মজুরি বঞ্চিত পাটকল শ্রমিকরা তাদের ঘামের দাম চায়

শ্রমিকদের দাবি পাটকলের আধুনিকায়ন:

খুলনার রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের মজুরি বঞ্চিত শ্রমিকরা তাদের ঘামের দাম চায়। তাদের দাবি “ আমরা বছরের পর বছর ধরে গায়ের ঘাম ঝরিয়ে যে উৎপাদন করেছি আমাদের সেই শ্রমের দাম, ঘামের দাম সরকারকে পরিশোধ করতেই হবে।” তাদের আরও দাবি দুর্নীতিমুক্ত ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে পাটকলগুলিকে একটি আধুনিক শিল্প হিসেবে গড়েতুলতে হবে।

খুলনার রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকদের সাথে আলাপকালে তাঁরা বলেন, সরকার ২০১৫ সালে পাটকল শ্রমিকদের জন্য ন্যুনতম মজুরি ঘোষণা করে। সে সময় বিদ্যমান সর্বনিম্ন মজুরি ছিল চার হাজার একশ’ টাকা যা নতুন ঘোষণা অনুযায়ী হয় আট হাজার তিনশ’ টাকা। ২০১৫ সালে ঝোষণা দিলেও শ্রমিকদের এ পাওনা প্রদান শুরু হয় ২০২০ সালের ১ জানুয়ারী থেকে। সাধারণ শ্রমিকসহ শ্রমিকনেতৃবৃন্দ বলেন, ২০২০ সালের জানুয়ারী থেকে জুনমাস পর্যন্ত খুলনার রাষ্ট্রায়ত্ব জুটমিলের সকল শ্রেণির (এসকল মিলে মোট চার শ্রেণির শ্রমিক যথা- স্থায়ী, বদলি, অস্থায়ী এবং দৈনিক ভিত্তিক শ্রমিক রয়েছেন) শ্রমিকগণ আট হাজার তিনশ’ টাকা ন্যুনতম মজুরী হিসেবে মজুরী পেয়েছেন।

এরপর ২০২০ সালের ১ জুলাই কোন পূর্বঘোষণা ছাড়াই বাংলাদেশের সকল রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল (২৬ টি) বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সরকার ঘোষণা করে যে, শ্রমিকদের সকল বকেয়া পাওনা দুইটি প্রক্রিয়ায় পরিশোধ করা হবে যার মধ্যে অর্ধেক পাওনা নগদে এবং অর্ধেক পাওনা সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে প্রদান করা হবে। শর্তানুযায়ী ২০২১ সালের জুন মাস থেকে নগদ অর্ধেক প্রদান শুরু হয় এবং একই বৎসর সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় সঞ্চয়পত্রের অর্ধেক পাওনা প্রদান যা স্থায়ী এবং বদলি শ্রেণির সকল শ্রমিক পর্যায়ক্রমে পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন।

সমস্যার শুরুঃ শ্রমিকদের বক্তব্যানুযায়ী সমস্যা শুরু হয় ‘তথাকথিত’ অস্থায়ী এবং দৈনিক ভিত্তিক শ্রেণির শ্রমিকদের নিয়ে। খুলনার সাতটি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের মধ্যে পাঁচটি অর্থাৎ ক্রিসেন্ট, প্লাটিনাম, ষ্টার, আলীম ও ইষ্টার্ণ জুটমিলের সকল শ্রমিক হ’ল স্থায়ী এবং বদলি শ্রেণির এবং পিপল্স্ ও দৌলতপুর জুটমিলের শ্রমিকরা হ’ল অস্থায়ী এবং দৈনিক ভিত্তিক শেণির।

বাংলাদেশ জুটমিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি)’র বক্তব্য হ’ল সরকার ঘোষিত ন্যুনতম মজুরীর সুবিধা শুধু স্থায়ী ও বদলী শ্রেণির শ্রমিকরাই পাবে এবং সে অনুযায়ী তাদের বকেয়া এরিয়ার বিল ( ২০১৫ সালে ন্যুনতম মজুরী ঘোষণার পর থেকে ২০২১ সালের জুনমাস পর্যন্ত ন্যুনতম আট হাজার তিনশ’ টাকা মজুরী হিসেবে তাঁদের পাওনা) পরিশোধ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু পিপল্‌স্‌ ও দৌলতপুর জুটমিলের শ্রমিকরা তা পাবে না। তবে শ্রমিক নেতা ও সাধারণ শ্রমিকদের দাবি বিজেএমসি’র বক্তব্য ভিত্তিহীন এবং বে-আইনী। যেহেতু ২০২০ সালের জানুয়ারী থেকে জুনমাস পর্যন্ত তারাও নতুন ঘোষিত ন্যুনতম মজুরি আট হাজার তিনশ’ টাকা হারে মজুরি পেয়েছেন তাই তারা আইনানুযায়ী তাদের বকেয়া এরিয়ার বিলও অবশ্যই পাবেন। যদি না পান তবে কিসের ভিত্তিতে তাদের ছয় মাসের মজুরী নতুন ঘোষিত মজুরী অনুযায়ী প্রদান করা হ’ল তা শ্রমিকরা জানতে চান।

আন্দোলনরত শ্রমিকদের দাবি, শুধু এরিয়ার বিল নয় বিজেএমসি’র নিকট তাদের আরও তিনটি বিল পাওনা আছে, সেগুলি হ’ল দুটি ঈদ বোনাস, লকডাউনের দুই মাসের মজুরী এবং পে-নটিশের দুই মাসের মজুরির সমপরিমাণ অর্থ।সবমিলিয়ে তাদের পাওনার পরিমাণ কত জানতে চাইলে শ্রমিক নেতারা বলেন এর সঠিক হিসাব তাদের জানা নেই, তবে সেটা ৪০ থেকে ৬০ কোটি টাকা হতে পারে।

শ্রমিকদের আন্দোলন সম্পর্কে জানতে চাইলে সিবিএ নেতা ও কারখানা কমিটির সভাপতি মনির হোসেন মনি বলেন, “ বিজেএমসি আমাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করছে কিন্তু তারা সফল হবে না, কারণ আমাদের দাবি আইন সঙ্গত আর তারা যা করছে সেটা বে-আইনী। এ আন্দোলনে সকল মিল শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ অছি, গত ৬ জানুয়ারী আমরা খুলনা জেলা প্রশাসন কার্যালয় ঘেরাও করে প্রধানমন্ত্রী বরাবর     স্মারকলিপি প্রদান করেছি, দাবি আদায় না হলে ভবিষ্যতে আরও কঠোর কর্মসূচী দেওয়া হবে, আমাদের ঘাম ঝরানো পাওনা  আদায় হবেই কারণ আমরা আইনের পথে আছি।”

শ্রমিকদের দাবি মিলের আধুনীকায়ণঃ উল্লিখিত মিলগুলির শ্রমিকদের দাবি মিলগুলিকে দুর্নীতিমুক্ত ও আধুনীক মিলে রূপান্তরিত করতে হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপুল সংখ্যক শ্রমিক বলেন, মিলগুলি গতশতাব্দির ৫০/৬০ দশকে তৈরী যা প্রায় ৬০ থেকে ৭০ বছরের পুরানো। এই মান্ধাতার আমলের মিলের উৎপাদন ক্ষমতা কম এবং উৎপন্নের গুণগতমান অত্যাধুনীক কম্পিউটারাইজড্ মিলের তুলনায় নি¤œমানের। এর ফলে দেশ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্যদিকে শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি হচ্ছেনা এবং আধুনীক যন্ত্রের সাথে শ্রমিকদের পরিচয় না হওয়ায় শ্রমিকরা আধুনিক যুগোপযোগী শ্রমিক হতে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর সাথে কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি যোগ হয়ে লাভজনক উৎপাদনের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে মিলগুলি। শ্রমিকদের অভিযোগ, সরকার ব্যক্তিখাতে মিল হস্তান্তরের যে শর্তগুলি ঘোষণা করেছে সেখানে আধুনিকায়নের কোন শর্ত নেই। সরকারকে অবশ্যই মিল আধুনিকায়নের শর্ত ঘোষণা করতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে কম্পিউটারাইজড্ মেশিন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে মিলগুলিকে অত্যাধুনিক শিল্পে পরিণত করতে হবে।

শ্রমিকদের আন্দোলন ও দেনা-পাওনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিজেএমসি’র খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের মহাব্যবস্থাপক মোঃ গোলাম রব্বানী বলেন, “শ্রমিকদের আন্দোলনের সাথে আমাদের কোন নৈতিক বিরোধ নেই। আর সরকার ঘোষিত ন্যুনতম সর্বনিম্ন মজুরী শুধু স্থায়ী শ্রমিকরা পাবে তাই এই আন্দোলনরত শ্রমিকরা কোন টাকা পাবে না। আর যেহেতু কোন টাকা পাবে না তাই তার পরিমাণ সম্পর্কেও আমার কোন ধারনা নেই।”

অস্থায়ী এবং দৈনিক ভিত্তিক শ্রমিকরা যদি ন্যুনতম সর্বনিম্ন মজুরি না পায় তা হলে ২০২০ সালের জানুয়ারী থেকে জুনমাস পর্যন্ত ৬ মাসের মজুরি (সরকার ঘোষিত ন্যুনতম সর্বনিম্ন হারে) কোন আইনে পেল জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ বিষয়টি আমার জানা নেই। তা ছাড়া সরকার যদি মনে করেন তবে বিশেষ বিবেচনায় তাদের টাকা দিতে পারেন।”

 

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *