সুন্দরবন সংলগ্ন বলেশ্বর তীরবর্তী গ্রামগুলোর মানুষের কাছে হরিণ শিকার যেন এক উৎসব। সুন্দরবনের হরিণ যেন তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি। আর বনবিভাগ যেন এক রহস্যময় হেয়ালী।
হরিণ পাচারের নিরাপদ রুট বলেশ্বর ও বিষখালী নদী। কাঠ চুরি ও হরিণ শিকার করেই তারা আয় করে মোটা অংকের টাকা।
পাথরঘাটার পশ্চিম প্রান্তে চরদুয়ানী ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নের বলেশ্বর তীরবর্তী গ্রাম দক্ষিণ চরদুয়ানী, কালিয়ারখাল, কাঠালতলী ও জ্ঞানপাড়া। এখান থেকে পশ্চিমে তাকালেই দেখা যায় সুন্দরবনের গহীনঅরণ্য। ওই চার গ্রামে রয়েছে বেশ কয়টি হরিণ শিকারি চক্র।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জ্ঞানপাড়া গ্রামের এক হরিণ শিকারি জানান, দক্ষিণ চরদুয়ানী গ্রামের বিশ্বাস বাড়ির বিশ্বাস বাহিনী সুন্দরবনের কাঠ চুরি ও হরিণ শিকারের সঙ্গে জড়িত। বলেশ্বর নদী সংলগ্ন এ গ্রামগুলোর অন্তত ২৫ থেকে ৩০টি পরিবার নিয়ে গড়ে উঠেছে হরিণ শিকার চক্রে।
জ্ঞানপাড়া, কালিয়ারখাল ও চরদুয়ানী থেকে বলেশ্বর পাড়ি দিলেই সুন্দরবনের সুপতি, বগী ও কচিখালীতে চিত্রল হরিণ পাওয়া যায়। এ অঞ্চল থেকে সুন্দরবন খুব কাছে হওয়ায় সহজে হরিণ ধরে পাচার করতে পারে হরিণ শিকারি চক্র।
শিকারিরা হরিণ শিকার করে পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে বেছে নিয়েছে বলেশ্বর ও বিষখালী নদী। হরিণ ধরা হয় জাল দিয়ে। পরে পা বেধে ট্রলার বা নৌকার খোলে নিয়ে বলেশ্বর পাড়ি দিয়ে আনা হয় জ্ঞানপাড়া, কালিয়ারখাল অথবা দক্ষিণ চরদুয়ানী গ্রামে। হরিণ শিকারিরা তাদের অজ্ঞাতস্থানে হরিণ শিকার করে মজুত রাখে। পরে সুযোগ মতো পার্টির কাছে পাচার করে।
হরিণ ডাকাতরা খুলনা, যশোর, বরিশাল, বাগেরহাট, শরণখোলা এমনকি ভারতেও হরিণ পাচার করছে। তারা জীবিত হরিণগুলো নদী পথে পাচার করে আর জবাই করে মাংস ও চামড়া পাথরঘাটা-মঠবাড়িয়া হয়ে সড়ক পথে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করছে। তবে সড়ক পথের চেয়ে তারা নৌপথেই নিরাপদ মনে করছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাঠালতলী ইউনিয়নের এক জনপ্রতিনিধি বলেন, হরিণ শিকারিরা এলাকার প্রভাবশালী এবং বন বিভাগের সহায়তায় এ কাজ করছে। তারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে এ কাজ করছে।
গোপন তথ্য মতে জানা যায়, পাথরঘাটায় সক্রিয় আট থেকে দশটি দলের মধ্যে তিনটি দল মাংস ও চামড়া বিক্রির কাজে জড়িত। বাকি পাঁচ থেকে সাতটি দল সুন্দরবন থেকে হরিণ শিকার ও জবাই করে তা পৌঁছে দেয়। এই দলের হয়ে ৩০ থেকে ৩৫জন সুন্দরবনের পূর্বাঞ্চলের কচিখালীতে হরিণ ধরে জবাই করে। আর এদের ছত্রছায়ায় রয়েছে এলাকার প্রভাবশালী ও রাজনীতিক।
পাথরঘাটায় হরিণের মাংস বিক্রির নিয়ন্ত্রণে বেশ কয়েকজনের মধ্যে তিনজনের নাম জানা গেছে। তারা হলো লাভলু ওরফে লাবু, খলিল কাজী ওরফে খলিল ও জহিরুল ইসলাম ওরফে জহির। বনবিভাগসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তালিকায় তাদের নাম রয়েছে। তবে এরা সবাই এ অভিযোগ অস্বীকার করছে। বিগত দিনে র্যাব ও কোস্টগার্ডের অব্যাহত অভিযানের ফলে হরিণের মাংস ও চামড়া উদ্ধার হওয়ায় চক্রগুলো সতর্কতার সঙ্গে এ কারবার চালু রেখেছে।
চলতি বছরে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০টি হরিণের চামড়া আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হরিণ শিকারি চক্রের বিরুদ্ধে মামলা হলেও কয়েকদিন হাজত খেটে জামিনে এসে পুনরায় কাজ শুরু করে।
শিকারিদের হাতে বছরে মারা পড়ছে হাজার হাজার হরিণ: এক তথ্য মতে, সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় উপজেলার পাথরঘাটার চরদুয়ানী, সদর পাথরঘাটা ও কাঠালতলী ইউনিয়নের হরিণ শিকারি চক্রদের হাতে প্রতিদিন মারা পড়ছে অন্তত ২৫ থেকে ৩০টি হরিণ। যা নৌ ও সড়ক পথ থেকে পাচার করা হচ্ছে।
সড়ক পথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বস্তায় মাছ বলে হরিণের মাংস ও চামড়া নিরাপদে পাচার করছে। ২০১০ সালে লন্ডন ভিত্তিক ওয়াইল্ড টিম ও বাংলাদেশ জু-লজিক্যাল সোসাইটির যৌথ এক সমীক্ষার তথ্য থেকে জানা যায়, সুন্দরবন সংলগ্ন আটটি উপজেলায় চোরাই শিকারিদের হাতে বছরে কমপক্ষে ১০ হাজার হরিণ মারা পড়ছে।
এ বিষয় বনবিভাগের ভূমিকা রহস্যজনক।
by
সর্বশেষ মন্তব্যসমূহ