লেভ তলস্তয়’র স্কুল

লেভ তলস্তয়: বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম পুরোধা মহান মানুষ লেভ নিকোলায়েভিচ তলস্তয় (১৮২৮-১৯১০) জন্মগ্রহণ করেন রাশিয়ায়। অভিজাত পরিবার হিসেবে তার পরিবার ছিলো রাজ ক্ষমতার অংশ, আর তাই জন্মগত ভাবে তার খেতাব ছিলো ‘প্রিন্স” এবং রাজ ক্ষমতার অংশ হিসেবে প্রাপ্ত পারিবারিক জমিদারীর কর্তা হিসেবে তাঁর খেতাব ছিলো ‘কাউন্ট’ অর্থাৎ বড় জমিদার। কিন্তু নিজের জীবন চর্যায় তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই ‘রাখাল রাজা’ ।

তিনি চাইতেন রাষ্ট্রের সম্পত্তি সবার হোক, জমিদার নয় যারা কৃষক তারাই শুধু জমির মালিক হোক। রাষ্ট্রের সম্পদ বন্টন ব্যবস্থা নিয়ে জার’র সাথে তাঁর মতদ্বৈধতা ছিলো। শাসক গোষ্ঠি ছিলো তাঁর স্ব-জাতি, কিন্তু তার লেখনীর চাবুকদিয়ে তাদের তিনি নির্মম ভাবে চাবকে রক্তাক্ত করেছেন, জার সহ শাসকগোষ্ঠি তাকে ভয় পেত, কারণ তার কথায় এবং কর্মে তিনি ছিলেন আপোষহীন। আর এ কারণেই তিনি অভিজাত জীবনযাপন ত্যাগ করে কৃষকদের মত পোশাক পরতেন, মিতাহারী তিনি অতিসাধারণ খাবার খেতেন এবং সুযোগ পেলে জমি চাষাবাদ করতেন, এমন কি তাঁর নিজের প্রজাদের জমিও চাষ করে দিতেন।

তিনি নিজেকে যিশুখৃস্টের প্রকৃত অনুসারী হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি গির্জা নিয়ন্ত্রিত খৃস্টানধর্মকে “ধর্ম ব্যবসা” হিসেবে ঘোষণা করেন এবং গির্জা নিয়ন্ত্রিত খৃস্টানধর্ম ত্যাগ করেন। এর ফলে পাদ্রিদের দ্বারা তিনি সমালোচিত হন এবং চার্চ থেকে তিনি বহিস্কৃত হন। তিনি চার্চের সমালোচনাকে থোড়াই পরোয়া করেছেন, কারণ তিনি আগেই তাদের ত্যাগ করেছেন।

তাঁর সাহিত্য কর্ম গুনগত মানে এবং পরিমানে উভয় দিকেই বিশাল। তিনি অন্যের কথা শুনে নিজের রচনা সৃষ্টি করেন নি, বরং এ ধরনের লেখার তিনি সমালোচনা করেছেন। নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকেই তিনি তার সাহিত্যকর্মে ব্যবহার করেছেন। এবং যা লিখেছেন সে দর্শন তিনি নিজের জীবনেও মেনে চলেছেন। অন্যদিকে, দেশে দেশে বহু জমিদার-ভাড়াটে জমিদার নিজ নিজ দেশে সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন, কিন্তু তাদের সাহিত্য বচনের সাথে তাদের নিজেদের জীবনযাত্রার মিল খুঁজতে গেলে হোচট খেতে হয়, আর এখানেই তিনি অনন্য।

তাঁর অন্যতম সৃষ্টি  “ওয়ার এন্ড পিস”,  “ আনা কারে নিনা”,  “রেজারেকশন,” সহ বিপুল সৃষ্টিকর্ম যুগে যুগে সাহিত্য প্রেমী ও বিশ্বের নিপিড়িত মানুষের সংগ্রামের অনুপ্রেরণার ইন্ধন হিসেবে কাজ করবে। তাঁর সাহিত্যকর্ম ১৯০২ সাল থেকে ১৯০৬ সাল পর্যন্ত পর পর পাঁচ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনিত হয়, এবং ১৯০১, ১৯০২ ও ১৯১০ সালে তিনি নোবেল পিস পুরস্কারের জন্য মনোনিত হন। কিন্তু তিনি কোন পুরস্কারই পান নি। আসলে ধর্মের ধ্বজাধারী আর ব্যক্তি পুঁজির ম্যানেজাররা তলস্তয়ের মত মহান মানবতাবাদী আর বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণার উৎসকে কি ভাবে নোবেল প্রাইজে ভুষিত করবে? তাইতো নোবেল প্রাইজ আজ একটা “কর্তাভজা” পুরস্কারে পরিণত হয়েছে।

##

সেবার ১৮৫৯ সালের হেমন্তের শুরুতে ইয়েস্নায়া পলিয়েনা (তলস্তয়ের নিজ গ্রাম) গ্রামে একটা খবর ছড়িয়ে পড়লো, খবরটি হ’ল লেভ নিকোলায়েভিস না-কি গ্রামে একটা স্কুল খুলতে যাচ্ছেন, যে স্কুলে গ্রামের প্রজাদের সব শিশুরাই পড়তে পারবে যারা ইচ্ছুক। আর উত্তেজনার খোরাক হ’ল যে খবরটি তা হ’ল এই স্কুলে পড়তে কোন খরচ লাগবে না।

আমার পরিস্কার মনে আছে যে এ সংবাদে পুরো গ্রামে কি ভিশন উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিলো। গ্রামের লোকেরা ছোট ছোট দলে জড়ো হয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক জুড়ে দিলো আর যার যার মতো করে মন্তব্য করতে লাগলো।

কেউ বলছে কিভাবে সম্ভব, তো কেউ বলছে কেনইবা, আবার কারো কারো মন্তব্য নিশ্চই এর পিছনে কোন ফন্দি থাকাও বিচিত্র নয়, কারণ একটা ফ্রি স্কুল খোলা কোন ছোটখাটো খরচের বিষয় নয়,  যেখানে পঞ্চাশ জন বা তারও অধিক শিশু পড়তে পারবে বলে বলা হচ্ছে! এক কথায় পুরো গ্রামের মানুষদের ঘুম হারাম হওয়ার যোগাড় উত্তেজনায়।

এরই মধ্যে এক মঙ্গলবার ছুটির দিনে আমরা সবাই হাজির হ’লাম লেভ নিকোলায়েভিচ তলস্তয়ের বাড়িতে। আমরা যখন দলবেধে উপস্থিত হয়েছি ঠিক সেই মূহুর্তে আমাদের ভবিষ্যৎ শিক্ষক কাউন্ট (সবচেয়ে বড় জমিদারদের উপাধি) তলস্তয় বাড়ির পোর্চে হাজির হলেন। তাকে দেখে উপস্থিত সবাই টুপি খুলে কুজো হয়ে কুর্ণিশ করলো।

শুভদিন, আপনারা কি আপনাদের বাচ্চাদের নিয়ে এসেছেন? লেভ নিকোলায়েভিচ অভিভাবকদের সম্বোধন করে জানতে চাইলেন। হ্যা মহাত্মন, মহান কাউন্ট, গ্রামের বৃদ্ধরা উত্তর দিলো এবং কুঁজো হয়ে আবার কুর্ণিশ করলো।

“চমৎকার, আমি শুনে খুব খুশি হলাম।” মুখে হাসি নিয়ে তিনি উপস্থিত ভিড়ের দিকে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন। খুব দ্রুত তাঁর চোখ ভিড়ের ভিতর সবচেয়ে ছোট্ট শিশুটি যে তার মা-বাবার পিছনে একটু লুকিয়ে দাড়ানো তাকে খুঁজে নিলো এবং হালকা পায়ে ভিড় ঠেলে ঠিক ভিড়ের মাঝখানে উপস্থিত হলেন।

তার মানে তুমিও স্কুলে পড়তে চাচ্ছো? লুকিয়ে থাকা শিশুটিকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন। শিশুটি কাপা কাপা গলায় বললো হ্যা। কি নাম তোমার? দানিলকা। তোমার পারিবারিক নাম? কোজলোভ। তুমিও এখন পড়তে যাচ্ছে? তিনি একে একে সব শিশুদের কাছে গেলেন। তোমার নাম ? ইগনাত মাখারোভ। তোমার ? তারাসকা ফোকানোভ। তিনি ঘুওে তাকাতে তাকাতে আমার বোনের দিকে চোখ স্থির করলেন। হ্যাল্লো! তুমিও পড়তে এসেছো, কাউন্ট সোল্লাসে বলে উঠলেন। তোমার স্কুল পছন্দ? সবাই দেখ এই ছোট্ট মেয়েটাও এসেছে। আমরা সবাই পড়তে যাচ্ছি। না, আমি পড়তে আসিনি, আমি শুধু … .. ওর মুখটা লাল হয়ে উঠলো আর পরক্ষণেই সে ফুপিয়ে কেঁদে ফেললো।

এবার কাউন্ট আমার দিকে ফিরলেন। হ্যা তুমি, তুমিও স্কুওে পড়তে চাও ? আমি মাথা নেড়ে খুব সন্ত্রস্তভাবে এ্যাস্পেন পাতার মত কাপতে কাপতে বললাম হ্যা। কি নাম তোমার ? ভাশকা। তোমার পারিবারিক নাম জানো না?   আমার ডাক নাম বলা তাঁর পছন্দ হয় নি এবং আমার মনে হ’ল তিনি আমার দিকে এমন ভাবে তাকালেন যেন নোংরা ছেড়া পোশাক পরা (র‌্যাগামাফিন) কোন বালককে দেখছেন। আমি বললাম অবশ্যই জানি। কি সেটা ? মরোজোভ। তিনি বললেন চমৎকার! তোমাকে আমার মনে থাকবে ভাসকা মরোজোভ। তিনি হাসলেন। তার মুখে এখন অনুমোদনের ছাপ বলে আমার মনে হ’ল। আমার আরও মনে হ’ল তাঁকে আগে আমি কোথাও দেখেছিলাম।

চলো মরোজোভ, মাকারোভ, কজলোভ, তোমরা সবাই আমার সাথে চলো। বাকি সব অভিভাবকদের বললেন- আপনারা সবাই বাড়ি চলে যান, ঈশ্বরের কৃপা আপনাদের সাথে আছে। আমি এখন আমার ভবিষ্যৎ ছাত্রদের তাদের স্কুল দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি। আর ও- হ্যা, আরো শিশুদের পাঠাবেন। ছোট মেয়েদেরও। আমরা সবাই পড়তে যাবো, যেন কেউ বাদ না যায়।

দেখতে দেখতে স্কুলে আমাদের এক সপ্তাহ কেটে গেল। তার পর আরও এক সপ্তাহ, আর এভাবে পুরো একটা মাস। আমরা স্কুল নিয়ে এতই মেতে ছিলাম যে কখন হেমন্ত শেষ হয়ে গেল আমরা বুঝতেও পারিনি। আর এখন শীতকাল। দিন দিন স্কুলকে আমাদের নিজেদের বাড়ির মত মনে হতে লাগলো, আর আমরা লেভ নিকোলায়েভিচ’র সাথে সম্পূর্ণ মিশেযেতে থাকলাম।

একদিন তিনি আমাদের সবাইকে ডেকে বললেন, তোমরা কখনও আমাকে মহাত্মা, মহত্মন, কাউন্ট বলে ডাকবে না, আমার নাম লেভ নিকোলায়েভিচ, এবং তোমরা আমাকে আমার নাম ধরে ডাকবে। এর পর থেকে আমরা তাঁকে আর কখনও মহাত্মা-মহত্মন- কাউন্ট বলে ডাকিনি।

স্কুলে আমাদের তিনমাস কেটে গেল পড়া-লেখায় ডুবে থেকে। আমাদের অন্য কিছুতে খেয়াল থাকতো না। এ সময় আমরা বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতাম। আস্তে আস্তে স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাইস থেকে বেড়ে হযে গেল সত্তুর।

স্কুল চলাকালে পুরো সত্তুরজনই নিকোলায়েভিচকে ছোঁ মেরে নিজের কাছে নিতে চায়। কেউ তাঁকে প্রশ্ন করছে তো আর একজন খাতা দেখাতে মরিয়া। লেভ নিকোলায়েভিচ এাঁ কি ঠিক হয়েছে ? তিনি খাতা দেখে বলেন, হ্যা, এটা ঠিক আছে শুধু মাঝখান থেকে কয়েকটা শব্দ বাদ পড়েছে, তা ছাড়া চমৎকার। এতো তাড়াহুড়ো করো না। আর আমারটা কেমন হয়েছে- আমি কি ঠিক লিখেছি নিকোলায়েভিচ ? ঠিক তখনই আর একজন তার খাতা নিকোলায়েভিচ’র নাকের সামনে মেলে ধরে, আর এভাবে একজন একজন করে প্রায় সবাই চিৎকার-চেচামেচিকরে তাঁকে ছেঁকে ধরে তাঁর মনোযোগ আকর্ষণে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তিনি গভীর মনোযোগের সাথে আমাদের খাতাগুলি নিরিক্ষণ করেন এবং মাঝে মাঝে মন্তব্য করেন, যেমন- এটা তোমাকে অবার লিখতে হবে। তুমি আবার অনেক কিছু বাদ দিয়েছো।

হঠাৎ পাশের রুম অর্থাৎ তৃতীয় শ্রেণী থেকে একটা ভুল উচ্চারণ শোনা গেল। একজনকে বার বার বানান করতে বলা হয়েছিলো “ডি আর এ” (ড্রা)। সে “আর” বাদ দিয়ে পড়ছিলো। নিকোলায়েভিচ খুব দ্রুত বলে উঠলেন না না তুমি ভুল পড়ছো। তিনি যে খাতাগুলি দেখছিলেন সেগুলি রেখে দিলেন। দ্রুত তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে বললেন- না না এভাবে কখনও পড়বে না। তিনি শব্দটি বানান করলেন ‘ডি আর এ’ এবং জানতে চাইলেন উচ্চারণটা কি হবে ? আমরা সবাই একসুরে চিৎকার করে বলে উঠলাম- “ড্রা”।

আমরা যখন নিকোলায়েভিচ’র বাড়িতে পড়তে যেতাম তখন পুরো বাড়িটা ভেড়ার চামড়ার এক ধরনের গন্ধে ভরে যেত, কারণ গ্রামের অধিকাংশ ছেলেমেয়েরা ভেড়ার চামড়ার (Sheepskin) পোশাক পরতো। আমাদের শিক্ষক ছিলেন নিকোলায়েভিচ ছাড়াও তাঁর দুই ছেলে-মেয়ে ও এক জ্ঞাতি সম্পর্কিত ভাই।

আমাদের পড়া যখন শুরু হ’ত তখন একধরনের মজার পরিবেশ আর চিৎকার-চেচামেচিতে বাড়ি ভরে উঠতো। এখানে আমাদের ছিলো ইচ্ছামত সবকিছু করার অবাধ স্বাধীনতা। পড়ার সময় আমরা কোন প্রশ্নের উত্তর দিতাম একসুরে চিৎকার করে, আবার কোন একটা পড়া একসাথে সবাই চিৎকার করে পড়তাম।

কোন একটা প্রশ্নের উত্তর বই’র মত হুবহু না বলে নিজের মত করে বলতে পারলে নিকোলায়েভিচ ভিশন খুশি হতেন। তিনি চাইতেন ছাত্ররা সবাই নিজের মত করে বলতে এবং লিখতে শিখুক।

একবার পাশের রুমের একটি ছেলে পালাতে চেষ্টা করতেই নিকোলায়েভিচ তাকে থামিয়ে জানতে চাইলেন কি ব্যাপার ? ছেলেটি ধরা পড়ে যেয়ে একখন্ড চক কামড়াতে লাগলো। নিকোলায়েভিচ হেসে দিয়ে বললেন- এখনও দাড়িয়ে আছিস পালা! ছেলেটি হতভম্ব হয়ে দে দৌড়!

নিকোলায়েভিচ’র গভীর আগ্রহ আর উৎসাহ আমাদের সকলের মধ্যে ভিশন উদ্দিপনার সৃষ্টি করলো যার ফর হ’ল প্রতিদিনই আমাদের সক্ষমতা বাড়তে লাগলো।

দুপুরবেলা আমাদের লান্স দেওয়া হতো। এটা ছিলো খেলাধুলা আর মজা করারও সময়। খাওয়ার পর একটু হাওয়া খেতে বেড়াতে যেতে কেম লাগে? নিকোলায়েভিচ জানতে চান এবং বলেন ‘আমার কিন্তু এটা ভিশন পছন্দ। ঠিক আছে, দেখাযাক কে সবার আগে বাইরে যেতে পারে। ওমনি আমরা একসাথে চিৎকার আর হল্লা করতে করতে তাঁর পিছনে পিছনে সিঁড়ি দিয়ে লাগালাম ছুট। নিকোলায়েভিচ একসাতে চারটা করে সিঁড়ি টপকে সবার অনেক আগেই পৌঁছে গেলেন। আমরাও তাঁর থেকে খুব একটা পিছনে পড়লাম না। নিকোলায়েভিচ যে বাড়িতে বাস করেন তার কাছে এসে বললেন, আমি খুব দ্রুতই আসছি বলে বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন। আমরা তখন বাড়ির বাগানের ভিতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে হারিয়ে গেলাম খেলায় মত্ত হয়ে। শিঘ্রই নিকোলায়েভিচ ফিরে এলেন। আমরা তখন বিচিত্র সব খেলা, গোলমাল, চিৎকার আর দৌড়াদৌড়িতে ব্যাস্ত। কেউ একজনকে আছাড় দিয়ে বরফের উপর ফেলে দিচ্ছে তো কেউ বরফের গোল্লা বানিয়ে ছুড়ে বরফ দিয়ে লেপ্টে দিচ্ছে, যেন খেলা তো নয় খেলার যুদ্ধ শুরু হযেছে।

নিকোলায়েভিচ সবাইকে ডেকে বললেন, ‘আমার কাছে এসো।’ আমরা কাছে যেতেই বললেন- কে আমাকে মাটিতে আছড়ে ফেলতে পারবে ? ব্যাস, প্রথমে আমরা তাকে ঘিরে ধরলাম। এর পর সামনে এবং পিছন থেকে আকড়ে ধরলাম, পেচিয়ে ধরে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করলাম, তাঁর গায়ে বরফের বল ছুড়ে মারতে থাকলাম, কেউ তাঁর গায়ের উপর লাফিয়ে উঠলো, কেউ কেউ তাঁর পিছন দিক দিয়ে বেয়ে ঘাড়ে উঠে গেল। এভাবে সব রকম উপায়ে আমরা তাঁকে ভূপাতিত করার চেষ্টা করলাম কিন্তু আমাদের সকল আক্রমণ ব্যার্থ হ’ল। আমাদের আক্রমণের তুলনায় তাঁর প্রতিরোধ ছিলো অনেক শক্ত, এবং নিকোলায়েভিচ একটা শক্তিশালী ষাড়ের মত আমাদের তাঁর ঘাড়ে তুলে নিলেন। শেষমেশ তিনি আমাদের নিয়ে ভূপাতিত হলেন, সম্ভবত ইচ্ছে করেই। সাথে সাথে আমরা নানা সুরে গান গেয়ে উঠে তাঁকে যুদ্ধের আহবান জানালাম। আমরা দ্রুত তাঁকে বরপ দিযে ঢেকে দিতে লাগলাম আর দলবেধে তাঁর উপর লাফিয়ে পড়লাম এবং চিৎকার কওে সঙ্গিদের বলতে লাগলাম ওকে আরো বরফ দিয়ে ঢেকে দাও ঢেকে দাও!

“ঘন্টাগুলো মিনিটের মত কেটে গেল! জীবন যখন নির্মল আনন্দে ভরে ওঠে সময় তখন হাওয়ার বেগে চলে যায়।”

এরকম আনন্দঘন পরিবেশে আমাদেও পড়াশোনার আগ্রহ বেড়ে গেল যা আমাদের দ্রুত সবকিছু বুঝতে খুবই সহায়ক হ’ত, আর আমরা নিকোলায়েভিচ’র খুব অন্তরঙ্গ হয়ে উঠলাম। এর ফলে তিনি যখন বাইরে থাকতেন তখন আমরা তার অভাব তিব্রভাবে অনুভব করতাম। তাকে ছাড়া আমাদের স্বাভাবিক জীবন যেন হঠাৎ থমকে যেত। একই ভাবে তিনিও আমাদের কাছে না পেলে রিতিমত কষ্ট পেতেন। এভাবে আমারা এক সময় পরস্পরের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠলাম। আমরা শুধু রাতের বেলা তাঁকে ছেড়ে যেতাম।

দিনের বেলা আমরা একসাথে স্কুলে থাকতাম। বিকাল বেলা আমরা একসাথে খেলাধুলা করতাম, আর তার পর তাঁর বাড়ির বারান্দায় বসে আমরা গল্প করতাম প্রায় মাঝরাত অবধি।

এই চমৎকার দিনগুলির একটি সন্ধ্যা আমার বিশেষ ভাবে মনে আছে। দিনটি ছিলো ছুটির দিন, তবে কিসের ছুটি সেটা আমার ঠিক মনে নেই। সময়টা ছিলো আগস্টের শেষ দিকে, কারণ তখন ফসল তোলা চলছিলো। আমাদের স্কুলে যারা সবচেয়ে বড় তারা সবাই উপস্থিত ছিলো। আমরা নিকোলায়েভিচ’র সাথে গল্প করছিলাম, মজা করে সময় কাটছিলো, আবার আলাপচারিতা মাঝে মাঝে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মোড় নিচ্ছিলো যা সকলের বিশেষ মনোযোগ দাবি করছিলো আর অমাদের চিন্তা করতে বাধ্য করছিলো। নিকোলায়েভিচ আমাদের যুদ্ধের (ক্রিমিয়ার যুদ্ধ) কথা বলছিলেন, যে যুদ্ধের একজন অফিসার ছিলেন তিনি। তিনি যুদ্ধের দৃশ্যপট বর্ণনা করছিলেন- তিনি বলছিলেন মৃতদের কথা, আহতদের কথা, যারা অসুস্থ্য তাদের কথা, ডাক্তার একজনের পা কেটে বাদ দিচ্ছিলেন তো আর একজনের হাত সেলাই করে জোড়া লাগালেন, আবার একজনের একটা আহত চোখ তুলে ফেললেন। আমাদের মত কিশোরদের পক্ষে যুদ্ধের এই ভয়াবহ জীবন্ত ধারাভাষ্য শোনা ছিলো সহ্যের অতিত, যা আমাদের অন্তরে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছিলো।

এরকম একটা থমথমে পরিবেশে হঠাৎ নিকোরায়েভিচ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলে উঠলেন- এখন আমি আমার কিছু সিদ্ধান্ত তোমাদের বলতে চাই, তোমরা শুনবে ? আমরা এই থমধরা পরিবেশ থেকে মুক্তি চাচ্ছিলাম, সবাই একসঙ্গে বলেউঠলাম অবশ্যই আমরা শুনতে চাই।

এই হ’ল আমার সিদ্ধান্তগুলো, নিকোলায়েভিচ বলতে শুরু করলেন- “ আমি আমার সমস্ত জমিদারী, সম্পদ, আমার অভিজাত জীবনযাত্রা সব ত্যাগ করে একজন চাষির জীবন যাপন করতে চাই যে তার নিজের জন্য গ্রামের প্রান্তে একটা কুড়েঘর তেরী করবে। গ্রামের একজন সাধারণ মহিলাকে বিয়ে করবো এবং চাষিরা যে ভাবে চাষ করে, ফসল কাটাসহ অন্যান্য কাজ করে সে ভাবে সবকিছু করে জীবন নির্বাহ করতে চাই।”

একজন ভাড়াটে শ্রমিক হয়ে তুমি কি নিজেকে একটা হাসির পাত্র বানাতে চাও ? ইগনাত বলে উঠলো খানিকটা উপহাসের সুরে। “ ক্যানো ভাড়াটে শ্রমিক কেন ? আমি আমাদের নিজেদের জমিতে আমার এবং আমার পরিবারের জন্য কাজ করতে চাই।”

সে ক্ষেত্রে তুমি তোমার সম্পত্তি কি করবে ? আমরা প্রশ্ন করলাম। কোন সম্পত্তি ? জমিদারী ? আমরা এটাকে ভাগ করে ফেলবো। এটা হবে তোমাদের এবং আমাদের। এটা হবে আমাদের সকলের সম্পত্তি। সবার সমান।

আহ্, লোকে তোমাকে দেখে যদি উপহাস করে আর বলে ওই দেখ তলস্তয় যাচ্ছে যার সব ধনসম্পত্তি সে খুইয়েছে। এক সময় সে ছিলো আমাদের প্রভু, কিন্তু এখন দেউলিয়া হয়ে এমন গরীব হয়ে গেছে যে নিজের সব কাজ এখন তার নিজেকেই করতে হয়। এরকম হলে তোমার লজ্জা করবে না ? আমরা প্রশ্ন করলাম।

নিকোলায়েভিচ খানিকটা সময় নিয়ে এমন ভাবে উত্তর দিলেন যে মনে হ’ল আমরা সবাই বয়স্ক মানুষ। তিনি বললেন, লজ্জা বলতে তোমরা কি বোঝাতে চাচ্ছো ? কোন মানুষ যদি তার নিজের কাজ নিজে করে তবে তার ভিতর লজ্জার কি আছে ? তোমাদে পিতারা কি কখনও তোমাদের বলেছে যে তারা প্রতিদিন ক্ষেত-খামারে যে কাজ করে তার জন্য তারা লজ্জিত ? তারা বলে নি। একটা মানুষ যদি তার এবং তার পরিবারের খাদ্য যোগাতে কঠোর ঘাম ঝরানো পরিশ্রম করে তবে সে লজ্জিত হবে কেন ? যদি আমাকে দেখে কেউ উপহাস করে তবে সেটা হবে এর বিপরীত কারণে, আমার কাজ না করার কারণে।

আমি যা বলতে চাই তা হ’ল – একটা মানুষকে তার পরিশ্রমের জন্য উপহাস করার কোন হেতু নেই, কিন্তু কোন মানুষের কাজ না করা এবং কাজ না করে অন্যদের চেয়ে ভালো থাকার মধ্যে আছে বিস্তর লজ্জা আর অসম্মান। এ কারণেই আমি লজ্জিত। আমি খাই, পান করি, ঘোড়ায় চড়ি, পিয়ানো বাজাই, আর এসব করতে করতে আমার জীবন একঘেয়ে নিরানন্দময় হয়ে উঠেছে। তাই আমি আমার নিজেকে বরি “ তুমি কোন কাজ করো না।”

নিকোলায়েভিচ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ইগনাতের দিকে তাকালো, তারপর সবারপানে দৃষ্টিহেনে জানতে চাইলো- ঠিক আছে ইগনাত, তাহলে আমাদের সিদ্ধান্ত কি হবে ? আমাদের কাছে তাঁর এসকল প্রশ্ন ছিলো সম্পূর্ণ নতুন ধরনের বিষয়, অশ্রুতপূর্ব এবং হতবুদ্ধিকর।

খানিকটা বাচাল ইগনাতও বলার মত কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলো না। আমরা সবাই চুপ, ফাকা মাথায় কোন ভাবনাও আসছে না, মনে হচ্ছে এখানে কেউ নেই। নিকোলায়েভিচ’র এই বর্তমান ভাবনার কোন বাস্তব সম্মত উত্তর প্রদানের ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা শুধু একটা বিষয়ই বোঝার চেষ্টা করছি- নিকোলায়েভিচ যা বলছে তা-কি সত্যি না-কি আমাদের সাথে মজা করছেন। বিষয়টা এমন যে, একজন অভিজাত মানুষকে ধরে দিনমজুর বানিয়ে দেওয়া!

আমরা কথা বলার মত কিছু একটা খুঁজছিলাম। এই জটিল সমস্যা নিয়ে আমরা আলাপ করতে শুরু করলাম, কি করে নিকোলায়েভিচ’র নতুন জীবন শুরু করার মত একটা বিয়ের ব্যবস্থা করা যায়, কেমন করে তাঁর জন্য একটা ভালো বউ জোগাড় করা যায় যে কাজ করতে ভয় পাবে না। আমরা বললাম যদি আমাদের গ্রামে উপযুক্ত পাত্রি পাওয়া না যায় তবে পাশ্ববর্তী কাজনাচেয়েভকা অথবা বাবুরিনো গ্রামে খুঁজে দেখা যেতে পারে। আমরা শুনেছি গ্রামের লোকেরা বলে “ বিয়ে করার চেয়ে বিয়ে টিকিয়ে রাখাই কঠিন, কারণ বৌ তো আর ছেড়া জুতো নয় যে চাইলেই ছুড়ে ফেলে দেওয়া যায়।”

এইভাবে আমরা বর্তমান সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন যুতসই দিক নিয়ে আলাপ করতে লাগলাম। আমাদের আলাপ শুনে নিকোলায়েভিচ বসে বসে মিটিমিটি হাসতে হাসতে আমদের বললেন, গ্রামের লোকেরা আর কি কি বলে আবার একটু বলোতো, বলে মজাকরে হালকা ফোঁড়ন কাটেন। মুহুর্তে ভারী পরিবেশটা আমাদের জন্য আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।

একবার নিকোলায়েভিচ আমাকে তাঁর সাথে বেড়াতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি মানসিক স্বাস্থ্য উদ্ধাওে ‘সামারা’ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলিন। আমার বন্ধু তাঁর ছাত্র চের্নভকেও আমন্ত্রণ জানালেন।

আমরা প্রথমে কাজান এবং সেখান থেকে সামারা গেলাম। এবার সামারা থেকে ঘোড়ারগাড়ী এবং ঘোড়ায় চড়ে যেতে হবে আরও একশ’ ভার্স্ট দূরে, ক্লান্তিকর এক যাত্রা। অবশেষে আমরা পৌঁছলাম। আমরা হাজির হ’লাম স্তেপ’র (রাশিয়ার শত শত মাইলব্যাপী তৃণভূমি) দূরতম কোন এক এলাকায়, যেখানে দৃস্টিসীমায় কোন গ্রাম এমন কি কোন জোপ-ঝাড়ও নেই! সামনে কিছু রুক্ষ্ম ফেল্ট’র তৈরী ইউর্তা দেখা গেল। আমরা এরকম একটার সামনেই থামলাম। আমরা যতদিন এখানে থাকবো এটাই হবে আমাদের আস্তানা।

ইউর্তাটি ছোট নয়,আমাদের চার জনের বসবাসের জন্য যথেষ্ট বড়। আমরা পৌঁছাতেই খুব দ্রুত দু’টি পুরাতন কার্পেট ও ফেল্ট’র তৈরী ম্যাট আনা হ’ল। কার্পেটগুলি ইউর্তার মাটির মেঝেয় বিছিয়ে দেওয়া হ’ল। ফেল্ট’র ম্যাটগুলি ব্যাবহৃত হবে নিকোলায়েভিচ’র বিছানার জন্য। আমাদেও বর্তমান বাড়িটি এখন বাইরে এবং ভেতরে দেখতে চমৎকার লাগছে। এটা ছিলো সবদিক দিয়ে বড় আকারের কুড়ের চেয়েও বড় কিন্তু গোলাকৃতির, যা তৈরী হয়েছে কাঠের ফ্রেমের উপর ফেল্ট’র ছাউনি দিয়ে। দুই সারি মুখোমুখি ইউর্তার মধ্যে আমাদেরটি ছিলো একটি।

আমরা স্তেপে আসার দুই সপ্তাহ পরে একদিন হঠাৎ আমাদের চারপাশে বাশকিরদের (বাশকির হ’ল রাশিয়ার স্তেপের বাসিন্দা, তুর্কি-মঙ্গল জাতির একটি গোত্র) আনাগোনা করতে দেখলাম। তারা বেশ বড় একটা দলই ছিলো। দ্রুত তারা তাদের ইউর্তাগুলি বানিয়ে ফেললো আমাদের কাছে কাছে।

নিকোলায়েভিচ যখন বাশকিরদের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলো তখন তাদের বৃদ্ধ-যুবক সবাই তাঁকে এমন ভাবে সম্মান জানাচ্ছিলো যেন তিনি তাদের দেবতা। তিনি তাদের বৃদ্ধদের সাথে ধর্ম, ঈশ্বর, আল্লাহ্ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় মেতে উঠলেন। আবার যুবকদের সাথে খেলাধুলা আর এমন গল্প-কৌতুক করতে লাগলেন যে হাসতে হাসতে তাদের দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। তিনি তাদের ঘর-গৃহস্থালীর কাজ সহ বিভিন্ন কাজে সহয়তা করতে লাগলেন। ফলে পুরো গোত্রটিই তাঁকে ভালোবাসার প্রতিযোগিতায মেতে উঠলো। আর এ অবস্থা চললো যতদিন আমরা সেখানে ছিলাম।

প্রত্যেক বাশকিরই তাঁর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে সহাস্যবদনে কূর্ণিশ করতো। এমনকি চার-পাঁচ বছরের ছোট ছোট শিশুরাও নিকোলায়েভিচকে দেখলে চিৎকার করে ওঠে- “ কিনিয়াস তুল” অর্থাৎ প্রিন্স অব তুলা!” (লেভ তলস্তয়’র বাড়ি ছিলো রাশিয়ার তুলা রিজিয়নে, আর তিনি ছিলেন ওই অঞ্চলের প্রিন্স এবং কাউন্ট) বলে।

 

মুল: ভি, এস, মরোজভ

ভাষান্তর: শামিম আশরাফ শেলী

 

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *