আঁখ পরিচিতিঃ বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য একটি অর্থকরী ফসলের বাংলা নাম আঁখ আর ইংরেজি হল sugercan যার বৈজ্ঞানিক নাম saccaram এটি graminae পরিবার ভূক্ত ও ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ। বাংলাদেশে ১.৮০ লাখ হেক্টর জমিতে আঁখ চাষ হয়। বাংলাদেশে আখেঁর হেক্টর প্রতি ফলন ৪৩ মেট্রিক টন। যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। ভারতে আখেঁর হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ৫৬.৫৭ মেট্রিক টন। ইন্দোনেশিয়ায় ১২৩.৫০ মেট্রিক টন এবং তাইওয়ানে ১০১.৬১ মে. টন। তবে বাংলাদেশে প্রতি হেক্টর জমিতে ২০০-৩০০ মে. টন আঁখ উৎপাদন ক্ষমতা ও সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক চাষীর জমিতে ২৪৭ মে. টন আঁখ উৎপাদনের রেকর্ড রয়েছে। অতএব, আঁখ আবাদে ফলন বাড়াতে অনুমোদিত জাত ও প্রযুক্তি অনুসরণের বিকল্প নেই।
বীজখন্ড তৈরীঃ বীজ আখ কাটার পরে পাতা না ছাড়িয়েই পরিবহন করা প্রয়োজন। ধারালো এবং জীবানুমুক্ত দা বা হাসুয়া দিয়ে বীজখন্ড তৈরী করতে হবে। দা পুড়িয়ে বা ডেটল দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। বীজগুলো প্রয়োজনমত এক, দুই বা তিন চোখবিশিষ্ট খন্ডে তৈরী করতে হবে। যে ক্ষেতেআঁখ রোপন করা হবে তার পাশেই বীজখন্ড তৈরী করতে হবে। আঁখের গিরার উপরে ১ ইঞ্চি এবং নিচে ২-২.৫০ ইঞ্চি রেখে বীজখন্ড কাটতে হবে। একটি আঁখ থেকে সাধারণত ৮-৯ টি দু’চোখ বিশিষ্ট বীজখন্ডপাওয়া যায়।
জমিতে বীজ খন্ড লাগানোর নিয়মঃ
খাদের আকারঃ প্রস্থ ২৫ সে.মি, গভীরতা ২৫ সে.মি এবং দৈর্ঘ জমির দৈর্ঘের উপর নির্ভর করবে।
আঁখের মারাত্মক ক্ষতিকর রোগ সমূহঃ
লাল পচা রোগঃ লক্ষণ-এই রোগের আক্রমণে প্রধানত আখের কান্ড পচে যায়। অবশ্য পাতাও আক্রান্ত হতে পারে। কান্ডের গায়ে অবস্থিত পাতার গোড়া, বৃদ্ধিজনিত ফাটল কিংবা ক্ষতের মধ্যদিয়ে এ রোগের জীবাণু গাছের ভিতর প্রবেশ করে। যে অংশে জীবাণু প্রবেশ করে সেখানে অবস্থিত কোষগুলো দ্রুত লাল রং ধারণ করে পচতে শুরুকরে। রোগের এ পর্যায়ে বাহ্যিক কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় না। অনুকুল পরিবেশে সমস্ত কান্ড পচে যেতে পারে। এই অবস্থায় আঁখের পাতাগুলো হলুদ হয়ে আস্তেআস্তেমরে যায়। আক্রান্ত আখ লম্বালম্বিভাবে কাটা হলে দেখা যায় যে, কোষগুলো পচে লাল রং ধারণ করেছে। লাল রং এর মধ্যে আড়াআড়িভাবে ছোপ ছোপ সাদা অংশ দ্বারা বিভক্ত দেখা যায়।
স্মাট রোগঃ আক্রান্ত আঁখের পত্রগুচ্ছের মধ্য হতে চাবুকের মত একটি কয়েক ফুট লম্বা কালো শীষের উৎপত্তি হয়। চাবুকের সর্বোচ্চ অংশ বাঁকানো হতে পারে। প্রথমদিকে কালো শীষটি পাতলা রুপালি ঝিল্লিবা পর্দা দ্বারা আবৃত থাকে। পর্দার ভিতরে কালো ঝুলকালিরমত বস্তুগুলো স্মাট রোগের লক্ষলক্ষজীবাণু। এক পর্যায়ে রুপালি পর্দা ফেটে যায় এবং শীষ থেকে অসংখ্য জীবাণু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। স্মাট আক্রান্ত ঝাড়ে সুস্থ গাছের চেয়ে কুশির সংখ্যা অনেক বেশী হয় এবং ঘাষেরমত মনেহয়।
উইল্ট রোগঃ লক্ষণ প্রায় লাল পচা রোগের অনুরুপ। আক্রান্ত গাছের পাতা গুলো আস্তেআস্তেহলুদ হয়ে মরে যায়। আক্রান্তগাছ লম্বালম্বি কাটলে ভিতরের কোষসমূহ বেগুনি অথবা লাল রং ধারণ করেছে বলে মনেহবে। ভিতরের মজ্জার কোষগুলো শুকিয়ে যেতে থাকে এবং ফাঁপা খোলেরমত এলাকার সৃষ্টি হয়। চার-পাঁচ মাস বয়সে রোগের আক্রমন হলেও বয়স্ক আঁখ ছাড়া বাহ্যিক লক্ষণ সুস্পষ্ট হয়না।
আঁখের রোগ দমন পদ্ধতিঃ আঁখের উপরোক্ত রোগ সমূহ দমনের জন্য নিম্নের পদ্ধতি সমূহের এক বা একাধিক ব্যবস্থা সমন্বিতভাবে নিতে হবে।
বীজ আঁখ শোধনঃ আঁখ লাগানোর পূর্বে বীজ খন্ড গুলোকে ০.১% ব্যাভিস্টিন দ্রবণে (পানি ও ব্যাভিস্টিনের অনুপাত ১০০০:১) ৩০ মিনিট ধরে শোধন করে রোপণকরতে হবে। হেক্টর প্রতি প্রয়োজনীয় ৭-৭.৫ টন বীজ আখ শোধনের জন্য ২৫০ গ্রাম ব্যাভিস্টিন ২৫০ লিটার পানিতে মিশিয়ে দ্রবন তেরী করতে হবে।
আর্দ্র গরম বাতাসে বীজ শোধন (এমএইচএটি)-বীজখন্ড অথবা অর্ধেক সাইজের বা সম্পূর্ণ আখ এমএইচএটি প্লান্টে ৫৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ও ৯৫% এর অধিক আদ্রতায় ৪ ঘন্টাকাল শোধন করা হয়। শোধিত বীজ ঠান্ডা হলে ০.১% ব্যাভিস্টিন বা নোইন দ্রবণে ৩০ মিনিট শোধন করে মাটিতে রোপন করতে হবে। তাপ শোধিত বীজ ব্যাভিস্টিন বা নোইন দ্রবণে শোধন না করে সরাসরি রোপন করলে দেড় গুন বীজের প্রয়োজন হয়।
গরম পানিতে বীজ শোধন- সম্পূর্ন আখ বা বীজ খন্ড গরম পানিতে বীজ শোধন যন্ত্রে ৫০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ৩ ঘন্টাকাল শোধন করা হয়। শোধিত বীজ ঠান্ডা হলে ০.১% ব্যাভিস্টিন বা নোইন দ্রবণে ৩০ মিনিট শোধন করে মাটিতে রোপন করতে হবে। তাপ শোধিত বীজ ব্যাভিস্টিন বা নোইন দ্রবণে শোধন না করে সরাসরি রোপন করলে দুইগুন বীজের প্রয়োজন হয়।
রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার- মোজাইক রোগমুক্ত বীজ প্লটের বীজ ব্যবহার করে এ রোগের আক্রমণপ্রতিরোধ করা যেতে পারে
রগিং– বীজ আখ ক্ষেতে ২/৩ মাস অন্তর অন্তর মোজাইক রোগাক্রান্ত গাছ ঝাড়সহ তুলে ফেলতে হবে। বাহ্যিকভাবে যে কোন বীজবাহিত রোগ যথা লালপচা, স্মাট, সাদাপাতা, লীফ স্কাল্ড ইত্যাদি দেখা গেলে তা ঝাড়সহ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
আঁখের পরজীবি বিজলী ঘাষ দমন-জমিতে সুষম সারের ব্যবহার বিশেষ করে একর প্রতি ১৬০ কেজি ইউরিয়া সার সমান ৩ কিস্তিতে (রোপনের সময় নালায়, বৃষ্টিপাতের পর এপ্রিলে ও জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে) আখের জমিতে প্রয়োগ করতে হয়। বিজলী ঘাস দেখা গেলে ৫% ইউরিয়া দ্রবন (ইউরিয়া : পানি = ১ : ২০) রৌদ্রজ্জল দিনে বিজলী ঘাসের উপর স্প্রে করলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ঘাস মারা যায়।
ফসলের অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে ফেলা- আঁখ কাটার পর জমিতে চাষ দিয়ে ফসলের অবশিষ্টাংশ একত্র করে পুড়িয়ে ফেললে অনেক পোকা ও রোগজীবাণুর আক্রমণপ্রতিহত করা যায়।
ফসল সংগ্রহঃ আশ্বিন মাস থেকে ফাল্গুন-চৈত্র মাস পর্যন্ত আঁখ সংগ্রহ করা হয়।
আখের সাথী ফসলঃ আঁখের জমিতে সাথি ফসল হিসেবে আলু, পিঁয়াজ, রসুন, মশুর ইত্যাদি ফসল চাষ করা যেতে পারে।
জাত নির্বাচনঃ বর্তমানে ইক্ষুগবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত ২০ টি জাত বাণিজ্যিকভাবে আবাদ হচ্ছে। এ জাতগুলো ছাড়াও স্থানীয় অনেক জাত গুড় তৈরী রস পানের জন্য আবাদ করা হয়। যেমনঃ অমৃত বারং, সিও-২০৮, সিও-৫২৭, কাজলা, মিশ্রি মালা, তুরাগ গ্যান্ডারি ইত্যাদি অঞ্চল বিশেষে আবাদ হয়ে থাকে।
by
সর্বশেষ মন্তব্যসমূহ