বাংলাদেশ সরকারের সকল বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত উচ্চ-পদস্থ ‘কর্মচারী’ বা অফিসারগণ নিজেদের ‘কর্মকর্তা’ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন নিয়োগ বিধি এবং দেশের সংবিধান লঙ্ঘনের তোয়াক্কা না করেই। এবং দেশের প্রায় সকল মিডিয়া উচ্চ-পদস্থ সরকারী কর্মচারীদের উল্লেখে ‘কর্মকর্তা’ লিখছেন বা বলছেন যা মূলত নির্বোধ সাংবাদিকতা এবং প্রত্যক্ষ ভাবে সংবিধান লঙ্ঘন। আর এ জন্য মূলত আমলাতন্ত্রই দায়ী।
বাংলাদেশের সংবিধানের যে সকল অনুচ্ছেদে সরকারী কর্মচারীদের বিষয়ে উল্লেখ আছে সে সকল অনুচ্ছেদগুলি হ’ল ২১, ১১৩, ১১৬ (ক), এবং ১৩৫। এর প্রত্যেকটি অনুচ্ছেদে সরকারী কর্মীদের ‘কর্মচারী’ বলা হয়েছে, কারণ পিপলস্ রিপাবলিক-এ সরকারী কর্মচারী কখনই কর্মকর্তা নয়, সকল কর্মের কর্তা হ’ল জনগণ। যদি কেউ সরকারী কর্মচারীকে কর্মকর্তা বলেন বা লেখেন তবে তিনি বা তাহারা সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে অপরাধী হবেন।
বাংলাদেশের সরকারী কর্মচারীরা কি হঠাৎ করেই নিজেদের ‘কর্মচারী’র পরিবর্তে ‘কর্মকর্তা’ লিখতে বা বলতে শুরু করেছেন বা তাদের ‘স্যার’ বলতে জনগণকে এবং নি¤œপদস্থ কর্মচারীদের বাধ্য করেছেন ?
এ প্রশ্নের উত্তরে বিশেষজ্ঞগণের মত হ’ল, বাংলাদেশের সরকারী কর্মচারীরা হ’ল বৃটিস-ভারতের আমলাতন্ত্রের ধারাবাহিকতার এক বর্তমান রূপ, যা একাধিক রাষ্ট্র বিপ্লবেও (১৯৪৭’র ভারত বিভাগ ও বিশেষ করে ১৯৭১’র মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতিকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে) তার অতীত ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং তার জন্মদাতার (বৃটিস জলদস্যু) নির্দেশিত পথ ও মতেই চলছে !
বৃটিস জলদস্যু ক্লাইভ (কোম্পানীর মোড়কে) ১৭৫৭ খৃঃ বাংলা দখল করলে বাংলার শাসন ব্যবস্থা ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে চলে যায়, যা(কোম্পানীর শাসন) পরবর্তী একশ’ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। প্রশাসন চালাতে কোম্পানী রাইটার(বার্ষিক বেতন ৫ পাউন্ড), ফ্যাক্টর, জুনিয়র মার্চেন্ট ও সিনিয়র মার্চেন্ট (বার্ষিক বেতন ৪০পাউন্ড) নামে চার পদের কর্মচারী আমদানী করে ইংল্যান্ড থেকে। আর বিভিন্ন ধরনের কেরানী বা ‘মুন্সি’ ও অন্যান্য কর্মচারী সংগ্রহ করে এ দেশ থেকে। কেরানী বা মুন্সি তৈরী করতে ১৭৮১ খৃঃ ওয়ারেন হেস্টিংস্ নির্মান করেন ‘কলকাতা মাদ্রাসা আলীয়া।’ এখানে তৈরী হ’ত ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর জন্য ফার্সি ভাষায় (তখনও সরকারী কাজকর্ম সম্পাদন হ’ত ফার্সি ভাষায়) হিসাব-নিকাশ লেখা মুন্সি (আজকের সরকারী কর্মচারীদের আতুড় ও শিশুকাল)। এই কর্মচারীরা শিশুকালেই রাক্ষস শিশু।
ইংরেজ কোম্পানীর কেরানী-মুন্সি হিসেবে ইংরেজের চাকর-নফর হলেও দেশের মানুষের কাছে এরা তখন জমিদার-লাটবাহাদুর (হেস্টিংস্’র দেওয়ান বা ম্যানেজার কোলকাতার জমিদার মহারাজা নবকৃষ্ণ)। এ ক্ষমতা শুধু ইংরেজের কর্মচারী হিসেবে নয়, বিস্তর টাকার মালিক হিসেবে এ সকল মুন্সি-কেরানীরা তখন এক একটা ক্ষুদে নবাব। তাদের এই টাকার প্রধান উৎস হ’ল দুর্নীতি বা ‘ঘুষ’ যা তারা প্রভু ইংরেজের নিকট থেকে খুব ভালো ভাবে রপ্ত করেছিলো।
কোম্পানী প্রশাসনের কর্মচারীদের আয়ের প্রধান উৎস ছিলো ঘুষ। বড় থেকে ছোট সকল কর্মচারীই ছিলো ঘুষ খোর। History of India’র লেখক আয়ারল্যান্ডের অধিবাসি ঐতিহাসিক জেমস্ স্টুয়ার্ট মিল (অর্থনীতিবিদ জন স্টুয়ার্ট মিল’র বাবা) লিখেছেন, এ দেশে (ভারতে) ইংরেজরা ঘুষ গ্রহণের কৌশলটাকে প্রায় ‘চারুকলার’ পর্যায়ে উন্নিত করেছিলো। প্রত্যেক ক্ষেত্রে পদে পদে যখনই তারা ঘুষ নেওয়ার সুযোগ পেত তখনই তা বিনা দ্বিধায় ও নিঃসঙ্কোচে নিতো। তিনি এর বিস্তর উদাহরণ দিয়েছেন, যেমন- বর্ধমানের ডিসি (ডেপুটি কালেক্টর) জন ব্যাথো (লড়যহ ইধঃযড়) স্থানীয় জমিদারকে লবন ব্যবসায় অবৈধ সুযোগ-সুবিধা (২ বছরের জন্য) প্রদানের বিনিময়ে ঘুষ নেয় ২৮ হাজার টাকা (বর্তমানে ডিসিরা যে ভাবে নদী-খালগুলি ইজারা দিচ্ছে)। এর মধ্যে সে নিজে রাখে ১৪ হাজার টাকা, আর ভাগা হিসেবে ১৪ হাজার টাকা প্রদান করে কোম্পানীর কাউন্সেলর চীফ জর্জ ভ্যান্সিটার্ট (৪১৪৮ টাকা) সহ অন্যান্য অফিসারদের। ঘুষের ভাগা সিস্টেম তখন থেকেই এদেশে চালু হয়েছে !
এ ভাবে পুরো দেশটাই ইংরেজের ঘুষের রাজ্যে পরিণত হয়। আর কোম্পানী শাসনের বিচার বিভাগ বা এ দেশের বিচার বিভাগের যাত্রা অর্থাৎ ইংরেজ প্রণিত আইন ও বিচারের নমুনা চরম নির্লজ্জ বেহায়াকেও লজ্জা দেবে। ১৭৯৫ সালের ১ আগষ্ট কোলকাতা সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণ সিঁদ কেটে চুরির অপরাধে ৬ জন কে প্রাণদন্ড দেয়। অন্যদিকে ১৮০৪ সালের ৪ নভেম্বর সুপ্রীম কোর্টের বিচারকগণ জন, ম্যাথু ও মোহাম্মদ কে খুনের দায়ে প্রত্যেকের খুনি কে ১টাকা জরিমানা ও ১ মাসের কারাদন্ড প্রদান করে। বলা বাহুল্য এ সকল বিচারিক তেলেসমাতি ঘটেছিলো ঘুষ নামক ভেল্কির জোরে, যা এ দেশে বর্তমানেও রকমফের-এ বহাল অছে। তাইতো প্রধান বিচারপতি প্রায়সই বিচারকদের হুশিয়ারী দেন সৎ ভাবে বিচারীক কার্য করতে।
বৃটিস’র ভারত সাম্রাজ্যে শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক ভাষা কি হওয়া উচিৎ সে বিষয়ে দায়ীত্ব দেওয়া হয় ব্যারন (পরে লর্ড) ব্যাবিংটন মেকলে কে। এ বিষয়ে ১৮৩৫ খৃঃ মেকলে তার যুগান্তকারী (!) সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। তিনি বলেন, “ এটা সত্য যে আমাদের পক্ষে ভারতীয় জনগণ কে শিক্ষিত করে গড়েতোলা সম্ভব নয়। বরং আমরা একটি ‘বিশেষ শ্রেণী’ গড়ে তুলবো যারা মূলত গড়ে উঠবে একদল অনুবাদক হিসেবে, আমাদের (বৃটিস রাজ) এবং আমাদের দ্বারা শাসিত লক্ষ-কোটি ভারতবর্ষের জনগণের মধ্যে দোভাষী হিসেবে কাজ করার জন্য। এ শ্রেণীর প্রত্যেকে হবে বর্ণে ও রক্তের ধারায় ভারতীয় কিন্তু বুদ্ধিমত্তায়, রুচিতে, মতামত ও নৈতিকতায় খাটি ইংরেজ।” এর প্রধান উদ্দেশ্য হ’ল ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত এই বিশেষ শ্রেণীর লোকেরা নিজেদের ইংরেজ (কালো) হিসেবে, দেশের একমাত্র ভদ্দরলোক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে এবং দেশের সিংহভাগ সাধারণ মানুষকে ইতরজন হিসেবে ঘৃণা করতে শিখবে। এর ফলে এই কালো ইংরেজরাই বৃটিস’র দালাল হিসেবে তার আইন-কানুন ও শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখবে। আর এই কালো ইংরেজদের হাতেই ভারতের ভবিষ্যৎ রাজনীতির হাল ধরিয়ে দেওয়া হবে, যাতে ইংরেজ না থাকলেও এই কালো ইংরেজরাই ইংরেজ’র ‘তন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত রাখবে ভারতবর্ষে !
১৮৩৭ খৃঃ পর্যন্ত ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সরকারের প্রশাসনে সরকারী ভাষা ছিলো ফার্সী। ১৮৩৭ খৃঃ সরকারী ভাষা হিসেবে চালু হয় ইংরেজী, আর প্রশাসনে দেখা দেয় মেকলের কালো ইংরেজ, যারা সকলেই নিজেদের সাহেব বা ‘স্যার’ ভাবতে শুরু করে আর নিজ দেশের সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে দিতে থাকে যে তারাও ‘স্যার।’ এবার প্রশাসনে এ সকল কালো ইংরেজদের দাপোট এবং তার ফলাফল দুর্নিতী ব্যাপক বৃদ্ধি পায়, ফুলে-ফেঁপে ওঠে এ সকল কালো ইংরেজ প্রশাসনিক কর্মচারী ‘স্যার’ দের বিত্ত-বৈভব।
১৮৫৮ খৃঃ প্রথম ভারতীয় জাতীয় বিপ্লব (তথাকথিত সিপাহী বিপ্লব) দমনের সাথে সাথে শেষ হয় ভারতে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন ব্যবস্থা। শুরু হয় ভারতে বৃটিস রাজ’র প্রত্যক্ষ শাসন, তবে পূর্বের প্রশাসনিক অবকাঠামো অক্ষুন্ন থাকে, এর সাথে সেকশন ৩২, ইন্ডিয়া এ্যাক্ট ১৮৫৮’র মাধ্যমে প্রশাসনে যোগ হয় ICS বা ইম্পেরিয়াল সিভিল সার্ভিস। এতে প্রথমে শুধু ইংরেজরাই সুযোগ পেত। পরে ICS অফিসার পদে কালো ইংরেজদেরও নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রথম কালো ইংরেজ ICS অফিসার হন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ খৃঃ)।
১৮৮৫ খৃঃ অবসর প্রাপ্ত (ICS) সচিব অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম’র সাহায্যে (এর চাকুরী শুরু কোম্পানী আমলে) বৃটিস ভাইসরয় লর্ড ডাফরিন ভারতীয়দের জন্য গড়ে তোলেন রাজনৈতিক দল ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস!’ ডাফরিনের নির্দেশে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক হন ‘সাবেক আমলা’ হিউম। একই পদ্ধতিতে ১৯০৫ খৃঃ আর এক সাবেক আমলা (ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট) ঢাকার নবাব খাজা সলিমুল্লাকে দিয়ে তৈরী করা হয় মুসলিম লীগ। এ ভাবে অবসরপ্রাপ্ত আমলাদেও দ্বারা রাজনীতি নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থা রাখা হয়। এ সময় থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানে দেখা যাবে অসংখ্য অবঃ আমলা (কালো ইংরেজ) দেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। সিভিল সার্ভিস’র চাকুরীতে ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থ-সম্পদেও মালিক এরা আগে জমিদারী ক্রয় করতো (তখন জমিদারী ক্রয় করলে রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হওয়া যেত), আর এখন দুর্নীতির অর্থ দিয়ে কোন একটা দলে ভিড়ে পার্লামেন্টের সিট ক্রয় করছে, এটাই ‘মেকলে তত্ত্বের’ মূল রহস্য!
ভারত স্বাধীন হ’ল না। ভারত কে বিভক্ত করা হ’ল দুই রাষ্ট্রে। ইংরেজের পোষ্যদের হাতে তুলে দেওয়া হ’ল রাষ্ট্র দুটি। বিনিময়ে দুই রাষ্ট্রেই ইংরেজের সবই থাকলো। থাকলো তার আইন, থাকলো তার বিচার ব্যবস্থা, থাকলো তার স্বেচ্ছাচার ও দুর্নীতির ইন্ডাষ্ট্রি ‘সিভিল সার্ভিস বা আমলা তন্ত্র।’ আর দুই দেশেই এরাই রক্ষা করলো বৃটিসের সকল একচেটিয়া ব্যবসা লিভার ব্রাদার্স, রেকিট এন্ড কোলম্যান, .. .. … ।
এর ফলে দুই দেশের জনগণই প্রতারিত হ’ল কিন্তু দুই দেশের শাসকরাই পেল সব! রাজতন্ত্রের আদলে চরম স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা,অগাধ ধন-সম্পদ লুটপাটের সুযোগ। সাদা ইংরেজের পরিবর্তে কালো ইংরেজ রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হ’ল তাদের পিতার সকল আইন-কানুন-আমলা-পাইক-পেয়াদা সহ।
কিন্তু রাজনৈতিক এ সকল প্রতারণায় প্রতারিত হতে রাজি হয় নি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। তাই ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত আর তার চেয়েও কাঠিন আর মূল্যবান ২ লক্ষ মা-বোন’র সম্ভ্রমের বিনিময়ে সত্যিকার অর্থে(?) স্বাধীন হ’ল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের নিজের সংবিধান হ’ল, বাংলাদেশের নতুন নাম হ’ল পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ এর ২ ধারায় বলা হয়েছে যে, জনগণের অভিপ্রায় বা ইচ্ছার পরম অভিব্যাক্তিরূপে এই সংবিধান পিপলস্ রিপাবলিকের সর্ব্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত সামঞ্জস্যহীন হয় অর্থাৎ পিপলস্ রিপাবলিকের কাঠামোর সাথে সংগতিহীন হয় তাহা হইলে সেই আইন অবৈধ বা বাতিল হইবে।
এ ক্ষেত্রে পরাধীন দেশের জন্য প্রযোজ্য ‘বৃটিস সিভিলসার্ভিস আইন’ স্বাধীন বাংলাদেশের সাথে অর্থাৎ পিপলস্ রিপাবলিকের কাঠামোর সাথে বা স্বাধীন নাগরীকদের ইচ্ছার সাথে সম্পূর্ণ সংগতিহীন, তবুও ‘বৃটিস সিভিলসাভির্স’র প্রেতাত্মাই’ চেপে বসলো স্বাধীন বাংলাদেশের ঘাড়ে!
সংবিধানের একাধিক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, সরকারের কর্মে যারা নিয়োজিত হবে তারা হবে রাষ্ট্রের কর্মচারী। কিন্তু সংবিধান কে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করে রাষ্ট্রের কর্মচারী আমলাগণ নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে ‘কর্মকর্তা’ হিসেবে অর্থাৎ জনগণের কর্তা বা ‘স্যার’ (এ দেশে স্যার অর্থ হুজুর বা মালিক) বলে! আর সেক্রেটারিয়েটগুলি ভর্তি কত রঙের স্যার! এর পর আছে ডিসি স্যার! এসপি স্যার! ওসি স্যার সহ কত নানা পদের স্যার!
এ ভাবে সরকারের সকল বিভাগে অসংখ্য ‘কর্মকর্তা’ বা স্যার বসে আছেন, এরা কাদের স্যার? এদেরই চাকুরীদাতা দেশের সকল নাগরীকদের এরা স্যার? আর এদের স্যার বা হুজুর না বললে কি হয় তা হাড়ে হাড়ে টেরপাচ্ছেন প্রতিদিন দেশের সাধারণ নাগরীকগণ অফিস-আদালত সহ বিভিন্ন স্থানে।
এ দেশের মানুষ যখন বৃটিস জলদস্যু রাজার প্রজা ছিলো তখন থেকে এই আমলাদের স্যার বলতে বাধ্য হচ্ছে। বিগত আড়াই শ’ বছর যাবৎ (বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশেও) এদের স্যার বলতে বলতে দেশের সাধারণ মানুষ এখন চরম “মানসিক দাসত্বের” শিকার। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ‘কাদের’ তার উপর পুলিশের জঘন্য নির্যাতনের ঘটনা সাংবাদিকদের নিকট বর্ণনা করতে গিয়ে নির্যাতক ওসি কে যখন ওসি ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করে তখন অবাক না হয়ে বুঝতে হবে যে এই ‘স্বঘোষিত কর্মকর্তা কালো ইংরেজ গোষ্ঠি’ দেশের সাধারণ নাগরীকদের আত্মসম্মান বোধ ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে তাদের অত্যাচার ও স্বেচ্ছাচারের অস্ত্র দিয়ে।
এ সকল উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীরা চাকুরী জীবনে বহুবার উচ্চ শিক্ষার্থে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলিতে (রিপাবলিক) গিয়ে থাকেন। ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ তাদের চেয়ে শিক্ষায়, কর্ম যোগ্যতায় আরও উন্নত বলেই সেখানে এরা শিখতে যান। এরা সে সকল দেশে গিয়ে কি দেখেন আর কি শেখেন?
ইউরোপের কোন দেশে বা আমেরিকার সরকারী অফিসগুলিতে কি কোন কর্মকর্তা গোষ্ঠি বা ‘স্যার’ গোষ্ঠি আছে ? সে সকল অফিসে কি পিওন নামের কোন চাকর গোষ্ঠি(চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী) আছে ? সেখানে কি নাগরীকরা নিয়মিত ঘুষ দিয়ে থাকে ?
এ বিষয়ে রিপাবলিক অব জার্মানির একটি অফিসের সরেজমিন চিত্র তুলে ধরা যাক। জার্মানীর ষ্টাড কোল্ন’র নরভেনিচ শহরের মেয়র’র অফিসে একজন রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী যান তার কিছু প্রয়োজনীয় কাগজের জন্য। মেয়রের কক্ষে প্রবেশ করলে মেয়র তাকে স্বাগত জানিয়ে তার আগমন সম্পর্কে জানতে চান। এর পর মেয়র স্বহস্তে কফি তৈরী করে তাকে পরিবেশন করেন। কফি পানের ফাঁকে তার কাগজগুলি তৈরী করেন। এবার মেয়র তার চেয়ার থেকে উঠে পাশের একটি রুমে যান যেখানে ফটোকপি মেশিন থাকে। কাগজগুলির ফটোকপি করে তিনি রুমে ফিরে কাগজগুলি আগন্তুককে প্রদান করেন। উল্লিখিত সকল কাজই তিনি নিজে করেন, কারণ তার কোন পিওন নেই। অফিসটিতে প্রায় ৫০ জন কর্মচারী কাজ করেন বিভিন্ন পদে, তবে অফিসে কোন বস্ বা স্যার নেই, আর নেই কোন পিওন। আর ঘুষ ? এ শব্দটাই তাদের অজানা।
এ চিত্র শুধু জার্মানীর একটি শহর বা জার্মানীর নয় বরং সমগ্র ইউরোপ ও আমেরিকার রিপাবলিকের এটাই চিত্র। এ সকল অফিসে কোন পিওন (চাকর) নেই, কোন স্যার নেই আর ঘুষ নেই। এরা সবাই নিজের কাজ নিজে করতে বাধ্য কারণ রিপাবলিক তো জমিদারতন্ত্র নয়। তাই এ সকল দেশে স্থায়ী কোন আমলাতন্ত্র নেই, যে দল ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসে তারা তাদের মন্ত্রনালয়গুলির সেক্রেটারি নিয়োগ দেয়। সরকারের মেয়াদ শেষ হলে সেক্রেটারিদের চাকুরির মেয়াদও শেষ হয়। আমলা নিয়োগ দেওয়া হয় অস্থায়ী হিসেবে চুক্তি ভিত্তিক।
এর বিপরীতে আমাদের সরকারী অফিস ও তার কর্মচারী (স্বঘোষিত কর্মকর্তা, স্যার) ও তাদের কর্মকান্ড একটু ক্ষতিয়ে দেখা যাক Ñ
খুলনা জেলা প্রশাসন সূত্রমতে, জেলা প্রশাসনে ‘কর্মকর্তা’ কর্মচারীর বরাদ্দকৃত পদ ১০১৫ টি। বর্তমানে কর্মরত ৭৫৯ জন। এর মধ্যে বরাদ্দকৃত পিওন’র (এমএলএসএস) সংখ্যা ১০২জন, বর্তমানে কর্মরত পিওন ৬৩ জন।
খুলনা কর বিভাগের দু’টি অফিস (কর ও আপিল বিভাগ)। কর বিভাগের প্রশাসনিক সূত্রমতে, এ দপ্তরে ‘কর্মকর্তা’ কর্মচারীর মোট পদ ২৮১টি, বর্তমানে কর্মরত ১৯৬ জন। এর মধ্যে পিওন’র পদ ৫০টি, বর্তমানে কর্মরত ৩৭ জন।
খুলনা জেলার বেশ কিছু সরকারী ও কর্পোরেশন অফিসে অনুসন্ধান করা হয় (২০১০ সালে)। এর মধ্য থেকে কয়েকটি চিত্র তুলে ধরা হ’ল যা আসলে সারা দেশেরই চিত্র। খুলনা সিটি কর্পোরেশনের(কেসিসি) প্রশাসনিক দপ্তরের তথ্যানুযায়ী কেসিসি’র স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা (এদের বেতন সরকারের রাজস্ব খাত থেকে দেওয়া হয়) ৯১০ জন। এর মধ্যে ‘কর্মকর্তা’র সংখ্যা ৩৭ জন। অন্যদিকে পিওন’র সংখ্যা ৭৪।
এ সকল অফিসের কর্মীরা জানান, এখানে যারা ‘কর্মকর্তা’ হিসেবে কাজ করেন অন্য সকল কর্মচারীরা তাদের স্যার বলতে বাধ্য। এবং এ সকল অফিসে যে সকল নাগরীকরা বিভিন্ন কাজ নিয়ে আসেন তারাও এসকল ‘কর্মকর্তা’দেও স্যার বলতে বাধ্য হন (অন্যথায় তারা গোস্যা করেণ)!
এ সকল অফিসের পিওনদের নিকট তাদের কাজের ধরন সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা জানান, তাদের কোন দাপ্তরীক কাজ নেই। মূলত তারা (সকল ‘কর্মকর্তা’ নামের কর্মচারীদের ব্যক্তিগত পিওন আছে) সারাদিনই ‘কর্মকর্তা’ ও অন্যান্যদের জন্য চা-নাস্তা-সিগারেট আনা ও পরিবেশনের কাজ করেন এবং বিভিন্ন ধরনের ফাইফরমায়েস খাটেন। উল্লিখিত সকল অফিসের কর্মকান্ড চলে নির্দিষ্ট পরিমাণ ‘ঘুষ’র ভিত্তিতে। একটি বিশেষ পদ্ধতিতে প্রাপ্ত ঘুষ’র ভাগা অফিসার থেকে পিওন পর্যন্ত সকলেই পেয়ে থাকেন। এ সকল দপ্তরে ঘুষ দিলে দ্রুত কাজ হয়, আর ঘুষ ছাড়া নাগরীক অধিকার ফলাতে গেলে চরকী প্যাচ!
ইউরোপ-আমেরিকার অফিস কর্মীরা বাংলাদেশের অফিস কর্মীদের চেয়ে শিক্ষা ও কর্মদক্ষতায় অধিক যোগ্যতা সম্পন্ন হওয়া সত্বেও তাদের রাষ্ট্র (রিপাবলিক) তাদের জন্য একজনও পিওন বা চাকর বা সেবায়েত বরাদ্দ করে না। অথচ বাংলাদেশের বিসিএস (বিজিপ্রেস) ক্যাডার সহ অন্যান্য কর্মচারীরা তাদের চেয়ে শিক্ষায় ও কর্মে অদক্ষ ও অযোগ্য হওয়া সত্বেও তাদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে হাজার হাজার পিওন নামের চাকর বা সেবায়েত!
দেশের নাগরীকদের যদি জানার অধিকার থাকে তবে তারা জানতে চান এ সকল সরকারী কর্মচারীরা কি ‘হায়দ্রাবাদের নিজাম ?’
by
সর্বশেষ মন্তব্যসমূহ