ধান উৎপাদনে আবহাওয়ার প্রভাব ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাঃ শেষ-পর্ব

বন্যা কবলিত এলাকায় লাগসই পদ্ধতি:

আমন মৌসুমের জন্যঃ

বন্যা কবলিত অঞ্চলে আমন মৌসুমে সাধারণত ধানের প্রাথমিক অবস্থায় অর্থাৎ বীজতলা এবং রোপণোত্তর কশি গজানো অবস্থায় বন্যার কারণে ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এমতাবস্থায় নতুন করে চারা উৎপাদন এবং রোপন করতে হয়, ফলে কৃষকদের খরচ বাড়ে, রোপন বিলম্বিত হয় এবং ফলন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম হয়।

বন্যায় কৃষকের করণীয়ঃ

দেশের বিভিন্ন এলাকার আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে যেখানে রোপা আমন মৌসুমে ১২-১৬ দিনের বন্যায় জলমগ্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেখানে ব্রি ধান-৫১ এবং ব্রি ধান-৫২ চাষ করে সন্তষজনক ফলন পেতে পারে।

বন্যার পর নতুন করে চারা রোপণের জন্য আলোক সংবেদনশীল জাত নির্বাচন করতে হবে। ব্রি আর-২২, ব্রি আর-২৩, ব্রি ধান-৩৭ এবং ব্রি ধান-৩৮ আলোক সংবেদনশীল জাত। ব্রি আর-২২, ব্রি আর-২৩ ও ব্রি ধান-৪৬ এর ৩০-৫০ দিন বয়সের চারা সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি (ভাদ্রের শেষ) পর্যন্ত রোপন করেও ভাল ফলন পাওয়া যায়। নাবী আমনের ক্ষেত্রে চারার বয়স ৪৫-৫০ দিন হলে ভার হয়।

বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর কাদাময় সমতল জমিতে ব্রি আর-১, ব্রি আর-১১, ব্রি আর-২২, ব্রি আর-২৩, নাইজারশাইল ইত্যাদি জাতের অঙ্কুরিত বীজ ধান সরাসরি বপন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে (ভাদ্রের মাঝামাঝি) বপন সম্পন্ন করতে হবে।

বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়া ব্রি আর-১১, ব্রি ধান-৩২, ব্রি ধান-৩৮ এবং ব্রি ধান-৩৯ জাতের ধান যদি সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে না গিয়ে থাকে, তবে পানি চলে যাবার পর নতুন করে কশি গজানোর শুরুতে পরিমিত ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করলে আবার ধান পুনরুদ্ধার হতে পারে এবং এতে ভাল ফলন পাওয়া যায়।

বন্যা কবলিত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি এমন ধানের জমি থেকে কশি ভেঙ্গে এনে ক্ষতিগ্রস্থ জমিতে রোপন করলেও ক্ষতি কিছুটা কমানো যেতে পারে।

বন্যার কারণে আমন ধান রোপণে অতি বিলম্ব হলে (সেপ্টেম্বরের প্রথমার্ধে বা ভাদ্রের মধ্যে) বরং আগাম বোরো ধান চাষের চিন্তা করা ভাল। নভেম্বরের মাঝামাঝি (কার্তিকের শেষে) চারা করে বোরো চাষ করলে অধিক ফলন পাওয়া যাবে। এতে আমনের ক্ষয়-ক্ষতিও বহুলাংশে পুষিয়ে নেয়া সম্ভব।

বোরো মৌসুমে কেবল পরিপক্ক অবস্থায়ই ধান হঠাৎ বন্যা বা আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এক্ষেত্রে অঙ্কুরিত বীজ ড্রাম সীডার দিয়ে সরাসরি বপন করলে অথবা হাতে ছিটিয়ে বপন করলে ধানের জীবনকাল ১০-১৫ দিন কমে আসে এবং বন্যার ক্ষতি থেকে বোরো ধান রক্ষা করা সম্ভব হয়।

ভাসমান বীজতলাঃ

ভাসমান বীজতলার পরিচিতি-

আমন মৌসুমে বন্যার পানি নেমে যাবার পর রোপা ধান চাষ বিলম্বিত হয়ে যায়। তখন উপযুক্ত বয়সের চারা উৎপাদন করার সময় থাকে না এবং বীজতলা করার উপযোগী জায়গাও পাওয়া যায় না। একারণে বিকল্প পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন ও রোপণের ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন-ভাসমান বীজতলা ও ডাপোগ বীজতলা।

ভাসমান বীজতলা তৈরী পদ্ধতিঃ বন্যার পানিতে ডুবে যাবার কারণে বীজতলা করার মত উঁচু জমি পাওয়া না গেলে অথবা পানি নেমে যাবার পর চারা তৈরীর জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া না গেলে ভাসমান বীজতলা তৈরী করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বন্যার পানি, পুকুর, ডোবা বা খালের পানির উপর বাঁশের চাটাইয়ের মাচা বা কলাগাছের ভেলা তৈরী কওর তার উপর ২-৩ সেন্টিমিটার পুরু কাদার আস্তর দিয়ে কাদাময় বীজতলার মতই বীজতলা করা যেতে পারে। এরপর স্বাভাবিক পদ্ধতির ন্যায় অঙ্কুরিত বীজ ঐ বীজতলায় ফেলতে হবে। বীজতলা যেন ভেসে না যায় সেজন্য খুঁটির সাথে বেঁধে রাখতে হবে। পানিতে ভাসমান থাকার কারণে এরূপ বীজতলায় সাধারণত পানি সেচের দরকার হয় না।

ডাপোগ বীজতলা তৈরী পদ্ধতিঃ ডাপোগ পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরী করা হয় পাকা মেঝে অথবা উচু স্থানে পলিথিন শীটের উপর। জমির চারদিকে কাঠ, ইট বা কলাগাছের বাকল দিয়ে চৌকোনা করে নিতে হবে। এরপর পলিথিন বা কলাপাতা (মধ্য শিরা তুলে নিয়ে) বিছিয়ে তার উপর ঘন করে অঙ্কুরিত বীজ বুনতে হবে। প্রতি বর্গমিটারে ১ কেজি পরিমান বীজ ফেলতে হবে এবং হাত বা এক টুকরা কাঠের সাহায্যে হালকা চাপ দিয়ে বসিয়ে দিতে হবে (দিনে দুই বার, ৩-৬ দিন পর্যন্ত)।

ডাপোগ বীজতলা পরিচর্যা এবং চারা ব্যবহারঃ

এরূপ বীজতলায় চারা মাটি থেকে কোন খাদ্য বা পানি গ্রহণ করতে পারে না বলে ৫-৬ ঘন্টা পর পর বীজতলা ভিজিয়ে দিতে হবে যাতে চারার শিকড় পানির সংস্পর্শে থাকে এবং শুকিয়ে মারা না যায়। এই পদ্ধতিতে বীজতলা করা হয় সেসব স্থানে, যেখানে পানি সরবরাহ নিশ্চিত আছে এবংআগাম চারা রোপন (অল্প বয়সের চারা) জরুরি। এরূপ বীজতলার জন্য স্বল্প পরিমান স্থান আবশ্যক। ৩০-৪০ বর্গমিটারের ডাপোগ বীজতলার চারা দিয়ে প্রায় এক হেক্টর জমি রোপন করা যায় এবং এক্ষেত্রে ১৪ দিনেই চারা রোপন উপযোগী হয়। ডাপোগ পদ্ধতির বীজতলার চারা সুবিধা জনক আকারে ভাগ করে নেয়া যায় এবং শিকড় বাইরে রেখে রোল করে নেয়া যেতে পারে। ডাপোগ পদ্ধতির চারা আকারে খুব ছোট ও দুর্বল থাকে বিধায় রোপণের মূল জমিতে অতিরিক্ত দাঁড়ানো পানি রাখা যাবে না, এতে চারা মারা যেতে পারে। এজন্য জমি সমতল করা জরুরি, যাতে কোথাও দাঁড়ানো পানি না থাকে। প্রতি গোছায় ৬-৮টি করে চারা রোপন করতে হবে। সাধারণত ডাপোগ বীজতলার চারা ও স্বাভাবিক পদ্ধতিতে কাদাময় বীজতলায় উৎপাদিত চারা একই রকম ফলন দিয়ে থাকে। ডাপোগ পদ্ধতির চারা ব্যবহারে বরং ধানের জীবন কাল কিছুটা কমে আসে।

মাঠ পর্যায়ে ব্রি ধান-২৯’র ফলন ও জীবনকালের উপর ডাপোগ ও কাদাময় বীজতলায় উৎপাদিত চারার প্রভাবঃ

চারার প্রকারঃ ডাপোগ বীজতলা

ফলন(টন/হেক্টর)- ৬.৬৮

জীবনকাল (দিন)- ১৫৪

চারার প্রকারঃ কাদাময় বীজতলা

ফলন (টন/হেক্টর)- ৬.৩২

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *