সবকিছু সঠিক ভাবে বিবেচনা না করে পর্যটন বন্ধের সিদ্ধান্ত হবে হটকারীতা

‘সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও পর্যটন শিল্প ঃ সংকট, সম্ভাবনা ও করণীয় শীর্ষক’ এক আলোচনা সভা আজ খুলনা প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভার উদ্যোক্তা ট্যুর অপারেটর এ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবন (টোয়াস)।

সভায় মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন টোয়াস সভাপতি নাজমুল আজম ডেভিড। তিনি বলেন, বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী ‘বন্যপ্রাণীর প্রজনন মৌসুম’ উল্লেখ করে জুন, জুলাই ও আগস্ট এই তিন মাস সুনাদরবনে সব ধরনের পর্যটন নিষিদ্ধ করার বিষয়ে বন বিভাগ কাজ শুরু করেছে। এই সুপারিশ সিদ্ধান্ত আকারে বাস্তবায়ন করতে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে।

বন বিভাগের এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করেই মূলত আলোচনা সভা আবর্তিত হয়। সভার সঞ্চালক সুন্দরবন একাডেমির পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, আমাদের আসলে বোঝা দরকার সুন্দরবনের প্রকৃত অভিভাবক কে। কারণ, বন্যপ্রাণীর প্রজনন মৌসুমের উল্লেখ করে বন বিভাগ পর্যটন বন্ধ করতে চাচ্ছে, আবার সুন্দরবনে যখন নৌ-দুর্ঘটনায় তেল-কয়লা-সার ছড়িয়ে পড়ে সকল বন্য প্রাণীর প্রজননকে হুমকির মুখে ফেলে দেয় তখন কথা বলে নৌ-মন্ত্রনালয়, বন ও পরিবেশ মন্ত্রনালয়ের কথায় তখন কাজ হয় না।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি এন্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. মো. ওয়াসিউল ইসলাম বলেন, বন্যপ্রাণীর প্রজনন একটি স্পর্শকাতর বিষয়। কাজেই সঠিক তথ্যউপাত্য ছাড়া এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ঠিক হবে না। প্রজনন মৌসুমে শব্দ দূষণ প্রজননের জন্য ক্ষতিকর বলে বন বিভাগ পর্যটন বন্ধের সুপারিশ করেছে, কিন্তু একই সময় সকল প্রাণীর প্রজননকাল এটা ঠিক নয়। সে ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রাণীর প্রজননকালে নিরাপদ প্রজননের ব্যবস্থা গ্রহণে কি পর্যটন বন্ধ থাকবে।

তিনি প্রশ্ন রাখেন, পর্যটকদের আগমনে সুন্দরবনে বন্যপ্রাণীর প্রজননে কি ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করে সে বিষয়ে বন বিভাগের কোন গবেষণা আছে কি-না, যদি না থাকে তবে কিসের ভিত্তিতে বন বিভাগ পর্যটন বন্ধ করছে। তিনি বলেন, সমগ্র সুন্দরবনে পর্যটকদের আগমনে বনের পরিবেশের কি ধরনের ক্ষতি হয় তার পরিসংখ্যান বন বিভাগের থাকতে হবে অন্যথায় শুধু আন্দাজের বসবর্তী হয়ে গরিবেশের বিরুপতা নির্নয় বন বিভাগের হটকারিতা হিসেবে বিবেচিত হবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি এন্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. নাজমুস সাদাত বলেন, বর্তমানে সুন্দরবনের প্রধান বনজ সম্পদ আহরণ আইনত নিষিদ্ধ। সুন্দরবন সংরক্ষণ বর্তমানে পরিবেশ সংরক্ষণ। এ ক্ষেত্রে সুন্দরবনের প্রধান সম্পদ আহরণ হ’ল পর্যটন। সুন্দরবনের কি-স্টোন প্রাণীর মূল প্রজনন স্থান বা কোর জোন হ’ল স্যাংচ্যুয়ারী। বাঘের প্রজনন মৌসুম হ’ল শীতকাল। তিনি বলেন, শব্দ দূষণের কারণে পর্যটন বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে অথচ সারা বছর সুন্দববনের মধ্য দিয়ে নানা পণ্যের বানিজ্যিক জাহাজ চলাচল করলেও সে বিষয়ে বন বিভাগের কোন কথা নেই। তিনি বলেন, এ অবস্থায় পর্যটন সম্পূর্ণ বন্দ না করে বিকল্প ব্যবস্থা ভাবা উচিৎ। যেহেতু দেশে দুর্নীতি আছে তাই পর্যটন নিষিদ্ধ করা হলে অবৈধ ভাবে পর্যটন চালু থাকার সম্ভাবনা থেকে যাবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিন প্রধান প্রফেসর ড. সালমা বেগম বলেন, সুন্দরবনের অস্তিত্ত্বের জন্য শামুক ঝিনুক কাঁকড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো তার ইকো সিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর কাঁকড়া হ’ল ইকো সিস্টেম সমৃদ্ধ করার ইঞ্জিনিয়ার। কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুম হ’ল শীতকাল, অথচ বন বিভাগ শীতকালেই কাঁকড়া শিকারের পারমিট দেয় সবচেয়ে বেশী!

ট্যুর অপারেটর নজরুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবন বন বিভাগ কর্তৃপক্ষ কোন সময়ই পর্যটনকে ভালো চোখে দেখে না। এর প্রধান কারণ হ’ল বন এলাকায় বন বিভাগের কর্মচারী ছাড়া সাধারণ স্বাধীন মানুষের উপস্থিতি বন বিভাগ চায় না, এতে তাদের কিছু নিজস্ব কর্মকান্ড ব্যাহত হয়।

এক্টিভিস্ট শাহ মামুনুর রহমান বলেন, সুন্দরবনের ৩৭৫ প্রজাতীর প্রাণীর মধ্যে খুব কম সংখ্যক প্রাণীরই প্রজননকাল বর্ষা মৌসুম। তবে বন বিভাগের প্রজনন মৌসুম হ’ল বর্ষাকাল। এ সময়ে প্রচুর পানি থাকায় খুব সহজে বিপুল পরিমাণ গাছ কেটে বন উজাড় করে নিয়ে আসা হয় এবং কোটি কোটি টাকা উৎপাদন হয় বন বিভাগের গনি মিঞাদের।

অন্যানের মধ্যে বক্তৃতা করেন সমকাল পত্রিকার ব্যুরচীফ মামুন রেজা, ট্যুরিস্ট গাইড এসোেিসয়শন অব বাংলাদেশ এর প্রেসিডেন্ট এম এম ইসলাম বুলু, টোয়াব এর ডিরেক্টর তাসলিম আমিন শোভন। তাদের বক্তব্য, সুন্দরবনের মধ্যদিয়ে সারাবছর যে শত শত জাহাজ চলাচল করছে সে বিষয়ে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে বন্য প্রাণীর প্রজননের নামে পর্যটন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হবে এক ধরনের হটকারীতার সামিল।

গভায় সভাপতিত্ব করেন ক্যাব খুলনা জেলা শাখার সভাপতি এ্যাডঃ এনায়েত আলী। এ সময় অন্যান্যেও মধ্যে উপস্থিত ছিলেন খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়ন সাধারণ স¤পাদক মো. শাহ আলম, বিভাগীয় জেলা তথ্য অফিসের উপপরিচালক ম. জাভেদ, খুলনা প্রেসক্লাবের সভাপতি ফারুক আহমেদ, সাধারন স¤পাদক মল্লিক সুধাংশু, অনলাইন পোর্টাল সুন্দরবন সমাচারের চীফ রিপোর্টার শামীম আশরাফ শেলী, মহেন্দ্র নাথ সেন, আকবর হোসেন, ট্যুরিস্ট পুলিশ প্রতিনিধি প্রমূখ।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *