ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা প্রবণতা, আইনের অপ্রতুলতা এবং সঠিক প্রয়োগ না হওয়া, জনসাধারণ তথা ভোক্তার সচেতনতার অভাব, সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যকার সমন্বয়হীনতা ও কর্মে অজুহাত এবং আইনের শাসনের অনুপস্থিতিসহ সামাজিক ও রাজনৈতিক নিস্ক্রিয়তার মতো বিষয়সমূহ ভোক্তার অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিতের পথে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আইনের কার্যকর প্রয়োগ, জবাবদিহিতা নিশ্চিত, বাজার তদারকি, সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনগুলোর নিয়মিত মিথস্ক্রিয়া, পারস্পরিক সহযোগিতা ও পণ্য সংক্রান্ত উন্মুক্ত ডিজিটাল তথ্য বাতায়ন ব্যবস্থা কার্যকর করার মধ্য দিয়ে এসব প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করা সম্ভব হলে ভোক্তাদের সতিক্যার অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে। জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাব, খুলনা জেলা কমিটি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব মতামত তুলে ধরেন।
গত মঙ্গলবার ৯ জুলাই বেলা ১১টায় খুলনা সার্কিট হাউজ সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এ আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার বিভাগের ডিডিএলজি (অতিরিক্ত কমিশনার রাজস্ব)মো: তবিবুর রহমান, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ক্যাব-খুলনা জেলা কমিটির সহ সভাপতি ডা. শেখ বাহারুল আলম, ও মোহাম্মদ সেলিম, উপপরিচালক, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়। সভার সভাপতিত্ব করেন মুকুল কুমার মৈত্র, এডিসি (রেভিনিউ), জেলা প্রশাসন, খুলনা। পুরো অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাব, খুলনা জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এম. নাজমুল আজম ডেভিড।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের ডিএলজিমো: তবিবুর রহমান বলেন, ‘ভোক্তা অধিকার এমন একটি বিষয়, যেটি নিয়ে আমাদের প্রত্যেক মুহূর্ত কাজ করতে হয়। আজকের সভায় অংশগ্রহণকারীরা নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। বিএসটিআই, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জাতীয়ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে।’ ভোক্তারা প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে বর্তমানে নানা ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের মানবাধিকার পর্যন্ত লঙ্ঘিত হচ্ছে, এ বিষয়েসভায় অংশগ্রহণকারীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে জনাব তবিবুর রহমান বলেন, ‘ভোক্তাদের অধিকার লঙ্ঘণের বিষয়টি নিয়ে অনেকেই হতাশা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এতটুকুও আশার আলো আছে যে, সরকার যেসব কর্মসূচী গ্রহণ করেছে, সেগুলোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা অনেক দূর এগিয়েও গিয়েছি। আমরা যে এগোয়নি, এটি বলা একেবারে অযৌক্তিক হবে।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ যেখানে ছিলো, আজ সেখানে নেই। আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। খুলনায় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অনেক ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ক্যাব এর দাবিসমূহ পূরণে ভোক্তা অধিদপ্তর অনস্বীকার্য ভূমিকা পালন করছে। এতে করে একেবারেই যে ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না, এটা আমরা মানতে রাজি নই। আমরা বিভিন্ন অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছি। আজকের এ আলোচনার মাধ্যমে আমাদের দপ্তরের যে পরিকাঠামো আছে, তা আরো বিকশিত হবে বলে আশা করি।’ তিনি তার বক্তব্যে আরো বলেন, ‘খাদ্যে ভেজাল ও ওজনে কম দেয়ার প্রবণতা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে নেই। কিন্তু আমাদের দেশে এ সমস্যা বিদ্যমান। উপযুক্ত মূল্যে, ভেজালমুক্ত ও যথাযথ মানে ভোক্তার কাছে নিরাপদ খাদ্য পৌঁছে দিতে পারলেই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। আর এজন্য জনসাধারণকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের সহযোগিতা ছাড়া উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ক্যাব খুলনা জেলা কমিটির সহ-সভাপতি ডা. শেখ বাহারুল আলম বলেন, ‘কোনো সংকটকে জিইয়ে রেখে সংকটের সমাধান খুঁজলে সংকট আরো দীর্ঘায়িত হয়। কিছু মানুষ বেশি সঞ্চিত হয়, বলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ বেশি বঞ্চিত হয়। ওই মানুষগুলোর সঞ্চিত যদি রাষ্ট্র বন্ধ করতে পারে, তাহলে আমাদের বঞ্চনা সয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা যাদের দ্বারা শোষিত হচ্ছি, তাদেরকে সমর্থন করে আমরা কাজ করছি। এতে করে কখনো সত্যিকারের পরিবর্তন সম্ভব নয়। মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গা থেকে আজকের এ সভায় যারা যোগদান করেছেন, তারা ভাববেন যে, আমার অলক্ষ্যে আমি যার দ্বারা শোষিত হচ্ছি, যে সিস্টেমের দ্বারা শোষিত হচ্ছি, তাকে আমরা অবলিলায় সমর্থন দিচ্ছি।’ ভোক্তার অধিকার সুরক্ষায় সরকারকেই প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘সবচেয়ে বড় সংগঠন সরকার। সরকার যদি তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে, তাহলে এধরনের আন্দোলনের প্রয়োজন আছে? সরকারের প্রতিটি পর্যায়ে যেভাবে অর্থ অপচয় করা হয়, সে টাকা আসে কোথা থেকে, এর উৎস কী, জনগণের টাকা কীভাবে ব্যবহার হয়, তা জবাবদিহিতা নেই কেনো? আমাদের কেনো এত খরচ করতে হবে। ৫০০ বেডের হাসপাতালে রোগী থারেক ১৬-১৭০০, এই রোগীদের অধিকার কে হরণ করলো? বাথরুমের পাশেও একজন রোগী জায়গা পান না।
বিভাগীয় পর্যায়ে একটি ভ্রাম্যমাণ ল্যাব এসেছে, এটি কতদিন সচল থ্কাবে? এর যান্ত্রিক ত্রæটি ধরা পড়লে কীভাবে সমাধান করা হবে, কে সমাধান করবে? কোটি কোটি টাকা মূল্যের অসংখ্য যন্ত্রপাতি খুলনা মেডিকেল কলেজ ও আবু নাসের হাসপাতালে পড়ে আছে? সারাই করার মতো কোনো লোক নেই। সাধারণ রোগীদের তাই বাধ্য হয়ে দানবীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে বাধ্য হয়। কে ঠেকাবে? বসুন্ধরার গ্যাস ছাড়া বাকি সব কোম্পানির গ্যাস নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি হয়, তাহলে বসুন্ধরা এ সুযোগ কীভাবে পেলো, কে বসুন্ধরাকে জবাবদিহি করবে। এ বিষয়গুলো ক্যাব এবং এ সম্পর্কিত মানুষজনকে গভীরভাবে ভাববে বলে আশা করি। ক্যাবকে কার্যকরভাবে এগিয়ে নিতে হলে আরো বিষদ ও যৌক্তিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, তাকেও সমান আইনি অধিকার দিতে হবে। আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ অভিযান পরিচালনা করতে পারে না। এটি ভোক্তা অধিকারের সঙ্গে সাঘর্ষিক। অভিযুক্তরও যাতে অধিকার সমুন্নত থাকে, সে বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, খুলনার উপপরিচালক জনাব মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ক্যাব-এর আন্দোলনের ফসল। ছাত্র জীবন থেকেই শুনে আসছি ক্যাব এর আন্দোলনের কথা। যাহোক, এখনো অসংখ্য অভিযোগ আছে যে, পণ্য বিক্রয়ের রসিদ এখনো কেউ দেয় না, এটা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমাদের যেমন দায়বদ্ধতা আছে, তেমনি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদেরও দায়িত্ব আছে। ১০ টাকা ৭০ পয়সায় ডিম কিনে সেই ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪ টাকায়। এমতাবস্থায় আমি যখন ক্রয় রসিদ চাই, ব্যবসায়ী দেখাতে পারলো না।’ অন্যদিকে, ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণ হয় মোবাইলের এসএমস বা কলের মাধ্যমে। এটা খুবই ভয়ঙ্কর একটি ব্যাপার। সাধারণ ক্রেতা যদি সাধ্যের মধ্যে বাজার না করতে পারে, তাহলে তো সে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হলো। দ্রব্যমূল্য নিয়ে সবার মধ্যে নাভিশ্বাস চরমে পৌঁছেছে। এসময় প্রতিটি পণ্যের দাম ইচ্ছছমতো বাড়ালে ভোক্তা যাবে কোথায়! এজন্য আমাদের অধিদপ্তর প্রতিদিন বিভিন্ন সংগঠনের সাথে প্রতিদিন আলোচনা করছি, অভিযান পরিচালনা করছি। সবাইকে বোঝাচ্ছি। এর ফলে কিছু বিষয় অন্তত নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তারপরও আমরা আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা চালিয়ে যাবো। ক্যাব খুলনা সবসময় আমাদের সহায়তা করেছ এর ফলে বাজারে তার ইতিবাচক প্রভাব বজায় রয়েছে। তবে আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সব পক্ষ ইতিবাচকভাবে ছাড় দিতে হবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেও অনেক বিষয়ের সমাধান করা যায়। আমাদের জনবল সংকটও রয়েছে। যা উর্দ্ধতন মহলে জানানো হয়েছে, এরই মধ্যে যা কার্যকর শুরু হয়েছে।’
আলোচনা সভার সভাপতি মুকুল কুমার মৈত্র এডিসি (রেভিনিউ), জেলা প্রশাসন, খুলনা তার বক্তব্যে বলেন, ‘সভায় উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি এরকম একটি মহতি উদ্যোগে সামিল হওয়ার জন্য। সবাই তাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদান করেছেন। আসলে নির্ধারিত কাজের বাইরে আমরা নিজেরাও ভোক্তা। সেবা ক্রয় করার সময় আমরা দেখছি, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা বড় একটি চ্যালেঞ্জ। এ অনুষ্ঠানে কৃষি বিপণন অফিসার আছেন। আমাদের যে কৃষক ভাই আজকে বাজারে যে কাঁচা সব্জি নিয়ে এসেছে, তিনি কি গতকাল কোনো কেমিক্যাল সেই পণ্যটিতে মিশ্রণ করেছেন কিনা, এটি কিন্তু আমরা জানি না। এ বিষয়টি তদারকি প্রয়োজন। পাশাপাশি পণ্যের গুণগত মান বজায় না রাখতে পারলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সবখানে। দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রে অভিযোগ রয়েছে, তৃণমূল পর্যায়ে একটি সব্জির দাম ১০ টাকা হলে তা নিকটবর্তী শহর কিংবা ঢাকাতে গেলে ৪০-৫০ টাকা হয়ে যায়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এই অযৌক্তিক প্রক্রিয়াটি বন্ধ করতে আমাদের কাজ করতে হবে। সরকারের প্রতিটি বিভাগ তার স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করে। পাশাপাশি ক্যাব এর পক্ষ থেকে যারা কাজ করছে, তাদেরকে আরো সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। কৃষিসমৃদ্ধ ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক থেকে শুরু করে সর্বস্তরের লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা ও প্রযুক্তিগত সরবরাহ নিশ্চিত করে সঠিক মূল্যে পণ্য পৌঁছে দেয়া নিশ্চিত করতে হবে।’
কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাব, খুলনা জেলা কমিটি আয়োজিত বিভাগীয় পর্যায়ের এ আলোচনা সভায় অন্যান্যদের মধ্যে অংশগ্রহণ করেছেন কাজী হাফিজুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক, ক্যাব, নড়াইল, পারভীন আক্তার, সাধারণ সম্পাদক, ক্যাব, সাতক্ষীরা, জহুর আহমেদ, সভাপতি, ক্যাব, যশোর, শরিফা খাতুন, সাধারণ সম্পাদক, ক্যাব, ঝিনাইদহ, বাবুল সরদার, সভাপতি, ক্যাব, বাগেরহাট, কামরুজ্জামান, সহ-সম্পাদক, ক্যাব, বাগেরহাট, অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার, সমন্বয়কারী, বাপা, খুলনা, মোহাম্মদ আবুল হাসান, পরিচালক, খুলনা চেম্বার অব কমার্স, মো: মোকলেছুর রহমান, জেলা নিরাপদ খাদ্য অফিসার, সাইফুন্নাহার, সহকারী কমিশনার, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, মো: আলাউদ্দিন হুসাইন, উপপরিচালক, বিএসটিআই, মো: ওমর ফারুক, মহাসচিব, বাংলাদেশ রেস্তোরা মালিক সমিতি, খুলনা, মো: সোহাগ দেওয়ান, সাধারণ সম্পাদক খুলনা বড় বাজার ব্যবসায়ী মালিক সমিতি প্রমুখ এবং জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীবৃন্দ।
by
সর্বশেষ মন্তব্যসমূহ