আজ ১৮ মার্চ সকালে গণহত্যা জাদুঘরের উদ্যোগে ‘বিদ্রোহী মার্চ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান ঢাকার বাংলা একাডেমির কমি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে ‘আমার ও আমাদের একাত্তর’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি, লেখক ও সাংবাদিক জনাব শাহরিয়ার কবির। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক, এমপি। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবর রহমান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর সাধারণ সম্পাদক ড. মুর্শিদা বিন্তে রহমান। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন গণহত্যা জাদুঘরের সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি স¤পাদক ড. চৌধুরী শহীদ কাদের।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আ.ক.ম মোজাম্মেল হক বলেন, “অসহোযোগ আন্দোলনের দিনগুলি ছিলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সকল অনুপ্রেরণার উৎস”। মন্ত্রী আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধ কেন হয়েছিলো তা আমাদের সকলকেই জানতে হবে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে। ১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর থেকে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীরা বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল, যা মুক্তিকামী বাঙালি ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে বিশেষ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালির কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অর্জন। বাংলাদেশকে স্বাধীন করবার জন্য তিরিশ লক্ষ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে, পাঁচ লক্ষাধিক নারীকে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, এক কোটি মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে জীবনরক্ষার জন্য প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে নৃশংসতম গণহত্যাযজ্ঞ আরম্ভের পর বাংলাদেশের বিপন্ন মানুষের জন্য ভারত সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছিল, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে সবরকম সহযোগিতা করেছে এবং নয় মাসের যুদ্ধে নৃশংস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশের মাটিতে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছে।
মূল প্রবন্ধে জনাব শাহরিয়ার কবির বলেন, “৬৯, ‘৭০, ‘৭১- বাংলাদেশের এবং পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচেয়ে ঘটনা ও সংঘাতবহুল তিনটি বছর, যা গোটা উপমহাদেশের ইতিহাস-ভূগোল সব ওলটপালট করে দিয়েছে। সেই সময় আমি হিরন্ময় কৈশোর অতিক্রম করে উদ্দাম যৌবনের রোমাঞ্চকর অজানা সোপানে পদার্পণ করছি। আমার মানসগঠনের এই সময় ছিল আন্দোলন ও সংঘাতমুখর এমন এক ক্রান্তিকাল- যা অতীতে কখনও ঘটেনি, ভবিষ্যতেও ঘটার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। ৭১-এ আমাদের প্রজন্মের সুযোগ হয়েছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় প্রত্যক্ষ ও অংশগ্রহণ করার। ৭১-এ ইতিহাস আমাদের গৌরব ও আনন্দের পাশাপাশি একই সঙ্গে ধারণ করেছে অগৌরব ও বেদনার ঘটনাও। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জন করেছি- এটি যেমন ইতিহাসের অমোঘ সত্য, আরও কঠিন সত্য হচ্ছে এই প্রাপ্তির জন্য আমাদের অপরিসীম মূল্য দিতে হয়েছে। স্বাধীনতার জন্য তিরিশ লক্ষ মানুষের জীবনদান, পাঁচ লক্ষাধিক নারীর চরম নির্যাতন, শরণার্থীর তকমা নিয়ে এক কোটি মানুষের প্রতিবেশি ভারতে বিড়ম্বিত জীবনযাপন এবং দেশের অভ্যন্তরেও কয়েক কোটি অবরুদ্ধ মানুষের উৎকণ্ঠা ও বেদনা- পৃথিবীর অন্য কোনও জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে নজির পাওয়া যাবে না।”
সভাপতির বক্তব্যে ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক পেশাজীবী সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং বিশিষ্ট নাগরিকরা ভারতে গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন করেছেন, রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধ এবং রণাঙ্গনের বাইরে প্রচারযুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক জনমত সংগঠিত করেছেন রণাঙ্গনের সশস্ত্র যুদ্ধের চেয়ে প্রচারযুক্ত কম গুরুত্বপূর্ণ না হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সামরিক যুদ্ধ যে গুরুত্ব পেয়েছে, প্রচারযুদ্ধ তা পায়নি, একাত্তরের প্রচারযুদ্ধে এক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা, যার উল্লেখ তারেক মাসুদের মুক্তির গান’ এবং শাহরিয়ার করিবেরর ‘মুক্তিযুদ্ধের গান’ শীর্ষক প্রামাণ্যচিত্রের বাইরে খুব কমই হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ বছর পর শাহরিয়ার কবির তাঁর ৭১-এর রোজনামচার ভিত্তিতে লিখেছেন “আমার একাত্তর’। এই গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে আমাদের ইতিহাসের সেই বর্ণাঢ্য সময় যা আগে কখনও আসেনি, আগামীতেও আসবে না। সেই সময়ের এক তরুণ লেখকের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, প্রচারযুদ্ধে তার বহুমাত্রিক উপস্থিতি এবং সদ্য স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ইতিবৃত্ত বর্ণিত হয়েছে এই গ্রন্থে। একই সঙ্গে উন্মোচিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বহু অজানা তথ্য, যা একই সঙ্গে গৌরব ও বেদনার আরও অনেক ঘটনা রয়েছে যা আজকের তরুণ প্রজন্মকে জানাবার জন্য এই গ্রন্থের অবতারণা। কারণ শাহরিয়ার মনে করেন, “মুক্তিযুদ্ধ নিছক সামরিক বা রাজনৈতিক প্রপঞ্চ ছিল না, এটি চূড়ান্তভাবে ছিল আদর্শেরও যুদ্ধ। আদর্শিক যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে সংস্কৃতি। আমরা প্রতিপক্ষকে সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করলেও আদর্শিকভাবে আজও পরাজিত করতে পারিনি। যে কারণে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ত্রী উদযাপনের পরও আমাদের সেই ‘৭১-এর হিংস্র শ্বাপদদের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে, যারা ‘৭১-এ ধর্মের নামে গণহত্যা ও নারী নির্যাতন সহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে।”
অপর আলোচকরাও মুক্তিযদ্ধের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন।আলোচনা সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গবেষক, আইনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এতে অংশগ্রহণ করন।
by
সর্বশেষ মন্তব্যসমূহ