অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচিত সরকার হলেই গণতন্ত্র হয় না

গণতন্ত্র হ’ল রাষ্ট্র পরিচালনার একটি রাজনৈতিক পন্থা। শুধু নিরপেক্ষ নির্বাচনেই তা সাধিত হয় না। সরকার পরিচালনার পদ্ধতি গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ দুর্নীতি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি, আর এ ব্যবস্থার সবচেয়ে দুর্বলতা হ’ল অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত জনগণ এবং দারিদ্র। এমন অবস্থায় সরকার পরিচালনায় পদ্ধতিগত ত্রুটি থাকলে গণতন্ত্র দুর্নীতিবাজ গণস্বার্থের বিরোধীদের হাতে ছিনতাই হয়ে যায়।

প্রাচীন গোষ্ঠি সমাজে সম্পত্তির অধিকার ছিল সকলের সমান। এক সময় গোষ্ঠিপতিদের দুর্নীতির কারণে সম্পত্তিসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে ভেঙ্গে যায় প্রাচীন সাম্যবাদি গোষ্ঠি সমাজ এবং গড়ে ওঠে প্রথম রাষ্ট্র, আর সেই রাষ্ট্র দুর্নীতির মাধ্যমে প্রাপ্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে স্বীকৃতি দেয় কারণ ব্যক্তিগত সম্পত্তিই রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে, অর্থাৎ সমাজের সকলের সম্পত্তি লুণ্ঠণ করে গুটিকয়েক মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তর হওয়াকে এই রাষ্ট্রই প্রথম স্বকিৃতি এবং নিরাপত্তা দিয়েছে। সেই থেকে দুর্নীতির সাথে রাষ্ট্রের গাটছড়া।

এর পরে যত ধরনের রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে তার সবই ছিল চরম দুর্নীতিপরায়ণ স্বেচ্ছাচারী এবং সাধারণ মানুষের সার্থের বিরোধী। গোষ্ঠি সমাজ ভেঙে যাওয়ার পর পর্যায়ক্রমে সমাজের সাধারণ মানুষেরা হয়ে পড়ে দাস, ভূমিদাস ও প্রজা, আর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে দাসমালিক রাষ্ট্র, সামন্ত রাষ্ট্র আর রজতন্ত্র, যার প্রত্যেকটিই ছিল চরম দুর্নীতিপরায়ণ আর স্বেচ্ছাচারী। সমাজের সাধারণ মানুষের এসকল রাষ্ট্রে কোন অধিকার ছিলনা শুধু অত্যাচারিত হওয়া ছাড়া।

এই সকল দাস-ভূমিদাস-প্রজা (সাধারণ মানুষের) দের হাজার হাজার বছরের অত্যাচার-অবিচার- অধিকারহীনতার অবসান ঘটে ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে। এই প্রথম সমাজের সাধারণ মানুষের পরিচয় হয় নাগরীক। আর স্বাধীন নাগরীকদের ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্র হিসেবে উত্থান ঘটে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের।

একটি রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণ, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তাদি গ্রহণের (এগুলি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাজ) বাইরে দাপ্তরিক কর্মকান্ড ও হিসাব নিকাশ রক্ষণাদির জন্য আমলাতন্ত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ আবশ্যিক যন্ত্র। আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রেরে উৎপত্তির মতই প্রাচীন। রাষ্ট্রেরে আবির্ভাবের সাথে সাথেই আবির্ভাব ঘটে আমলাতরন্ত্রর। একই ভাবে রাষ্ট্রেরে চরিত্র বা নীতির সাথে সাথে পরিবর্তন ঘটতে থাকে আমলার ক্ষমতা, তার মেয়াদ ও কর্মকান্ডের চরিত্র। যেমন রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলা হ’ল রাজার প্রতিনিধি. কারণ সে রাষ্ট্রে নাগরীক থাকে না থাকে প্রজা (রায়ত বা ভাড়াটে)। ফলে আমলাও নাগরীকদের সেবার জন্য নয় বরং রাজার সেবা, তার স্বেচ্ছাচারীতার সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ পায়। তাই যেখানে রাজা উপস্থিত থাকে না সেখানে তার আমলাই রাজ ক্ষমতাধর প্রতিনিধি। কিন্তু গণতাস্ত্রিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রের মালিক হ’ল সাধারণ জনগণ আর সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত আমলারা হলেন নাগরীকদের কর্মচারী, তার কর্মের মেয়াদও নির্দিষ্ট সরকারের (তার নিয়োগ দাতা) মেয়াদের সমান।

একটি রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হ’লে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রের সুনির্দিষ্ট সমন্বয় হ’তে হবে। এর একটি হ’ল জনগণের দ্বারা অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনে নির্বাচিত সরকার। আর দ্বিতীয়টি হ’ল সেই সরকারের নিয়োগকৃত নিজস্ব আমলা বাহিনী। এই আমলা বাহিনীর মেয়াদও হবে সেই সরকারের মেয়াদের সমান। আর এই আমলা বাহিনী তার নিজস্ব হতে হবে এই কারণে যে, সরকারের নির্বাচনী যে এজেন্ডা থাকবে সেটা বাস্তবায়নে যেন কোন স্যাবটাজ না হয়। আর গণতান্ত্রিক সরকার যেহেতু হবে দুর্নীতি মুক্ত দেশপ্রেমিক সরকার তাই দেশি-বিদেশী সার্থান্বেসী মহলের ষড়যন্ত্র থেকেও দেশ ও তার নিজস্ব সরকারকে বিশ্বস্ততার সাথে রক্ষা করবে। আর এই নিজস্ব আমলা বাহিনীর সকল কর্মকান্ডের দায় বহন করতে হবে তার নিয়োগদাতাকে। যেহেতেু একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে এই সকল আমলারা পরিণত হবে সকল প্রকার ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষে, তাই তার কর্ম মেয়াদে কোন অপকর্ম-দুর্নীতি করলে তাকে রক্ষা করার কেই থাকবে না। এটাই হ’ল গণতান্ত্রিক শাসন ব্যাবস্থার রক্ষা কবচ।

মনে রাখতে হবে ভারতবর্ষে বৃটিশরা রাজতন্ত্র  (কোম্পানীর মোড়কে এবং প্রত্যক্ষ রাজার অধিন) প্রতিষ্ঠিত করে ছিল যেখানে জনসাধারণ ছিল ‘প্রজা’ নাগরীক নয় , আর তাদের উপর রাজার স্বেচ্ছাচার প্রতিষ্ঠার জন্য বৃটিশ রাজা সৃষ্টি করেছিল ক্যাডার সার্ভিস অর্থাৎ ICS (ইম্পেরিয়াল সিভিল সার্ভিস), পরে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস। এই ক্যাডার সার্ভিসের লোকেরা ছিল চরম স্বেচ্ছাচারী ও অত্যাচারী গণশত্রু যা আজ ইতিহাস হয়ে আছে।

আর এরাই ভারতবর্ষের (বর্তমান ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান) সরকারী অফিস-আদালতে ঘুষ আমদানীর প্রতিষ্ঠাতা, যার জের এখনও চলছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক- ভারতবর্ষে ইংরেজ প্রশাসনের কর্মচারীদের আয়ের প্রধান উৎস ছিলো ঘুষ। বড় থেকে ছোট সকল কর্মচারীই ছিলো ঘুষ খোর। History of India’র লেখক আয়ারল্যান্ডের অধিবাসি দার্শনিক ও ঐতিহাসিক জেমস্ স্টুয়ার্ট মিল (অর্থনীতিবিদ জন স্টুয়ার্ট মিল’র পিতা) লিখেছেন, এ দেশে (ভারতে) ইংরেজরা ঘুষ গ্রহণের কৌশলটাকে প্রায় ‘চারুকলার’ পর্যায়ে উন্নিত করেছিলো। প্রত্যেক ক্ষেত্রে পদে পদে যখনই তারা ঘুষ নেওয়ার সুযোগ পেত তখনই তা বিনা দ্বিধায় ও নিঃসঙ্কোচে নিতো। তিনি এর বিস্তর উদাহরণ দিয়েছেন, যেমন- বর্ধমানের ডিসি (ডেপুটি কালেক্টর) জন ব্যাথো (john Batho) স্থানীয় জমিদারকে লবন ব্যবসায় অবৈধ সুযোগ-সুবিধা (২ বছরের জন্য) প্রদানের বিনিময়ে ঘুষ নেয় ২৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে সে নিজে রাখে ১৪ হাজার টাকা, আর ভাগা হিসেবে ১৪ হাজার টাকা প্রদান করে কোম্পানীর কাউন্সেলর চীফ জর্জ ভ্যান্সিটার্ট (৪১৪৮ টাকা) সহ অন্যান্য অফিসারদের। ঘুষের ভাগা সিস্টেম তখন থেকেই এদেশে চালু হয়েছে !

কিন্তু অদ্ভুত ভাবে রাজার প্রজাদের শাসন করার জন্য তৈরী ক্যাডার সার্ভিস কি করে স্বাধীন নাগরীকদের সরকার পরিচালনার জন্য এখনও বহাল আছে সেটাই আশ্চর্য! আর এসব ক্যারিক্যাচার সাধারণ নাগরীকরা যাতে বুঝতে না পারে সে কারণেই দুর্নীতি-লুটপাটের মহারথি রাজনীতিবিদ-আমলারা একসাথে বিশাল জনগোষ্ঠিকে শিক্ষা থেকে দূরে রেখেছে। যে কারণে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও কোটি কোটি মানুষ এখনও অশিক্ষিত, এটা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দুর্বলতা, যা উল্লিখিতদের ষড়যন্ত্র। অন্যদিকে গণতন্ত্র বিকাশে অন্যতম প্রতিবন্ধক দারিদ্র যা দুর্নীতি ও লুটতরাজের কারণে প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে শত উন্নয়নের গল্প দিয়েও যাকে চাপা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আমদানী করা হয়েছে মাথাপিছু আয়ের জুয়াচুরির গল্প!

বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত কোন সরকারই গণতন্ত্রের চর্চাতো করেইনি বরং তারা প্রত্যেকেই ছিল দুর্নীতিবাজ এবং জনগণের সম্পদ লুন্ঠনকারী। আর প্রত্যেকটি সরকার ছিল তার পূর্বের সরকারের চেয়ে অধিকতর দুর্নীতিবাজ ও লুটেরা। এখানে রাষ্ট্র পরিচালনায় কখনও নির্দিষ্ট সরকারের মেয়াদে আমলা নিয়োগ দেওয়া হয় নি। সরকার চলেগেলেও আমলা থেকে গেছে চিরস্থায়ী বন্দবস্তের মত। ফলে শেকড় গেড়েছে দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচার। এটা ইচ্ছাকৃত লুটপাটের তাগিদেই হয়েছে। এর ফলে ক্ষমতাসিন সরকার এবং আমলাতন্ত্র যৌথ প্রযোজনায় দুর্নীতি ও লুটপাটে মগ্ন। এই ভাবে এরা দুর্নীতি ও লুটতন্ত্রে চরম দক্ষতা অর্জন করে বাংলাদেশে লুটতন্ত্র কায়েম করেছে যার প্রধান ও অন্যতম দোসর হ’ল এদের আমলাতন্ত্র।

এরা কেউই বৃটিশ রাজার স্থায়ী আমলাতন্ত্র বাদ দিয়ে গণতান্ত্রি রাষ্ট্রের উপযোগী নিজস্ব আমলা বাহিনী নিয়োগ দেয় নি, যা কি-না বাধ্যতামূলক। কারণ তা হলে লুটপাট করা যাবে না এবং করলেও ক্ষমতা থেকে সরে গেলে ধরা খেতে হবে জেলে যেতে হবে। এদেশ থেকে হাজার কোটি লাখ কোটি টাকা লুট হয়েছে যার ভাগা পেয়েছে আমলারা। গত ১৫ বছরে সেই দুর্নীতি ও মহালুটের চূড়ান্তে পৌঁছয় শেখ হাসিনার সরকার, আর তাদের সেই দুর্নীতি-লুটপাটের সমান অংশিদার গত ১৫ বছরের আমলা বাহিনী।

শেখ হাসিনা পালিয়েছে। তার রাজনৈতিক সঙ্গিরা কেউ পালিছে কেউ ধরা পড়ছে কিন্তু তার আমলা সঙ্গিরা অদ্ভুদ ভাবে সব ধরাছোয়ার বাইরে বহাল তবিয়তে দাপটের সাথেইে ঘর-সংশার করছে। এরা কি সকল বিপ্লবের, ছাত্র-জনতার ক্ষমতার বাইরে?

যারা দুর্নীতি-লুটপাট করেছে, জনগণের সাথে স্বৈরাচারী আচরণ করেছে তাদের সকলকেই আইনের আওতায় আনতে হবে অন্যথায় রাষ্ট্রের সকল সংস্কার-উদ্যোগ কানাগলিতে পথ হারাবে আর এই লুটেরারা প্রথম সুযোগেই আবার জন-জাতির টুটি চেপে ধরবে।

বর্তমানের সকল রাষ্ট্রিয় সংস্কার উদ্যোগের প্রধান উদ্দেশ্য যদি হয় একটি সুন্দর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, তা হলে দু’টি বিষয় নিশ্চিৎ করতে হবে। এক. একটি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার। দুই. প্রচলিত বৃটিশ রাজা কর্তৃক সৃষ্ট জনসার্থ বিরোধী সর্বাঙ্গিন দুর্নীতিগ্রস্থ স্থায়ী আমলাতন্ত্র উচ্ছেদ করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উপযোগী সরকারের সমান মেয়াদী নিজস্ব আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। অন্যথায় সকল সংস্কারের পরিনতি হবে “গয়ং গচ্ছ।”

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *