পারিবারিক আর্থিক অসঙ্গতি আর শিক্ষার অভাবই বাল্যবিবাহের মূল কারণ

একটিও সম্পন্ন ও শিক্ষিত পরিবারের মেয়েদের বাল্যবিবাহ হয়েছে বা হচ্ছে এমন নজির নেই, তাই মূলত পারিবারিক আর্থিক অসঙ্গতি আর শিক্ষার অভাবই বাল্যবিবাহের মূল কারণ। এ সমস্যা সমাধান ছাড়া সাভাবিক ভাবে বাল্যবিবাহ নিরোধ কঠিন।

সকল কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করা ও বাল্যবিবাহ বন্ধে বাবাদের যত্নশীল ভূমিকা পালনে উৎসাহিত করার নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণে আইন-প্রণেতাদের আরো সক্রিয় ভূমিকা পালনের আহবান জানিয়েছে তরুণরা।

আগামী জাতীয় বাজেটে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধির পাশাপাশি ২০২১ থেকে ২০৩০ পর্যন্ত বাল্য বিবাহ নিরোধ দশক হিসাবে ঘোষণা করে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে দেশব্যাপী প্রচার অভিযান পরিচালনা করার দাবি তাদের।

সবার জন্য যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং বাল্য বিবাহ বন্ধে সেভ দ্য চিলড্রেন’র ‘যুবদের অ্যাডভোকেসি প্রকল্প’র উদ্যোগে রবিবার (২৬ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় সংসদ সদস্যদের সাথে যুবদের এক সংলাপে এই দাবি জানানো হয়।

সংলাপে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্যগণ তরুদের দাবির প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে দাবিগুলো এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে তাদের সক্রিয় ভ‚মিকা পালনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এছাড়া, তারা এই বিষয়ে দেশব্যপী সচেতনাতা সৃষ্টির ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে ভূমিকা পালনের আহবান জানান।

এনগেজ মেন এন্ড বয়েজ (ইএমবি) নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ’র সচিবালয়  সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ, ইয়ুথ প্লাটফর্ম ফর ট্রান্সফরমিং মাস্কুলিনিটিজ ও জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম যৌথভাবে  এ সংলাপের  আয়োজন করে।

সারাদেশ থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দেয়া যুব প্রতিনিধিদের সাথে ছয়জন জাতীয় সংসদ সদস্য- অপরাজিতা হক, এডভোকেট খোদেজা নাসরিন আক্তার হোসেন, ডা. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল, উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগম, তামান্না নুসরাত, এবং এডভোকেট আদিবা আনজুম মিতা প্রমুখ মতবিনিময় সভায় অংশ নেন।

সেভ দ্য চিলড্রেন এর জেন্ডার এ্যাডভাইজার উম্মে সালমা’র সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই সংলাপে তরুণদের পক্ষে বাল্যবিবাহ বন্ধ প্রকল্পের জাতীয় চেঞ্জমেকার  সোহানুর রহমান, নিবেদিতা বর্মা, সামসুল ইসলাম পলক, ইএমবি নেটওয়ার্কের জাতীয় সমন্বয়কারী রিফাত বিন সাত্তার, সদস্য মুশফিকুর রহমান সাব্বির এবং হাবিবুর রহমান, জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সাধারণ সম্পাদক নাসিমা আক্তার জলি অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন।

সংলাপে আরও বলা হয়, বাল্যবিবাহের প্রধান কারণ, অভিভাবকদের আর্থিক দৈন্যতা, অশিক্ষা ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। বিশেষ করে ততোদিন বাল্যবিবাহ বন্ধ করা কঠিন যতদিন উল্লিখিত সমস্যার সমাধান না হয়। এই প্রেক্ষাপটে সবার জন্য যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং বাল্যবিবাহ বন্ধে পুরুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ বিষয়ক যুবদের অ্যাডভোকেসি প্রকল্পের ১১১ জন যুব চেঞ্জমেকার গত নভেম্বর মাসে দেশের ৩৪টি জেলায় দুই হাজার ৩৪০ জন পুরুষের সঙ্গে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং বাল্যবিবাহ বন্ধে পুরুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের অ্যাডভোকেসি সংলাপ পরিচালনা করেছে। তাদের মধ্যে ছিলেন ছাত্র, শিক্ষক, বাবা, স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মচারী, সাংবাদিক, ধর্মীয় নেতা, কাজী, ক্রীড়াবিদ এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনের প্রতিনিধি। সংলাপে  তরুণ বক্তারা আরো বলেন, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বিশেষত ধর্ষণের ঘটনা তাদের আতংকিত করে তুলেছে। করোনাকালে ধর্ষণ ও বাল্য বিবাহের ঘটনা অনেক বেড়েছে।

তারা বলেন, পুরুষালি আচরণ চর্চায় পুরুষদের উৎসাহিত করার মাধ্যমে যৌন সহিংসতা ও বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব।  এই প্রেক্ষাপটে যুব চেঞ্জমেকাররা সবার জন্য যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার এবং বাল্য বিবাহ বন্ধে পুরুষ বিশেষত বাবাদের যত্নশীল আচরণে উদ্বুদ্ধ করার পদক্ষেপ আইন ও নীতিমালায় অন্তভূক্তির জন্য সংসদ সদস্যদের  কাছে একগুচ্ছ সুপারিশমালা তুলে ধরেন।

সুপারিশমালার মধ্যে রয়েছে,  বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, এটিকে সংশোধন করা এবং বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ এবং যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার প্রসারে বাবাদের উদ্বুদ্ধকরণে বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করা। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দূর করা, ছেলে শিশুদের আরো সম্পৃক্ত করা এবং প্রতিবন্ধী ব্যাক্তিবর্গ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী/আদিবাসী ও হিজড়া জনগোষ্ঠীর চাহিদা অনুযায়ী মানসম্মত যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। যত্নশীল পুরুষালী আচরণ ও যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার’র বিষয়টি শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষা কারিকুলাম তৈরী করার সুপারিশ তুলে ধরা হয়।

আলোচনায় অংশ নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ডাঃ সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল বলেন, বাল্যবিবাহ বন্ধে বাবা ও পুরুদের ভূমিকাই বেশি। আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে বাল্যবিবাহের সিদ্ধাস্ত এখনো পুরুষেরা নিয়ে থাকেন। বাল্যবিবাহ বন্ধে সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনের সোচ্চার আন্দোলনে পুরুষেরা অংশীদার হতে পারে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের কঠোর বাস্তবায়নের পাশাপাশি পুরুষদের অনুপ্রাণিত করতে পারলে শুন্য বাল্য বিবাহ মুক্ত এলাকা গড়ে তোলা সম্ভব।  এলক্ষ্যে স্থানীয় পর্যায়ে প্রচার প্রচারণা বাড়াতে হবে। এসময় তিনি বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের বির্তকিত ১৯ ধারার যথাযথ প্রয়োগের উপর গুরাত্বারোপ করারর পাশাপাশি তরুণদের দাবিসমূহ সংসদীয় অলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করবেন বলে অঙ্গীকার করেন। আমাদের তরুণরা ‍সঠিক পথেই আছে উল্লেখ করে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য অপরাজিতা হক বলেন,  বাল্য বিবাহ বন্ধে প্রধান কারণে দৃষ্টি দিতে হবে। এক্ষেত্রে পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি পরির্তনে আরো বেশি কাজ করতে হবে।

জাতীয় সংসদ সদস্য খাদেজা নাসরিন আক্তার হোসেন বলেন, বাল্য বিবাহ বন্ধে পুরুষদের সম্পৃক্তকরণ একটি সময় উপযোগী উদ্যোগ। তরুণরা সংগঠিত হলে সামাজিক প্রতিরোধের মাধ্যমে এই বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ করা সম্ভব ।

নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের উপর গুরুত্বারোপ করে সংসদ সদস্য তামান্না নুসরাত (বুবলী) বলেন, মেয়েরাও মানুষ, নারীরাও মানুষ। তাদেরও সম্মান রয়েছে। সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন এবং বাল্য বিবাহ বন্ধে বেশি বেশি প্রচারণা চালাতে হবে। এক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধি ও গণমাধ্যমকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে তিনি আহবান জানান।

সংসদ সদস্য উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগম (শিউলি আজাদ) বলেন,  অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে হলে প্রসূতি ও শিশু মৃত্যু বাড়ে। আমরা সবাই মিলে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ করছি। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আমরা সোচ্চার রয়েছি।

অনেকক্ষেত্রে  অবৈধভাবে বাল্যবিবাহ হলেও  তা নিবন্ধন না করলে অনেক সময়ে আইনী সহায়তা থেকে নারীরা বঞ্চিত হচ্ছে  উল্লেখ করে সংসদ সদস্য আদিবা আনজুম মিতা সবাইকে সচেতন ও সর্তক থাকার পরামর্শ দেন। এনগেজ মেন এন্ড বয়েজ (ইএমবি) নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের জাতীয় সমন্বয়কারী রিফাত বিন সাত্তার বলেন, বাল্য বিবাহ একটি বহুমাত্রিক বিষয়। যত্নশীল আচরণের বিষয়ে পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক রুপান্তর ঘটাতে আইনী সংস্কারের জন্য পাশাপাশি সংসদ সদস্যরা স্থায়ী কমিটির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়গুলোকে আইন ও নীতিসমূহ যথাযথ বাস্তবায়নে নির্দেশনা দিতে পারেন।

ইয়ুথ প্লাটফর্ম ফর ট্রান্সফরমিং মাস্কুলিনিটিজ  ফোরাম এর সহযোগিতায় ইএমবি নেটওয়ার্ক  ‘সবার জন্য যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার এবং বাল্য বিবাহ বন্ধে পুরুষের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি’ নামের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।  প্রকল্পটি থেকে যুব চেঞ্জমেকাররা যত্নশীল পুরুষালি আচরণের লেন্স থেকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং বাল্যবিবাহ বিষয়ক সরকারের বিভিন্ন নীতিমালা, আইন, ও জাতীয় কর্মপরিকল্পনা এবং গবেষণাপত্র পর্যালোচনা করেছেন। উদ্দেশ্য ছিল, সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতিমালা বাস্তবায়নে কিভাবে পুরুষ ও কিশোররা সক্রিয়ভাবে জড়িত হওয়ার পাশাপাশি নারী ও শিশুদের অধিকার প্রচার ও সুরক্ষায় যতœশীল ভূমিকা রাখতে পারেন, তা গভীরভাবে অনুসন্ধান করা। পর্যালোচনার পাশাপশি নারী ও শিশুদের অধিকার প্রচার ও প্রসারণে নিযুক্ত সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা, নারীনেত্রী, তৃতীয় লিঙ্গসহ যুবনেতাদের সাক্ষৎকার নেয়া হয়েছে।

যুবদের পর্যালোচনায় উঠে এসেছে যে, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি। এটি শিশু অধিকার পূরণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁধা হিসাবে এখনো আমাদের সমাজে অব্যাহত রয়েছে। বাল্যবিবাহ মেয়ে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, এবং মানসিক বিকাশ এবং শিক্ষাগত সুযোগগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যেহেতু বাল্যবিবাহ দারিদ্র্যের চক্রকে শক্তিশালী করে এবং লিঙ্গ বৈষম্য, নিরক্ষরতা এবং অপুষ্টির সঙ্গে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর উচ্চ হারকে স্থায়ী করে তোলে।পুরুষালি আচরণ চর্চায় পুরুষদের উৎসাহিত করার মাধ্যমে যৌন সহিংসতা ও বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব। কারণ, প্রচার-প্রচারণা ও উদ্বুদ্ধকরণে ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে মেয়েশিশুর প্রতি পরিবারে দৃষ্টিভঙ্গির।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *