আবহাওয়ার পরিচিতিঃ
তাপমাত্রা, সূর্যকিরণের মাত্রা ও সূর্যকিরণ কাল, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, বায়ুর গতি ও দিক, বায়ুর চাপ ইত্যাদি আবহাওয়ার উপাদান বিভিন্ন ভাবে ধান উৎপাদনের উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
তাপমাত্রাঃ
গাছপালা নানাভাবে তাপমাত্রা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। ধান গাছের জীবনচক্রের বিভিন্ন পর্যায়ের জন্য সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রয়েছে যখন গাছের আর কোন বাড়-বাড়তি হয় না।
তাপমাত্রার তারতম্যের জন্য উফশী ধানের জীবনকাল বোরো মৌসুমে, আউশ বা আমন মৌসুমের চেয়ে ৩০-৫০ দিন বেশী। স্বল্প দিনে পাকে এরূপ জাত আগাম বোরো হিসাবে লাগালে অথবা আমনের জাত বেশী নাবীতে রোপন করলে কাইচথোড় এবং থোড় অবস্থায় অতিরিক্ত ঠান্ডার প্রভাবে শিষে ধানের সংখ্যা কমে যেতে পারে অথবা চিটার সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে। স্বল্প আলোক সংবেদনশীল জাত যেমন বিআর-১০ বা বিআর-১১ এবং আলোক অসংবেদনশীল জাত কিছুতেই ৩১ ভাদ্রের পরে লাগানো উচিত নয়।
প্রজনন পর্যায়ে অতি উষ্ণ তাপে (৩৫০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড বা বেশী) বা অতি নিম্ন তাপের (২০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের নিচে) শিষে ধানের সংখ্যা কমে যেতে পারে। ফুল ফোটা অথবা পরাগায়ণের সময় যদি অতি উষ্ণ তাপ থাকে তাহলে চিটার সংখ্যা থোড় অবস্থার চেয়ে অনেক বেশী হয়।
বোরো ধানে শৈত্য প্রবাহের প্রভাবঃ
বীজতলার চারা হলুদ বর্ণ ধারণ করে এবং অঙ্গজ বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
রোপনকৃত চারার অঙ্গজ বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ধানের পাতার অগ্রভাগ শুকিয়ে যায়।
শৈত্য প্রবাহ ও ঘন কুয়াশার কারণে বীজ তলায় ড্যাম্পিং অফ রোগের আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়।
শৈত্য প্রবাহের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে করণীয়ঃ
প্রচন্ড শীতে বীজতলা প্রতিদিন সূর্য উঠার ৪-৬ ঘন্টার মধ্যে সাদা স্বচ্ছ পলিথিন দ্বারা ঢেকে দিয়ে এবং সূর্য ডোবার সাথে সাথে পলিথিন তুলে দিয়ে বলিষ্ট ও স্বাভাবিক চারা উৎপাদন করা সম্ভব।
তীব্র শীতের সময় বীজতলায় দাঁড়ানো পানি রাখতে পারলে চারা অপেক্ষাকৃত বেশী সতেজ থাকবে এবং কম ক্ষতিগ্রস্থ হবে। সে জন্য বীজতলা পানির উৎসের কাছেই করা উচিৎ।
১৫ নভেম্বরের (৩০ কার্তিক) পর বীজতলা তৈরি করলে বোরো ধানের চিটা এড়ানো সম্ভব।
শীতাক্রান্ত বীজতলায় অনুমোদিত মাত্রায় জিপসাম সার ব্যবহার করা ভালো।
বীজতলায় বিঘা প্রতি ৩-৪ টন গোবর সার ব্যবহার করলে চারা সতেজ থাকবে।
ফুল পর্যায়ে শীতের কবল হতে বোরো ফসল রক্ষার জন্য ঠান্ডা সহিষ্ণু বোরো ধানের আবাদ করতে হবে।
সূর্যকিরণঃ
ধান গাছের জীবন চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে এর প্রভাব কম বেশী হয়। শিষ গঠন পর্যায় এবং ধান পাকা পর্যায়ে সূর্যকিরণের প্রভাব সবচেয়ে বেশী এবং দৈহিক বর্ধনশীল পর্যায়ে এর প্রভাব তুলনামূলক ভাবে কম। তাই এমন সময় ধান বপন বা রোপন করতে হবে যাতে ধানগাছের জীবন চক্রের শেষ পর্যায় দুটি প্রচুর পরিমাণে সূর্যকিরণ প।
বৃষ্টিপাতঃ
মাটির আর্দ্রতা প্রধানত বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভরশীল। ধান গাজ তার জীবন চক্রের প্রত্যেক পর্যায়েই মাটির আর্দ্রতার উপর নির্ভর করে। তবে কাইচথোড় থেকে ধানের দুধ আসা পর্যন্ত স্তর মাটির আর্দ্রতার অভাবে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আর্দ্রতাঃ
আর্দ্রতা গাছের বাস্পীয় প্রস্বেদনকে প্রভাবান্বিত করে। আর্দ্রতা ৭০% বা তার বেশী হলে গাছ সম্পর্কিত নানা জীবাণুর প্রচুর বিস্তার ঘটে। তাছাড়া ধান গাছের অনিষ্টকারী পোকামাকড় ও রোগজীবাণুর বিস্তার ঘটার আশংকা থাকে।
মন্তব্যঃ
আবহাওয়াকে ধান উৎপাদনের একটি উপকরণ হিসাবে গণ্য করে এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অধিক ফলন লাভ করা সম্ভব।
ধানের চিটাঃ
চিটার বিবরণঃ
স্বাভাবিক অবস্থায় ধানে শতকরা ১৫-২০ ভাগ চিটা হয়। চিটার পরিমান এর থেকে বেশী হলে ধরে নিতে হবে কাইচথোড় থেকে ফল আসা পর্যন্ত বা কখনো কখনো ধান পাকার আগে ফসলটি কোনো না কোনো প্রতিকূল আবহাওয়ার শিকার হয়েছে।
সম্ভাব্য প্রতিকূল আবহাওয়াঃ
অজৈব: ঠান্ডা শিষের গঠন থেকে শিষ বের হওয়া পর্যন্ত বাতাসের তাপমাত্রা ১৮০ সে.’র নিচে নেমে গেলে ধানগাছের জন্য খুবই অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে শিষ বের হওয়ার ২২-২৪ দিন আগে কাইচথোড় এবং ১০-১২ দিন আগে থোড় অবস্থায় ধানগাছ খুবই ঠান্ডা-কাতর। অসহনীয় ঠান্ডার ব্যাপ্তী দীর্ঘস্থায়ী না হলে আংশিক চিটা হয়। তবে আধাপাকা পর্যায়ে আবার যদি ঠান্ডার শিকার হয়, তবে দানা পুষ্টিতে বাধার সৃষ্টি হয়
গরম: ধানের জন্য অসহ্য গরম তাপমাত্রা হলো ৩৫০ সে.। ফুল ফোটার সময় ধানগাছ এ তাপমাত্রায় সবচেয়ে বেশী কাতর। ফুল ফোটার সময় ১-২ ঘন্টা ৩৫০ সে. তাপমাত্রা বিরাজ করলে ফসল মাত্রাতিরিক্ত চিটা হয়ে যায়
ঝড়ো বাতাস: শিষ বের হওয়ার সময়ে ঝড়ো বাতাস যথাযথ পরাগায়ণ, গর্ভধারণ ও ধানের মধ্যে চালের বৃদ্ধি ব্যহত করে। ফলে ধান চিটা হয়ে যেতে পারে। ধানের সবুজ তুষ খয়েরি বা কালো রঙ ধারণ করে। রাতের বেলার শুস্ক এবং গরম বাতাসের ঝড় সবুজ তুষকে কালো রঙে পরিবর্তন করে।
খরা: খরার কারণে ধানের শিষের শাখার বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ায় দানার সংখ্যা কমে যায়। কাইচথোড় পর্যায়ে খরা বিকৃত ও চিটা দানার জন্ম দেয়। থোড় পর্যায়ের খরায় প্রচুর দানা চিটা হয়ে যায়। শিষ বের হওয়ার সময় বা ফুল ফোটার সময় খরা হলে শিষ ভালভাবে বের হতে পারে না। ফলে চিটার সংখ্যা বেড়ে যায়। দুধ অবস্থায় খরার কারণে গাছের সঞ্চিত খাবার শিষে দ্রুত সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হয়।
প্রতিকারের উপায়: মৌসুম ভেদে ধানের প্রত্যেক জাতের বপন, রোপণের নির্দিষ্ট সময় মেনে চললে ঠান্ডা ও গরম এমনকি ঝড়ো বাতাস জনিত ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব।
বৃষ্টি-নির্ভর রোপা আমনের প্রজনন পর্যায়ে খরা থেকে পরিত্রাণের জন্য সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা জরুরি
জৈব: পোকামাকড় ও রোগবালাই’র আক্রমণে চিটার সংখ্যা অধিক হারে বেড়ে যেতে পারে।
by
সর্বশেষ মন্তব্যসমূহ