খুবিতে জাতীয় শোক দিবস পালিত

আজ ১৫ আগস্ট খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাযথ মর্যাদায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৩তম শাহাদাৎ বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়।

সকাল সাড়ে ৮টায় কর্মসূচির শুরুতে কালোব্যাজ ধারণ করা হয়। পরে শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ প্রশাসনিক ভবনের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করেন এবং ট্রেজারার প্রফেসর সাধন রঞ্জন ঘোষ কালো পতাকা উত্তোলন করেন।  উপাচার্যের নেতৃত্বে একটি শোকর‌্যালি প্রশাসন ভবন থেকে শুরু হয়ে অদম্য বাংলায় গিয়ে শেষ হয়। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে উপাচার্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন।

এরপর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ, বঙ্গবন্ধু পরিষদ খুবি শাখা, অফিসার্স কল্যাণ পরিষদ, কর্মচারীরা, বিভিন্ন ডিসিপ্লিন, ছাত্রদের বিভিন্ন সংগঠন বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে। শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পনের পর উপাচার্য আইন ডিসিপ্লিন কর্তৃক পনেরই আগস্ট উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মরণিকা ‘অগ্নিগিরির অস্তাচলে’ এর মোড়ক উন্মোচন করেন। পরে তিনি আচার্য্য জগদ্বীশচন্দ্র বসু একাডেমিক ভবনে ২য় তলায় বঙ্গবন্ধুর ওপর আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন।

সকাল ১০ টায় একই ভবনের সাংবাদিক লিয়াকত আলী মিলনায়তনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ওপর এক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে পনেরই আগস্টে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। জাতীয় শোক দিবস পালন কমিটির সভাপতি ফরেস্ট্রি এন্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেনের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও কোটাসংস্কার আন্দোলনের মতো যৌক্তিক আন্দোলনের মধ্যেও কিছু কিছু শিক্ষার্থী ১৫ আগস্টের শোক দিবস এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ফেসবুকে যেসমস্ত মন্তব্য করেছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। কেননা অপঘাত বা অপমৃত্যু কারও কাম্য হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী সবসময়ই এসব ঘটনায় নিন্দা জানান এবং স্বজন হারার বেদনা সবচেয়ে বেশি তিনি অনুভব করেন সে কথা বলে থাকেন। তাই ফেসবুকে যারা অপ্রত্যাশিত মন্তব্য করেন সেই নতুন প্রজন্ম হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর অবদান এবং ১৫ আগস্ট সম্পর্কে জানে না, অথবা যারা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলো, এখনো যারা বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধকে মনে প্রাণে মেনে নিতে পারে না সেই সমস্ত পরিবারের সন্তান বলে উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন আমাদের দুর্ভাগ্য এখনো আমরা তরুণ প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের সবার মধ্যে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরে তাদের মনন গঠন করতে পারিনি। তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন দিক ও ঘটনা তুলে ধরে বলেন ১৯৪৭ সাল থেকে ধীরে ধীরে তিনি আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য যে অসীম ত্যাগ স্বীকার করেছেন, জীবন উৎসর্গ করেছেন, যিনি বাঙালিকে তার নিজের জীবনের চেয়েও ভালো বেসেছেন, যিনি এই মাটি ও মানুষকে একান্তভাবে চিনেছিলেন, এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সর্বদা কাজ করেছিলেন, যিনি বিশ্ব নেতা হিসেবে সারা দুনিয়ায় বিরল সম্মান ও শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন তাঁকে সপরিবারে নির্মম, নৃশংসভাবে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট হত্যার পর বিশ্ববাসীর কাছে আমরা খুনি জাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছি। তিনি বলেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো বিতর্ক হতে পারে না। তাঁকে নিয়ে বিতর্ক যতো কম হবে ততই ভালো তা না হলে দেশে কোনোদিন রাজনৈতিক ঐকমত্য বা আপোষ হবে না।

অনুষ্ঠানে মুখ্য আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব, মুক্তিযোদ্ধা ও কলাম লেখক মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি তাঁর দীর্ঘ কূটনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য নিয়ে বিভিন্ন স্মৃতি ও ঘটনা এবং অবসরের পর এই দীর্ঘ ৭৭ বছর বয়সের নানা অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এক ঘন্টারও বেশি সময় বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন পেশাদার কূটনীতিক হিসেবে দুনিয়ার অনেকগুলো দেশে দায়িত্ব পালন করেছি। এসময় অনেক রাজা-বাদশা-প্রেসিডেন্ট প্রাইমমিনিস্টারকে কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বা বহুপাক্ষিক আলোচনায়, কথা-বার্তায়, সৌজন্য প্রকাশে তাদের ঘনিষ্ঠভাবেও দেখেছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো এমন সাহসী, প্রজ্ঞা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, মাটি ও মানুষের প্রতি এমন মমত্ববোধ, দেশপ্রেম আমি কোথাও কারও মধ্যে দেখেনি। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের বন্দীঅবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে রাওয়ালপিন্ডি থেকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি  লন্ডনে পৌঁছান। এই দিন ভোরে লন্ডনের হীথ্রো বিমানবন্দরে যে তিনজন বাঙালি কূটনীতিকের মুক্ত বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানোর সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছিল তার মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন বলে উল্লেখ করে সেদিনের সেই অবিস্মরণীয় মুহূর্তের স্মৃতি এবং বিশ্বের তিনশত সাংবাদিকের উপস্থিতিতে প্রেস কনফারেন্সসহ বিভিন্ন তৎপরতার কথা তুলে ধরেন। সেদিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ যে সম্মান বঙ্গবন্ধুকে দেখিয়েছিলেন তা আর কোথাও তিনি দেখিনি। তাঁর ধারণা আর কেউও কোথাও দেখেননি। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন লন্ডনে ব্রিটিশ সরকার এবং জনগণকে ৭১এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থন জানানোর জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে বঙ্গবন্ধু গিয়েছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রীটে। আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু যখন তাঁর হোটেলে ফিরে আসছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধুকে সাথে নিয়ে প্রথা ভেঙ্গে ডাউনিং স্ট্রীটের বাইরে এসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রোলস রয়েস গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকেন যাতে বঙ্গবন্ধু গাড়িতে উঠতে পারেন। তিনি আরও বলেন লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পর তাঁর সফল পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে খুব অল্পদিনের মধ্যেই পৃথিবীর প্রায় সব দেশই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। সারা বিশ্ব বঙ্গবন্ধুকে মহান নেতা হিসেবে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। হাজার বছরের মধ্যে বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে যিনি আমাদের একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ উপহার দিয়েছেন পনেরই আগস্ট সেই জাতির জনককে কিছু বিশ্বাস ঘাতক নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যা করে। দেশ ও জাতির জন্য এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের আর কী হতে পারে?  বাঙালি জাতির এ ক্ষতি আর কোনোদিন পুরণ হওয়ার নয়।

আলোচনা অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর সাধন রঞ্জন ঘোষ। আলোচনা সভায় শিক্ষকদের মধ্যে আইন ডিসিপ্লিনের প্রভাষক পুণম চক্রবর্তী, কর্মচারীদের মধ্যে উপ-রেজিস্ট্রার দীপক চন্দ্র মন্ডল এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভাস্কর্য ডিসিপ্লিনের রূপক কুমার সাহা ও বাংলা ডিসিপ্লিনের মিতা দাস। সূচনা বক্তব্য রাখেন আয়োজক কমিটির সদস্য-সচিব ছাত্রবিষয়ক পরিচালক প্রফেসর শরীফ হাসান লিমন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বাংলা ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোঃ দুলাল হোসেন এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিনের প্রভাষক নিশাত তারান্নুম। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্কুলের ডিন, ইনস্টিটিউটের পরিচালক, রেজিস্ট্রার, ডিসিপ্লিন প্রধান ও বিভাগীয় প্রধানসহ বিপুল সংখ্যক শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মাচারীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। পরে বাদ যোহর বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জাতির জনক ও তাঁর পরিবাবেরর সদস্য যারা ১৫ আগস্টে শাহাদাৎ বরণ করেন তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করা হয়। দোয়া পরিচালনা করেন বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *