খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাযথ মর্যাদায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪২তম শাহাদাত বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ১৫ আগস্ট বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়।
সকাল সাড়ে ৮টায় কর্মসূচির শুরুতে শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ প্রশাসনিক ভবনের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করেন এবং জাতীয় শোক দিবস পালন কমিটির সভাপতি প্রফেসর ড. অনির্বাণ মোস্তফা কালো পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর কালোব্যাজ ধারণ করা হয়। এ সময় পণেরই আগস্ট’র শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরে উপাচার্যের নেতৃত্বে একটি শোকর্যালি প্রশাসন ভবন থেকে শুরু হয়ে অদম্য বাংলায় গিয়ে শেষ হয়। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে উপাচার্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন।
এরপর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ, স্থাপত্য ডিসিপ্লিনসহ বিভিন্ন ডিসিপ্লিন, আইইআর, এগ্রোটেকনোলজি এলামনাই, ছাত্রদের সংগঠন চেতনা একাত্তর বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে। উপাচার্য সকাল সাড়ে ৯টায় আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু একাডেমিক ভবনে ২য় তলায় বঙ্গবন্ধুর ওপর আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন এবং আইন ডিসিপ্লন কর্তৃক পনেরই আগস্ট উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা ‘অগ্নিগিরির অস্তাচলে’ এর মোড়ক উন্মোচন করেন।
সকাল ১০ টায় একই ভবনের সাংবাদিক লিয়াকত আলী মিলনায়তনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ওপর এক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় শোক দিবস পালন কমিটির সভাপতির সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান।
অনুষ্ঠানে মূখ্য আলোচক ছিলেন সাংবাদিক আবেদ খান। তিনি বলেন বঙ্গবন্ধুর অজস্র গুণাবলীর মধ্যে তিনি নেতৃত্বের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারকে গুরুত্ব দেননি। তার কাছে দল ছিলো প্রধান, রাজনীতি ছিলো প্রধান, ব্যক্তি নয়। তিনি বলেন আজ ব্যানার পোস্টারে ভয়ঙ্কর এক প্রচারণা শুরু হয়েছে যেখানে বঙ্গবন্ধুর ছবিটি ছোট করে নিজের ছবিটি কয়েকগুণ বড়ো করে দেখানো হচ্ছে। এ ধরনের আত্মপ্রচারণা হতে থাকলে আমরা আত্মবিস্মৃতির দিকে চলে যেতে থাকবো যা খুবই হতাশা ও উদ্বেগের। কারণ, আত্মবিস্মৃতি অস্তিত্ব বিনাশী যা সামগ্রিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। তিনি বলেন বঙ্গবন্ধু সকল সংকীর্ণতার উর্ধে ওঠার আদর্শ দিয়ে গেছেন, সংকীর্ণতার উঠতে না পারলে সে সমাজ অগ্রসর হতে পারে না। তিনি বলেন আমাদের লক্ষ্য যেনো উপলক্ষ্যকে অতিক্রম না করে এ সত্যটি অনুধাবন করতে হবে। তিনি বলেন পনেরই আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করতে হবে। তিনি জ্যপাল সার্তের একটি উক্তি উল্লেখ করে বলেন বঙ্গবন্ধু চিরকাল বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মে, বাংলা, বাঙ্গালি ও বাংলাদেশের হৃদয়ে।
তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর স্মৃতিচারণ করে নতুন নতুন দিকে আলোকপাত করেন। তিনি ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানে সাংবাদিক হিসেবে উপস্থিত থেকে খুব কাছে থেকে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শোনেন এবং সমস্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ সম্পর্কে তিনি বলেন এটি এমন ইতিহাসশ্রেষ্ঠ ভাষণ ছিলো যা বিশ্বনেতৃবৃন্দের অন্যতম ভাষণগুলোর সংকলিত ভাষণের মধ্যে অন্যতমশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে সমাদৃত ও স্বীকৃত হয়েছে। সে দিন লক্ষ লক্ষ জনমানুষের সমাগমে বারুদের মতো উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থার মধ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯ মিনিটের যে ভাষণ দিয়েছিলেন তার প্রতিটি শব্দ, বাক্য, দিকনির্দেশনা ছিলো অতুলনীয় ছন্দময়,আবেগ ও অর্থপূর্ণ। তিনি কৌশলের কারণেই সেদিন সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না করলেও এই ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা, পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, লড়াইসহ সকল দিক সর্ম্পকে নির্দেশনা ছিলো। এই মন্ত্রমুগ্ধ ভাষণ বাঙ্গালির স্বাধীনতার চেতনায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়েছিলো। অপর দিকে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠির ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। তাঁরা বাঙ্গালিকে নিঃশেষ করে দিতে ২৫মার্চ কালোরাত্রি বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো। কিন্ত বঙ্গবন্ধুর ডাকে এদেশের মুক্তিকামী মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে পাকহানাদার বাহিনীকে পরাজয়বরণ করতে বাধ্য করে।
প্রধান অতিথি উপাচার্য বলেন বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে বড় যে কাজটি করতে পেরেছিলেন তা হচ্ছে সুদীর্ঘকাল ধরে অবহেলিত বঞ্চিত শোষিত নির্যাতিত বাঙ্গালির চেতনা জাগ্রত করা, সংগঠিত করা, ঐক্যবদ্ধ করা। তার মতো হৃদয় দিয়ে বাঙ্গালিকে এতোভালো আর কেউ অতীতে বাসতে পারেননি আর ভবিষ্যতেও পারবে না। বঙ্গবন্ধুর সমস্ত চেতনা জুড়ে ছিলো বাঙ্গালি, বাংলা ও বাংলাদেশ। তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের যে সম্মোহনী শক্তি ছিলো, আদর্শের প্রতি অবিচলতা। পচাঁত্তরের পণেরই আগস্ট তাঁকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে, মিথ্যা রটনার মাধ্যমে যে অপশক্তি চেয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে, তাঁর আদর্শকে মুছে ফেলে দেশকে অন্ধকারে নিতে, পিছিয়ে নিতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে হত্যা করা যায়নি, তা কোনোকালে সম্ভব হবে না। বঙ্গবন্ধু আছেন এ দেশের কৃষক, কামার কুমার, শ্রমিক মাঝি মাল্লা সাধারণ মানুষের মাঝে। বঙ্গালির হৃদয়ের মণিকোঠায়। তাই আজ তাঁর শক্ররা, সমালোচকরা এ সত্য উপলদ্ধি করতে পারছে যে, জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে মৃত বঙ্গবন্ধু আরও শক্তিশালী, আরও অনুপ্রেরণার। যতো দিন যাবে তাঁকে নিয়ে যতো চর্চা হবে ততোই তাঁকে মানুষ বেশি স্মরণ করবে। তাঁকে কেউ ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে পারবে না। তিনি বাঙ্গালি, বাংলা ও বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি এ ইতিহাসের স্রষ্টা, মহানায়ক। উপাচার্য নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থসহ বঙ্গবন্ধুর ওপর লেখা বইপুস্তক পড়ার মাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে আরও জানার আহবান জানান।
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার( ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. সরদার শফিকুল ইসলাম, সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. মোসাম্মৎ হোসনে আরা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ড্রইং এন্ড পেইন্টিং ডিসিপ্লিনের শাপলা সিংহ ও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ডিসিপ্লিনের আখন্দ মোঃ খায়রুজ্জামান। সভাপতি সভা সঞ্চালনার মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থ থেকে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন উক্তি তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে ডিন, পরিচালক, রেজিস্ট্রার, ডিসিপ্লিন প্রধান, বিভাগীয় প্রধান, বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীসহ কর্মচারিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
by
সর্বশেষ মন্তব্যসমূহ