জীববৈচ্যিত্রে অনন্য সুন্দরবন –পর্ব ৪

চিতল হরিণ

চিতল হরিণ

সুন্দরবনের প্রাণ চিতল হরিণঃ
চিতল হরিণ (Spotted Deer): সুন্দরবনের সবচেয়ে সুন্দর প্রাণী চিতল হরিণের গায়ের রং লালচে বাদামীর উপর সাদা সাদা ফোটা।সংখ্যায় এরা সুন্দরবনের প্রাণীদের মধ্যে সংখ্যা গরিষ্ঠ।পুরুষ হরিণের গায়ের রং গাঢ় এবং মুখে কালো দাগ থাকে।পুরুষ হরিণের শাখা-প্রশাখা যুক্ত শিং থাকে যা লম্বায় এক মিটার পর্যন্ত হয়।সাধারণত প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক স্ত্রী হরিণেরা একসাথে থাকে।যৌণ-মিলন ঋতুতে পুরুষ হরিণেরা এদের পেছনে ঘোরে।অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ হরিণেরা আলাদা দল বাধে।সাধারণত সুন্দরবনের চিতল হরিণদের নির্দিষ্ট কোন মিলন-ঋতু থাকে না।বিপদের সময় এরা তীব্র স্বরে ছোট ছোট ডাক দেয়।চিতল হরিণ বছরে একবার বাচ্চা দেয়।একবারে দু’টি শাবক প্রসব করে হরিণী।তবে একটি বা তিনটি বাচ্চা প্রসবও স্বাভাবিক ভাবে হয়ে থাকে।কেওড়া গাছের পাতা ও ফল এদের সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য।পেছনের পায়ে ভর দিয়ে এরা কেওড়া গাছের পাতা যতটা উচু পর্যন্ত খাওয়া সম্ভব তার চেষ্টা করে।

মায়া হরিণ (Indian M untjack): মায়া হরিণ চিতল হরিণের চেয়ে আকারে অনেক ছোট।এদের গায়ের রং গাঢ় লালচে-বাদামী।মায়া হরিণের ডাক শুনতে

মায়া হরিণ

মায়া হরিণ

কুকুরের ডাকের মত।মায়া হরিণ অত্যন্ত লাজুক ও নিভৃতচারী,এ কারণে সহজে মায়া হরিণের দেখা মেলে না।এদের পুরুষদের শাখাযুক্ত কিন্তু ছাগলের মত ছোট শিং হয়।মায়া হরিণের শাবক ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের সাথে থাকে।এর পর নিজস্ব এলাকার সন্ধানে অন্যদের সাথে যুদ্ধ করে নিজের এলাকার দখল নেয়।সাধারণত এরা ফল-মূল,শাক-সব্জী খায়,তবে মাঝে মাঝে কাঁকড়া,চিংড়িও খেয়ে থাকে।

বানর (rhesus macaque): সুন্দরবনের রেসাস বানর অত্যন্ত চট্পটে,হাঙ্গামা প্রিয় এবং ভালো সাতারু।এরা অনেকগুলি নারী-পুরুষের দল একসাথে বাস করে।বানরের বসবাসের এলাকা গন্ডি দ্বারা সিমাবদ্ধ নয়।ছোট্ট বানর সাবক কয়েক সপ্তা মা’কে জড়িয়ে ধরে চলাফেরা করে।মা বানর সাবক কে প্রায় এক বছর লালন-পালন করে ও প্রশিক্ষণ দেয়।পুরুষ বানর জন্মের অল্পকাল পরেই যৌন ক্ষমতার অধিকারী হয় এবং সে কারণে দ্রুতই তারা দল ত্যাগ করে।প্রাপ্ত বয়স্ক বানরের মুখ এবং পশ্চাতদেশ লাল রং ধারণ করে।
অঙ্গভঙ্গি,মুখভঙ্গি,খেলার অভিনয়,মারামারির অভিনয় ও বিভিন্ন প্রকার শব্দকে সংকেত হিসেবে ব্যবহার করে বানরেরা তাদের আভ্যন্তরিন যোগাযোগ রক্ষা করে।রেসাস বানরেরা সর্বভুক।মাঝে মাঝে এরা গাছের কন্দ,পাতা,ফল,পোকামাকড় ও ছোট ছোট প্রাণী ধরে খায়।মাটি থেকে আহরণকৃত কোন খাবার খাওয়ার আগে বানরেরা তা উত্তমরূপে ধৌত করে নেয়।

বন্য শুকর

বন্য শুকর

বন্য শুকর (W ild Boar): বুনো শুয়োর বিভিন্ন পরিবেশে বাস করে।সুন্দরবনের সব এলাকায় বুনো শুয়োর পাওয়া যায়।দেহের তাপমাত্রাকে আরামদায়ক পর্যায় রাখতে বুনো শুয়োর কাদা-মাটিতে গড়াগড়ি খায়।গায়ের কাদা শুয়রদের সূর্যের তাপ ও পোকা-মাকড়ের কামড় থেকেও রক্ষা করীরা সাধারণত সন্ধ্যায় খাদ্যের সন্ধানে বের হয়।সারা রাত চরে ভোরের আলো ফুটতেই আস্তানায় ফিরে যায়।বুনো শুয়োর তার সদাবাড়ন্ত তিক্ষ্ণ দাত খাদ্য আহরণে ও শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যবহার করে।শুকরী একবারে চার থেকে আটটি ছানা প্রসব করে যার অর্ধেক মাত্র টিকে থাকতে পারে।বাকীরা বিভিন্ন শিকারী প্রাণীর উদরে আশ্রয় নেয়,এবং কিছু মারা যায় বিভিন্ন রোগে।বুন শুয়রের দৃষ্টি শক্তি ক্ষিণ তবে শ্রবণ ও ঘ্রাণ শক্তি অত্যন্ত প্রখর।বুনো শুয়োর সর্বভুক।খাদ্যের বেলায় এদের স্বভাব বিশৃঙ্খল।এরা সাধারণত ফানজাই,কন্দ,শাকসব্জী,বীজ-ফলমূল ইত্যাদি খায়,আবার ছোট মেরুদন্ডী-অমেরুদন্ডী প্রাণী এবং পচা-গলা মাংসও ভজন করে।

বাগডাস (Large Indian C ivet): বাগডাস নিভৃতচারী নিশাচর প্রাণী।সাধারণত এরা ঘেসোজমি ও ঘন-জঙ্গলে মাটির গর্তে বাস করে,যা খনন করে অন্য প্রাণী।বাঘডাস গাছে চড়তে পটু।এরা এদের বসতি এলাকা চিহ্নিত করে দেয় এদের গ্লান্ড থেকে নিঃস্রিত এক ধরনের রস দিয়ে।এই রসকে বলা হয় সিভেট।বানিজ্যিক ভাবে সুগন্ধি তৈরীতে এই সিভেট ব্যবহৃত হয়।বাগডাস’র খাদ্য তালিকায় আছে পাখি,পাখির ডিম,ব্যাং,সাপ,ফল-মূল,মাছ ও কাঁকড়া।সুন্দরবনের বাগডাসদের সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়।

পাতি শিয়াল (golden Jackal): পাতি শিয়াল শুকনো জমি ও খোলা প্রান্তরে বাস করতে পছন্দ করে।তাই এদের সুন্দরবনের সাগর পাড়ের তৃণভূমি বা সাভানা এলাকায় পাওয়া যায়।পাতি শিয়াল সাধারণত নিশাচর,তবে যেখানে মানুষের উপস্থিতি কম সেখানে দিনেও এরা শিকার খোঁজে।পাতি শিয়াল তার বসতি এলাকার সীমানা বা বাউন্ডারী চিহ্নিত করে দেয় তার মূত্র দিয়ে।

পাতি শিয়াল শিকারে সক্ষম হলেও বড় জন্তুদের সাধারণত আক্রমণ করে না।এরা শিকার করে হরিণ ছানা,ইদুর,পাখি,ডিম,সরিসৃপ,ব্যাং,মাছ,ফল-মূল ও পোকা-মাকড়।মাঝে মাঝে পচা মাংসও খায় এবং সামুদ্রিক কচ্ছপের বাসায় হানা দেয়।পাতি শিয়াল এদের পাকস্থলিতে খাদ্য বহন করে যা পরে বের করে খায়।

ভোদড় (O rental O tter): সুন্দরবনের ভোদড় বর্ধিত পারিবারিক দলে বাস করলেও একটি যুগল সারা জীবন একসাথে থাকে।স্ত্রী ভোদড় বছরে এক থেকে ছয়টি বাচ্চা প্রসব করে।একটি বাচ্চার ওজন হয় ৫০ গ্রাম’র কাছাকাছি।জন্মের পর ৪০ দিনের আগে বাচ্চারা চোখ খুলতে পারে না।দশ সপ্তা বয়সের আগে বাচ্চারা বাসার বাইরে যায় না।বাচ্চারা শক্ত খাবার খেতে পায় জন্মের ৮০দিন পর এবং তিন মাস বয়স হলে মায়ের সাথে সাতার কাটা শুরু করে।এরা পানিতে ডুবে মাছ শিকার করে এবং গর্তে হানা দিয়ে শামুক ও কাঁকড়া ধরে খায়।শামুক-ঝিনুকের খোল ভাঙার জন্য এদের দাঁত যথেষ্ট শক্ত।

সজারু

সজারু

সজারু(Porcupine): সজারু সুন্দরবনের শুকনো এলাকায় বাস করে,কারণ এরা কাদা পছন্দ করে না।নিশাচর এ প্রাণী নিজেই গর্তখুড়ে বাসা বানায়।সজারুর হাত-পা বেশ চওড়া আকৃতির যাতে লম্বা নখযুক্ত থাবা থাকে।এর চুলগুলি বড় হয়ে তিক্ষ্ণ ধারালো কাঁটায় পরিণত হয়।আক্রান্ত হলে এরা এদের কাটাগুলি মেলে দেয় এবং লেজের কাঁটাগুলি প্রসারিত করে।আক্রমণকারীকে এরা পেছন দিক দিয়ে আক্রমণ করে এবং লেজের কাটাগুলি আক্রমণকারীকে ফুটিয়ে দেয়।এতে আক্রমণকারী মারাত্মক ভাবে আহত হয় এমনকি মৃত্যু বরণও করে।সাধারণত এরা ফল-মূল,কন্দ ইত্যাদি খায়।
এছাড়া সুন্দরবনে আছে বিভিন্ন ধরনের তিক্ষ্ণ দাঁত ইদুর,কাঠ বিড়াল,চামচিকা ও বাদুড়।এরা সকলেই গাছে বাস করে।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ ,

Comments are closed.