আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস!

আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস! ১৯৭১ এর ডিসেম্বর মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন বুঝতে শুরু করে যে তাদের পক্ষে যুদ্ধে জেতা সম্ভব না, তখন তারা নবগঠিত দেশকে মেধাশূন্য করতে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে দূর্বল এবং পঙ্গু করে দেয়ার জন্য পরিকল্পনা করতে থাকে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৪ দিসেম্বর রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার, আল বদর ও আল শামস বাহিনীর সহায়তায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিজ নিজ গৃহ হতে তুলে এনে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে।

বন্দী অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত লাশ রায়েরবাজার এবং মিরপুর সহ দেশের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। অনেকের লাশ শনাক্তও করা যায়নি, পাওয়াও যায়নি বহু লাশ।

২৫ মার্চ রাতে অপারেশান সার্চলাইট পরিকল্পনার সাথে সাথে বুদ্ধিজীবীদেরও হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পাকিস্তানী হায়নারা অপারেশন চলাকালীন সময়ে খুঁজে খুঁজে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে ২৫শে মার্চের রাতেই হত্যা করা হয়। তবে, পরিকল্পিত হত্যার ব্যাপক অংশটি ঘটে যুদ্ধ শেষ হবার মাত্র কয়েকদিন আগে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের প্রশিক্ষিত আধা-সামরিক বাহিনী আল-বদর এবং আল-শামস বাহিনী একটি তালিকা তৈরি করে, যেখানে এই সব স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবীদের নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়। পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে এ কাজের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী।

স্বাধীনতার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত বঙ্গভবন থেকে তার স্বহস্তে লিখিত ডায়েরী পাওয়া যায় যাতে অনেক নিহত ও জীবিত বুদ্ধিজীবীর নাম পাওয়া যায়। এছাড়া আইয়ুব শাসন আমলের তথ্য সচিব আলতাফ গওহরের এক সাক্ষাৎকার হতে জানা যায় যে, ফরমান আলীর তালিকায় তার বন্ধু কবি সানাউল হক’র নাম ছিল। আলতাফ গওহরের অনুরোধে রাও ফরমান আলি তার ডায়েরীর লিস্ট থেকে সানাউল হকের নাম কেটে দেন। এছাড়া আলবদরদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা তিনিই করেছিলেন বলে তার ডায়েরীতে একটি নোট পাওয়া যায়।

এছাড়া তার ডায়েরীতে হেইট ও ডুসপিক নামে দুজন আমেরিকান নাগরিকের নামের উল্লেক্ষ পাওয়া যায়। এদের নামের পাশে ইউএসএ এবং ডিজিআইএস লেখা ছিল। এর মধ্যে হেইট ১৯৫৩ সাল থেকে সামরিক গোয়েন্দাবাহিনীতে যুক্ত ছিল এবং ডুসপিক ছিল সিয়াইএ এজেন্ট। এ কারণে সন্দেহ করা হয়ে থাকে, পুরো ঘটনার পরিকল্পনায় সিআইএ’র ভূমিকা ছিলো।

ডিসেম্বরের ১০ তারিখ হতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি নেয়া হতে থাকে। মূলত ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়ন হয়। অধ্যাপক, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী, লেখক-সহ চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তানী শকূণ এবং তাদের দোসর কুকুরের দল জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায়। সেদিন প্রায় ২০০ জনের মত বুদ্ধিজীবীকে তাঁদের বাসা হতে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের চোখে কাপড় বেঁধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ অন্যান্য আরো অনেক স্থানে অবস্থিত নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের উপর বিভৎস নির্যাতন চালানো হয়। পরে তাদের নৃশংসভাবে রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়।

বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশাকারী পাকিস্তানী শৃগাল রাও ফরমান আলী

বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশাকারী পাকিস্তানী শৃগাল রাও ফরমান আলী

পাকিস্তানী সামরিক জান্তার পক্ষে এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলো মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। আর তাকে তালিকা প্রস্তুতিতে সহযোগীতা ও হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নের পেছনে ছিল মূলত জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক গঠিত কুখ্যাত আল বদর বাহিনী। বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান ঘাতক ছিলো বদর বাহিনীর চৌধুরী মইনুদ্দিন (অপারেশন ইন-চার্জ) ও আশরাফুজ্জামান খান (প্রধান জল্লাদ)। ১৬ ডিসেম্বরের পর আশরাফুজ্জামান খানের নাখালপাড়ার বাড়ি থেকে তার একটি ব্যক্তিগত ডায়েরী উদ্ধার করা হয়, যার দুটি পৃষ্ঠায় প্রায় ২০ জন বুদ্ধিজীবীর নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কোয়ার্টার নম্বরসহ ঠিকানা লেখা ছিল। তার গাড়ির ড্রাইভার মফিজুদ্দিনের দেয়া সাক্ষ্য অনুযায়ী রায়ের বাজারের বিল ও মিরপুরের শিয়ালবাড়ি বদ্ধভূমি হতে বেশ কয়েকজন বুদ্ধজীবীর গলিত লাশ পাওয়া যায় যাদের সে নিজ হাতে গুলি করে মেরেছিল। আর চৌধুরী মঈনুদ্দীন ৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলো। সে অবজারভার ভবন হতে বুদ্ধিজীবীদের নাম ঠিকানা রাও ফরমান আলী ও ব্রিগেডিয়ার বশীর আহমেদকে পৌঁছে দিতো। এছাড়া আরো ছিলো এ বি এম খালেক মজুমদার (শহীদুল্লাহ কায়সারের হত্যাকারী), মাওলানা আব্দুল মান্নান (ডাঃ আলীম চৌধুরীর হত্যাকারী, আব্দুল কাদের মোল্লা (কবি মেহেরুন্নেসার হত্যাকারী) প্রমুখ। চট্টগ্রামে প্রধান হত্যাকারী ছিলো ফজলুল কাদের চৌধুরী ও তার দুই ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং গিয়াস কাদের চৌধুরী।

বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিসংখ্যানঃ

শিক্ষাবিদ- ৯৯১ জন

সাংবাদিক- ১৩ জন

চিকিৎসক- ৪৯ জন

আইনজীবী- ৪২ জন
অন্যান্য(সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী, প্রকৌশলী) – ১৬ জন

বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী জল্লাদ জামায়াত'র কুকুর মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান

বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী জল্লাদ জামায়াত’র কুকুর মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান

২৫শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী পাকবাহিনীর হাতে প্রাণ হারান। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকঃ

অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থবিদ্যা), এম এ সাদেক (সিক্ষা), এম সাদত আলী (শিক্ষা), সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য (ইতিহাস), গিয়াসউদ্দিন আহমদ (ইতিহাস), রাশিদুল হাসান (ইংরেজী), এম মর্তজা (চিকিৎসক)।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকঃ

ডঃ হাবিবুর রহমান (গনিত), ডঃ শ্রী সুখারঞ্জন সমাদ্দার (সংস্কৃত), মীর আব্দুল কাইউম (মনবিজ্ঞান)।

চিকিৎসকঃ

অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি (হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ),অধ্যাপক ডাঃ আলিম চৌধুরী (চক্ষু বিশেষজ্ঞ),অধ্যাপক ডাঃ শামসুদ্দিন আহমেদ,অধ্যাপক ডাঃ আলিম চৌধুরী, ডাঃ হুমায়ুন কবির, ডাঃ আজহারুল হক, ডাঃ সোলায়মান খান, ডাঃ আয়শা বদেরা চৌধুরী, ডাঃ কসির উদ্দিন তালুকদার, ডাঃ মনসুর আলী, ডাঃ মোহাম্মদ মর্তজা, ডাঃ মফিজউদ্দিন খান, ডাঃ জাহাঙ্গির, ডাঃ নুরুল ইমাম, ডাঃ এস কে লালা, ডাঃ হেমচন্দ্র বসাক, ডাঃ ওবায়দুল হক, ডাঃ আসাদুল হক, ডাঃ মোসাব্বের হোসেন, ডাঃ আজহারুল হক (সহকারী সার্জন), ডাঃ মোহাম্মদ শফী(দন্ত চিকিৎসক),

অন্যান্যঃ

শহিদুল্লা কায়সার(সাংবাদিক), নিজামুদ্দিন আহমেদ(সাংবাদিক), সেলিনা পারভিন(সাংবাদিক), সিরাজুদ্দিন হোসেন(সাংবাদিক), আ ন ম গোলাম মুস্তফা(সাংবাদিক), আলতাফ মাহমুদ(গীতিকার ও সুরকার), ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (রাজনীতিক), রনদাপ্রসাদ সাহা(দানবীর), যোগেশ চন্দ্র ঘোষ(আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক), ডঃ আবুলকালাম আজাদ(গনিতজ্ঞ), নজমুল হক সরকার, নতুন চন্দ্র সরকার(সমাজসেবক, আয়ূর্বেদিক চিকিৎসক)।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালীন বধ্যভূমি খোঁজার জন্য ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর থেকে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে “ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি।” সারা দেশে প্রায় ৯৪২টি বধ্যভূমি শনাক্ত করতে পেরেছে তারা। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন প্রকাশিত পত্রিকা, এ বিষয়ক বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধ, গ্রন্থ, এবং মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবার এবং স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে এসব বধ্যভূমি খুঁজে বের করা সম্ভব হয়েছে। প্রত্যেক বধ্যভূমিতে ফলক স্থাপনের পরিকল্পনা হচ্ছে। অধিকাংশ জেলাতেই মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমিগুলো হয় রেলের নয়তো সড়ক ও জনপথের আওতাভুক্ত জায়গায়।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *