জীববৈচিত্র্যে অনন্য সুন্দরবন- পর্ব-৩

র‍্যালবেঙ্গল টাইগার

র‍্যালবেঙ্গল টাইগার

ভুবন বিখ্যাত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার সুন্দরবনের নিঃসঙ্গ প্রাণী:

বাঘ (R oyal Bengol Tiger):ভুবন বিখ্যাত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার একমাত্র সুন্দরবনেই বাস করে। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বড় বিড়াল(panthera)গোত্রের সদস্য। এ গোত্রের অন্য সদস্যরা হ’ল সিংহ,চিতাবাঘ,স্নো-লেপার্ড ও জাগুয়ার।

খুর বিশিষ্ট জন্তু শিকারের ক্ষেত্রে বাঘ হ’ল বিশেষজ্ঞ। কোন জন্তু কে মরণ কামড়ে হত্যা করতে বাঘের তিক্ষ্ণ স্ব-দন্ত বিশেষ নকশায় তৈরী। অন্য দাতগুলির কাজ হ’ল শক্ত ভাবে ধরে রাখা এবং মাংস কেটে ফেলা। এর নখগুলি শিকার কে ধরা ও নিয়ন্ত্রনে রাখার কাজ করে। বাঘের গায়ের ডোরাকাটা দাগ একে বনের মাঝে সহজে লুকাতে সাহায্য করে। এর শক্তিশালী পা ও শরীর অল্প দূরত্বে ক্ষিপ্র গতিতে ধাবিত হতে পারদর্শী। সুন্দরবনের বাঘের প্রধান শিকার হ’ল হরিণ ও বন্য শুকর। তবে সুযোগ পেলে এরা সব ধরনের মাছই খেয়ে থাকে।

সারা বিশ্বে আট উপ-প্রজাতীর বাঘ পাওয়া যায় যার মধ্যে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার একটি।

বাঘ নির্দিষ্ট অঞ্চল বা সীমানায়(territory)বা নিজস্ব রাজত্বে বসবাসকারী নিঃসঙ্গ প্রাণী। মানুষের শংস্রবে আসতে এরা অপছন্দ করে। পরিণত বাঘ শিকার করে এবং একাকী বাস করে। একমাত্র যৌন মিলন অথবা লড়াইয়ের সময় অন্যের সাক্ষাতে আসে। বাঘ তার নিজস্ব সিমানা রক্ষা করতেই অধিকাংশ সময় ও শ্রম ব্যয় করে, কারণ এটা তাদের টিকে থাকার লড়াই। বাঘিনী জঙ্গলের বিশেষ কোন এলাকার দখল নেয়,যেখানে টিকে থাকার জন্য প্রচুর শিকার পাওয়া যায়। একটি বাঘ এমন একটি এলাকা পছন্দ করে তার বসবাসের জন্য যে এলাকার মধ্যে একাধিক বাঘিনী বাস করে। পুরুষ বাঘ তার এলাকার মধ্যে বসবাসরত বাঘিনীদের উপর প্রজননের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে এবং তার এলাকার মধ্যে অন্য পুরুষ বাঘদের প্রবেশ প্রতিরোধ করতে নিয়মিত টহলদারী অব্যহত রাখে। একটি পুরুষ বাঘের এলাকার মধ্যে দুই থেকে চারটি প্রজননক্ষম বাঘিনী বাস করে। বাঘ এবং বাঘিনী উভয়ই চিহ্ন দিয়ে তাদের উপস্থিতি জানান দেয় যাতে অন্য বাঘ সাবধান হয় এবং তার এলাকায় অনধিকার প্রবেশ না করে।

বাঘেরা দিনে-রাতে সব সময়ই শিকার করে,তবে সাধারণত বাঘ দিনের বেলা বিশ্রাম করে এবং রাতে শিকারে বা টহলে বের হয়। তীক্ষ্ণ শ্রবণ ও দৃষ্টি শক্তি ঘন জঙ্গলে তাদের শিকার চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। এরা হামাগুড়ি দিয়ে শিকারের খুব নিকটে পৌঁছে যায় এবং চূড়ান্ত আক্রমণে ক্ষিপ্র গতিতে ধাবিত হয়। শিকার প্রায়শই ফসকে যায়,কারণ শিকার এদের চলার শব্দ বা গায়ের গন্ধ পায় অথবা দেখতে পেয়ে পালায়।

১০০দিন থেকে ১০৪দিন গর্ভধারনের পর বাঘিনী দুই থেকে চারটি বাচ্চা প্রসব করে। বাচ্চারা খুব ছোট এবং অক্ষম থাকে। প্রথম ১০দিন বাচ্চারা চোখ খুলতে পারে না। দুই বছর পর্যন্ত বাচ্চারা মায়ের সাথে থাকে। প্রথম ছয় মাস এরা মায়ের দুধ পান করে। পরে শিকার ধরতে মায়ের কাছে ট্রেইনিং শুরু করে।

নিজস্ব এলাকার দখল না পাওয়া পর্যন্ত কোন বাঘ প্রজনন কর্মে লিপ্ত হয় না। যদি কোন বাঘ অন্য বাঘের এলাকা দখল করে তবে আগের বাঘের পুরুষ সন্তানদের সে মেরে ফেলতে চেষ্টা করে। এটা তাকে যত দ্রুত সম্ভব যৌন মিলনের নিশ্চয়তা দেয় এবং নিজের সন্তানদের জন্মদান নিশ্চিত করে। সাড়ে তিন বছর বয়সে বাঘিনীরা সন্তান প্রসবের উপযোগী হয়,কিন্তু একটি পুরুষ বাঘ পাঁচ বছর বয়সের আগে সাধারণত নিজস্ব এলাকার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয় না।

প্রচুর সংখ্যক বাঘ বাচ্চা বয়সে মারা যায়। তার চেয়েও বেশী সংখ্যক বাঘ মারা যায় যখন তারা মায়ের সঙ্গ ও এলাকা ছেড়ে বসবাসের জন্য নিজস্ব এলাকা প্রতিষ্ঠার খোঁজে বের হয়। যদি কোন বাঘ আহত  অথবা অন্য কোন কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শিকার ধরতে অথবা নিজের এলাকা রক্ষা করতে অক্ষম হয়,তখন সে বাঘটি মারা যায়। টিকে থাকার জন্য একটি নিজস্ব এলাকা প্রতিষ্ঠা ও তা রক্ষায় বাঘ এতই ব্যস্ত থাকে যে সন্তান-সন্ততী উৎপাদনের জন্য তারা কমই সময় পায়। প্রজনন ক্ষমতা সম্পন্ন একটি বাঘিনী বেঁচে থাকে ৮ থেকে ১৪ বছর সে ক্ষেত্রে প্রজনন ক্ষমতা সম্পন্ন একটি বাঘ বাঁচে ৬ থেকে ১২ বছর।

মেছো বাঘ

মেছো বাঘ

বাঘের অস্তিত্বের জন্য প্রধান হুমকি হ’ল বন উজাড় হওয়া। প্রতিনিয়ত বন ধ্বংস করা হচ্ছে,ফলে কমে যাচ্ছে বাঘের আবাস ভূমি। চোরা শিকারি (?) বা বাঘ ডাকাতদের হাতে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় বহু বাঘ মারা পড়ছে। বাঘের মাথা ও চামড়া বিপুল অঙ্কের টাকায় কালোবাজারীদের কাছে বিক্রি হয়। বাঘের হাড়ও অনেক দামে বিক্রি হয়, কারণ পূর্ব-এশিয়ার অনেক দেশের মানুষ বাঘের হাড় ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে তৈরী ঔষধ ব্যবহার করে।

বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী সুন্দরবন বাংলাদেশ অংশে প্রায় ৩৫০ থেকে ৪০০টি বাঘ আছে। তবে এ হিসাব নিয়ে সংশয়ের অবকাশ যথেষ্ট। কারণ ঝড়-জলোচ্ছাস,সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামবাসী ও চোরা শিকারীদের আক্রমণে প্রতিনিয়ত বহু বাঘ মারা পড়ছে।

বর্তমানে সুন্দরবনে বাঘ গননার একটি প্রক্রিয়া চলমান আছে। এতে ক্যামেরার ফাঁদ পেতে বাঘের ছবি নেওয়া হচ্ছে। এই ছবি দেখে বাঘের গায়ের ডোরাকাটা দাগ চিহ্নিত করা হবে এবং ডোরাকাটা দাগের পার্থক্য বিচার করে বাঘের সংখ্যা নির্ণয় করা হবে।

সুন্দরবনে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ছাড়া বিড়াল প্রজাতীর অন্য সদস্যরা হ’ল-

চিতা বিড়াল (Leopard Cat) ঃ চিতা বিড়াল নিঃসঙ্গ স্বভাবের নিশাচর প্রাণী। চিতা বিড়াল অত্যন্ত দক্ষ সাতারু এবং গাছে চড়তে পারদর্শী। এরা ৫০-৬০ ফুট উচু পর্যন্ত উঠতে পারে। সাধারণত এরা ইদুর জাতীয় প্রাণী শিকার করে। তবে বিভিন্ন ধরনের পাখি,সরিসৃপ ও কাঁকড়া এরা খেয়ে থাকে।

মেছো বাঘ (Fishing Cat): ছোট বিড়াল গোত্রের প্রাণীদের মধ্যে মেছো বাঘ সবচেয়ে বড় হয়। শক্ত-সমর্থ সুগঠিত শরীরের মেছো বাঘের থাবার ভেতরের ফাঁকা অংশ জোড়া লাগানো। এরা সাধারণত পানির তিরবর্তী এলাকায় বাস করে। এরা সাধারণত মাছ খায়। তবে ইদুর জাতীয় প্রাণী,পাখি,পোকামাকড়,সরিসৃপ এবং শামুক জাতীয় প্রাণীও খেয়ে থাকে। মেছো বাঘিনী বছরে দু’টি করে সাবক প্রসব করে।

বন বিড়াল (jungle Cat):বন বিড়াল একাকী প্রাণী। এরা দিনে-রাতে সব সময়ই শিকার করে এবং ঘন জঙ্গলে বিশ্রাম নেয়। বন বিড়াল ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী,পাখি,সরিসৃপ,ব্যাং ইত্যাদি শিকার করে। এরা মূলত বনের প্রান্তদেশে  ঘাস অথবা সর বনে বাস করে।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *