প্রদান কার হয়েছে, যার সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৪৪১১জন। এ পর্যন্ত ২৭০১জন রুগী কার্ড ব্যবহার করে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। এ ছাড়াও ৯৩০ জন বয়ঃসন্ধিকালীন রুগী স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছে, ৫টি স্বাস্থ্যসেবা ক্যাম্পের মাধ্যমে ৪৩৯ জনের চক্ষু পরীক্ষা ও ২১ জনের চক্ষু অপারেশন, ৩৩৭ জনের নাক-কান-গলার সমস্যা ও ১০৪ জনের হৃদরোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে এবং ২০৩৯ জনের রক্তের গ্রুপ নির্ণয় সম্ভব হয়েছে।

প্রকল্প এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠির শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষে ১০০ জন অতি দরিদ্র ছেলে-মেয়ে কে বছরব্যাপি শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হয়। এ ছাড়া ৭১৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৩২৭ সেট স্কুল ইউনিফর্ম ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হয় এবং ৩৩ জন শিক্ষার্থীর এস এস সি ও এইচ এস সি পরীক্ষার ফি এবং ভর্তি ফি প্রদান করা হয়।

প্রকল্প এলাকাটি শিল্প এলাকা হওয়ায় ব্যাপক ভাবে পরিবেশ দুষণের শিকার। এর পরিবেশ উন্নয়নের লক্ষে প্রকল্পের আওতায় পাঁচ শতাধিক বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। এ ছাড়া এলাকার গৃস্থালীর বর্জ্য অপসারণ ও পয়নালী পরিস্কারের নিয়মিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি এলাকার অসহায় প্রবিণদের বিভিন্ন দ্রব্যভিত্তিক সহয়তা প্রদান এবং স্কুল শিক্ষকদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও তাদের জন্য স্কুলে ইন্টারনেট সহ কম্পিউটার সরবরাহ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, একমাত্র কেপিসিএল ছাড়া খুলনা অঞ্চলের আর কোনো শিল্প সংস্থা সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনে এখনও পর্যন্ত এগিয়ে আসে নি।

কেপিসিএল’র ‘সিআরএস প্রকল্পের মাধ্যমে টেকসই সমাজ উন্নয়ন’ বিষয়ক এক কর্মশালা গতকাল খুলনা মাহানগরীর সিএসএস আভা সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়। কর্মশালার ধারণাপত্রে প্রকল্পের কার্যক্রম তুলে ধরেন পরিবর্তন’র নির্বাহী পরিচালক নাজমুল আযম ডেভিড।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি খুলনা সিটি মেয়র মোঃ মনিরম্নজ্জামান মনি বলেন, শিল্প সংস্থা যেমন পরিবেশ দুষণ করছে এবং সমাজ থেকে মুনাফা অর্জন করছে, তেমনি এর পরিবর্তে সমাজ ও পরিবেশের ক্ষতিপূরণেও তারা বাধ্য।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. দিলীপ কুমার দত্ত, খুলনা নাগরীক ফোরাম’র চেয়ারপার্সন শেখ আব্দুল কাইয়ূম, খুলনা পরিবেশ অধি-দপ্তরের পরিচালক ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন, কেপিসিএল’র এ্যাসেট ম্যানেজার মোঃ আতিকুল ইসলাম,ডিডিএলজি হাবিবুল হক খান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এ্যাডঃ আব্দুল্লা হোসেন বাচ্চু।

শিল্প সংস্থার সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্পর্কে জানতে চাইলে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন,সকল শ্রেণীর শিল্প সংস্থারই সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে। বর্তমান বাংলাদেশে দ্রুত শিল্পায়ন হচ্ছে ফলে সামাজিক সমস্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন আরও জরুরী হয়ে পড়েছে। যারা এ দায়বদ্ধতা পালনে আগ্রহী নয় তাদের আইনের মাধ্যমে এ দায়বদ্ধতা পালনে বাধ্য করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *