মুক্তিযুদ্ধের এক বিশেষ অধ্যায়; চুকনগরের গণহত্যা

image_78_2959“মানুষের যতগুলো অনুভূতি আছে তার মাঝে সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি হচ্ছে ভালোবাসা। আর এই পৃথিবীতে যা কিছু ভালোবাসা সম্ভব তার মাঝে সবচেয়ে তীব্র ভালোবাসাটুকু হতে পারে শুধুমাত্র মাতৃভুমির জন্যে”–মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ১৯৭১ সাল বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি রক্তঝরা অধ্যায়ের সূচনা হয়। যার হাত ধরে  দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন দেশের জন্ম হয়। সে দেশের নাম বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যে নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছিল তার এক অন্যতম নিদর্শন চুকনগরের গণহত্যা। ১৯৭১ সালের ২০ মে, সোমবার, আনুমানিক বেলা ১১টায় খুলনার বাগেরহাট, রামপাল, বটিয়াঘাটা, দাকোপ, এলাকার হিন্দু শরনার্থীসহ আনুমানিক প্রায় ১০,০০০ (দশহাজার) উদ্বাস্তু ভারতে শরনার্থী শিবিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। তারা ডুমুরিয়ার চুকনগরে পৌছানোর পর সাময়িক যাত্রা বিরতি দেয়। এসব লোকজন তাদের সাথে থাকা মালামাল যা বহন করা কঠিন বা অসম্ভব ছিল তা স্থানীয় লোকদের কাছে পানির দরে বিক্রি করে দিচ্ছিল। স্থানীয় কিছু রাজাকারের সদস্যদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তখন সাতক্ষীরা সীমান্তের পাক বাহিনীর একটি দল চুকনগরে চলে আসে এবং এইসব লোকদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। চুকনগর কলেজ এলাকায় পৌছে পাক বাহিনীর সদস্যরা গাড়ি থেকে নেমেই নির্বিচারে গুলি বর্ষণ শুরু করে। মুহূর্তেই সমগ্র এলাকাটি এক রক্তাক্ত প্রান্তরে পরিনত হয়। সেই সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা কয়েকজনের কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা জানান, ঘটনার আকস্মিকতায় সকলে হতবাক হয়ে যান। অধিকাংশই পালানর মত অবস্থায় ছিলেন না।  গুলি খেয়ে কেউ রক্তাক্ত অবস্থায় মরে পরে ছিলেন কেউ মুমূর্ষ অবস্থায় কাতরাচ্ছিলেন, কেউ বা আহত অবস্থায় নদীতে ঝাপিয়ে পড়েন। কিছু লোক পালিয়ে চুকনগর বাজারের কালী মন্দিরের বটগাছের তলায় আশ্রয় গ্রহণ করে, কিন্তু পাক বাহিনী জানতে পেরে ছুটে যায় কালী মন্দির প্রাঙ্গনে এবং বটগাছের শিকড়ের আড়াল থেকে লোকজনদের বের করে গুলি করে হত্যা করে। লাশের স্তুপ দেখে পাকিস্তানী বাহিনীর সদস্যরা নিজেরাই ভয় পেয়ে যায় এবং অসংখ্য লাশ গাড়িতে বহন করে নদীতে ফেলে দেয়। নদীর পানি লাল হয়ে যায়, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে সেই সময় নদীটিকে রক্তের নদী বলে মনে হয়েছিল। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, “বদ্ধভূমির কালী মন্দিরের কাছে এক নারীর মৃতদেহ পড়ে ছিল এবং তার সন্তান তখনও মায়ের দুধ পান করছে।”

ঘটনার পরদিন কিছু স্থানীয় লোকজন লাশ দাফনের কাজে নেমে পড়ে কিন্তু সেটা ছিল অসম্ভব। এত লাশের ফাফন কাজ করার মত লোকজন সেখানে ছিল না এবং এক পর্যায়ে তারা পালিয়ে যান। পরবর্তী বেশ কিছুদিন যাবৎ সেখানে মৃতদেহের পচা গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ছিল। শেয়াল, কুকুর শকুনের খাওয়ার পরেও লাশের স্তুপ যা ছিল তা দেখে পার্শ্ববর্তী মানুষ বিস্মিত হয়ে পরে এবং দীর্ঘদিন সেখানে মানুষ ভয়ে ঐ এলাকায় যেত না। ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পরেও নদীর পানি ছিল ব্যবহারের অনুপোযগী। সরকারী হিসাব মতে এই গণহত্যায় প্রায় ৫/৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় কিন্তু বেসরকারী হিসাবে এই সংখ্যা ৮/১০ হাজার ধরা হয়। এত সব মানুষের সম্পদ সব স্থানীয় রাজাকার এবং তাদের সহযোগীরা লুট করে। লুটেরা মৃত মানুষের বালিশ ছিড়ে এমনি কি হুক্কার মালা ভেঙ্গেও অর্থ/সোনা প্রভৃতি সন্ধান চালিয়েছিল। প্রায় সপ্তাহকাল ধরে গণহত্যায় মৃত ব্যক্তিদের স্বজনরা সেখানে ঘুরে ফিরেছিল প্রিয়জনের লাশটি পাবার জন্য। তখন স্বজনদের আহাজারিতে চুকনগরের আকাশ-বাতাশ ভারী হয়ে উঠেছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে চুকনগরের গণহত্যা একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। স্বাধীনতালাভের দীর্ঘদিন পর চুকনগর বাজার হতে কিছুটা দক্ষিন দিকে গণহত্যার স্মরণে একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। আজও সেই স্মৃতিস্তম্ভের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় স্বজনহারাদের একটি দীর্ঘস্বাস বধ্যভূমির বাতাসকে ভারী করে দিয়ে যায়।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ , , ,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *