জীববৈচ্যিত্রে অনন্য সুন্দরবন-পর্ব-১

বৈচ্যিত্রে আর অগম্যতায় আদিম অনন্য সুন্দরবন

পৃথিবীর বিভিন্ন সমূদ্র উপকূলে ম্যনগ্রোভ বন গড়ে উঠলেও আয়োতন ও জীববৈচ্যিত্রে সুন্দরবনের তুলনায় সেগুলো নিতান্তই নগন্য। পৃথিবীর একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, যেখানে বাস করে ভয়ঙ্করসুন্দর বাঘ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার।

বিশ্বের সবচেয়ে বেশী জীববৈচ্যিত্রে ভরপুর ম্যনগ্রোভ বন সুন্দরবন। মানুষের দখলদারিত্বের কারণে গত ২০০ বছরে সুন্দরবন তার অয়োতন প্রায় অর্ধেক হারিয়েছে। বর্তমানে সেুন্দরবনের আয়োতন প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার, এর বাংলাদেশের অংশের আয়োতন ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার এবং বাকী অংশ ভারতের পশ্চিম বঙ্গে অবস্থিত। বিশাল অয়োতনের এই দুর্গম জঙ্গলের কোথাও জনবসতির চিহ্নও নেই, আর এর প্রকৃতির জন্যই সেটা সম্ভবও নয়, ফলে এর প্রকৃতি হয়ে আছে একেবারে বুনো আদিম, যা এক বিস্ময়কর এবং আকর্ষণীয় ব্যাপার।

এই বনভূমির প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ স্থায়ীভাবে পানি পরিবৃত। প্রতিদিন দুইবার জোয়ারের পানিতে এ বনভূমি প্রায় এক মিটার পানিতে ডুবে যায়। প্রায় ৪৫০টি খাল ও নদী এই বনভূমির মধ্যে জালের মত বিছিয়ে আছে । সুন্দরবনে ৩৩৪ প্রজাতীর উদ্ভিদ,৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী,১৬৫ প্রজাতীর শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড পাওয়া যায় ।

সুন্দরবন এক প্রাকৃতিক ফিল্টারঃ সুন্দরবন হ’ল এক প্রাকৃতিক ফিল্টার বা ছাকনি,যা উজান থেকে আসা পানি থেকে পলি ও মাছের জন্য আবশ্যক পুষ্টিকর দ্রব্য আলাদা করে।সুন্দরবনের দুই শতাধীক প্রজাতীর মাছের প্রজনন ও বিচরণের ক্ষেত্রে এই পুষ্টিকর দ্রব্য একটি মৌলিক শর্ত।বহু প্রজাতির স্বাদুপানি ও লবনপানির মাছের প্রজনন ও পরিচর্যার জন্য ম্যানগ্রোভ অত্যন্ত জরুরী। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জৈব কনাগুলি বিশেষ প্রক্রিয়ায় খাদ্য গঠন করে যা নদী, মোহনা ও গভীর সমূদ্রের বিভিন্ন প্রজাতীর মাছের টিকে থাকার জন্য আবশ্যক। উপযুক্ত সময়ে এ সকল মাছ মিষ্টি ও লবনপানি প্রবাহিত নদী ও গভীর সমূদ্রে ছড়িয়ে পড়ে।

উজান থেকে আসা মিষ্টি পানি ও সমূদ্রের পানির সম্মিলন ঘটে খাড়ি(estuarie) অঞ্চলে অর্থাৎ যেখানে নদীর মুখ সমুদ্রের সাথে মিলিত হয়।সুন্দরবনের এই অঞ্চলগুলি হ’ল উপকূলীয় জীবদের উচ্চ-জননক্ষম এলাকা।বিপুল সংখ্যক প্রজাতীর মাছ,পাখি ও অন্যান্য উপকূলীয় জীবদের খ্যাদ্য গ্রহণ ও প্রজনন ক্ষেত্র হ’ল এই খাড়ি অঞ্চল।এখানে মিষ্টি পানির সাথে লবন পানি মিশে তৈরী হয় বিভিন্ন মাত্রার ব্রাকিস ওয়াটার।এই বিভিন্ন ‘মাত্রার মিশ্রন’ হ’ল ম্যানগ্রোভের জীবন।কিছু ম্যানগ্রোভ জন্মায় যেখানে পানিতে লবনের মাত্রা খুবই কম।আবার কিছু ম্যানগ্রোভ জন্মায় যেখানে পানিতে উচ্চ মাত্রার লবন থাকে।পানিতে লবনের মাত্রার তারতম্যের উপর নির্ভর ক’রে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন জাতের ম্যানগ্রোভ ও প্রাণী জন্মায়।পানিতে লবনের মাত্রাই সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও প্রাণীর স্থান নির্বাচন ও নিয়ন্ত্রন করে।

সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম পলিবাহিত ব-দ্বীপ মুখে অবস্থিত। বৃহৎ নদী পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা উজান থেকে বছরে প্রায় দুই কোটি টন পলি বয়ে নিয়ে আসে, যে পলি দক্ষিণ উপকূলে নতুন ভূমি গঠন করে। উপকূলীয় জোয়ার বয়ে আসা পলিকে ব-দ্বীপের কোলে ফিরিয়ে আনে এবং নতুন নতুন ভূমি গড়ে তোলে।

সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশকে Ramsar site(wetland of global importance)হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।এছাড়া ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেস্কো সুন্দরবনের তিনটি অভয়ারণ্যকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষনা করে। অভয়ারণ্যগুলি হলো কচিখালী-কটকা অভয়ারণ্য, নীলকমল অভয়ারণ্য ও ৫৩,৫৪,৫৫ ও ৪৯ নম্বর কম্পার্টমেন্টের অংশ বিশেষ নিয়ে গঠিত সুন্দরবন পশ্চিম অভয়ারণ্য। সমূদ্রের বেলাভূমিতে গড়েওঠা নয়নাভিরাম এ সকল অভয়ারণ্য নানা প্রজাতির পাখি ও বন্যপ্রাণীতে ভরপুর, যে কারণে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে সুন্দরবনের সাভানা (তৃণভূমি) জাতীয় এ সকল অঞ্চল।

ম্যানগ্রোভ কিঃ ম্যানগ্রোভ হ’ল বিভিন্ন ধরনের গ্রীষ্ম-মন্ডলীয় উদ্ভিদ যা সমূদ্র-উপকূলীয় অঞ্চলে জন্মায়। বিভিন্ন মাত্রার লবন ও মিষ্টি পানির মিশ্রনে(ব্রাকিশ ওয়াটার)বিভিন্ন প্রজাতির ম্যানগ্রোভ জন্মে এবং বিভিন্ন উচ্চতার জোয়ারের পানির সাথে খাপ খেয়ে বেঁচে থাকতে অভ্যস্ত হয়।

সব ধরনের ম্যানগ্রোভই লবন পানি থেকে লবন আলাদা করতে বা নিস্কাশন করতে সক্ষম। অধিকাংশ ম্যানগ্রোভ তাদের শেকড়ের মাধ্যমে লবন পানি পরিশোধিত করে।কিছু কিছু ম্যানগ্রোভ অবশ্য তাদের পাতার বিশেষ লবন গ্রন্থি দ্বারা পানি থেকে প্রাপ্ত লবন নিষ্কাশন বা নিঃসৃত করে।

সকল প্রকার উদ্ভিদ মাটি থেকে শেকড়ের সাহায্যে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সংগ্রহ করে।কিন্তু জোয়ারের পানিতে ডুবে থাকায় মাটি থেকে অক্সিজেন গ্রহণে ম্যানগ্রোভ বাধাগ্রস্ত হয়।এ কারণে সকল প্রকার ম্যানগ্রোভেরই থাকে বিভিন্ন ধরনের বায়বীয় মূল, যা তাকে বায়ু থেকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন গ্রহণে সহয়তা করে।

কিছু ম্যানগ্রোভ বংশবিস্তার করে বীজের মাধ্যমে।অন্যদের বংশবিস্তার ঘটে তাদের পাতার সাহায্যে অর্থাৎ পাতা থেকে নতুন গাছ জন্মায়।কিছু ম্যানগ্রোভের বীজ আকৃতিতে অস্বাভাবিক বড়,এদের বলা হয় প্রপাগুলস্‌।ম্যানগ্রোভ প্রপাগুল,বীজ ও ফল পানিতে ভেসে ভেসে সমগ্র উপকূলে ছড়িয়ে পড়ে এবং নতুন গাছ জন্মে।এদের বিশেষ আকৃতিগত গঠনই এদের পানিতে ভাসতে সাহায্য করে।ম্যানগ্রোভ বীজ অনেক মাস পর্যন্ত পানিতে টিকে থাকতে সক্ষম।সারা বিশ্বে প্রায় ৫০ প্রজাতীর ম্যানগ্রোভ পাওয়া যায় যার মধ্যে সুন্দরবনে পাওয়া যায় ২০ থেকে ২২ প্রজাতীর অধিক ম্যানগ্রোভ।

 সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভঃ সুন্দরবনে যে ম্যানগ্রোভগুলি জন্মে সেগুলি হ’ল – কেওড়া, ওড়া, সুন্দরী, পশুর, আমুর, সিংড়া, বাইন, ভোলা, গরান, ঝনা গর্জন, গুরাল, কাকড়া, ধুন্দুল, খলসি, গেওয়া, ডাগর, হেতাল, নোনাঝাউ, হরগোজা, গোলপাতা, হুদো বা টাইগার ফার্ণ।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ , ,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *