গণদূষণে মৃতপ্রায় ময়ূর নদ হতে পারে খুলনা মহানগরীর পানি সংকটের সমাধান

খুলনা মহানগরীতে দৈনিক পানির ঘাটতি ১০ কোটি লিটা

খুলনা সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি)’র ১২ লাখ জনগোষ্ঠীর পানির চাহিদা দৈনিক ২৪ কোটি লিটার। এর বিপরীতে ১৪ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে ওয়াসা।

গত ১৬ জানুয়ারি জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির জানুয়ারি মাসের সভায় ১০ কোটি লিটার পানির ঘাটতির তথ্য জানান খুলনা ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রেজাউল ইসলাম।

পানি সংকট থেকে উত্তরণঃ একদা স্রতস্বিনী স্বচ্ছ পানির আধার খুলনা মহানগর সংলগ্ন ময়ূর নদ এখন গণ অত্যাচারে মূমুর্ষূ , মৃত প্রায়। অথচ দুষণ মুক্ত হলে এ নদীই হতে পারে নগরবাসীর পানি সংকট থেকে উত্তরণের সহজ উপায়।

ময়ূর নদীর বর্তমান অবস্থাঃ সরেজমিনে অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, আলুতলা স্লুইস গেইট’র (যেখানে ময়ূর নদ রূপসা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে) নিকট থেকেই শুরু হয়  নদী জবরদখল ও দুষণ। তবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনের চকমথুরাবাদ মৌজা থেকে রায়ের মহল হামিদ নগর স্লুইস গেইট পর্যন্ত দুই পাশের নদী ব্যাপক ভাবে দূষণের মাধ্যমে ভরাট করে জবরদখল করে নেয় ভূমীদস্যুরা এবং সে স্থলে ঘরবাড়ি তৈরী করে, ফলে নদী এখানে সংকির্ণ খালে পরিণত হয়ে পড়ে, যা কেসিসি’র উদ্ধার অভিযানে কিছুটি মুক্ত হলেও পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় নি।

দূষণের কারণে নদী মরে যাওয়ায় সবচেয়ে বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়েছে নদীর দুই পাড়ের গ্রামবাসী, কারণ তাদের দৈনন্দিন জীবন ও চাষাবাদের প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা মেটাত এই নদী। নদীর দুই তীরের পুটিমারী গ্রামের আক্কাস, তেতুলতলা গ্রামের কোরবান আলী, চকমথুরাবাদের ধীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস সহ অন্যান্যদের অভিযোগ, দূষণের ফলে নদী আজ মৃতপ্রায়, ফলে পানির অভাবে তাদের জীবন-জীবীকা আজ হুমকির সম্মুখিন, তাদের দাবি দুষণ মুক্ত করে নদী খনন এখন জরুরী।

ব্যাপক দুষণের কারণে ময়ূর নদ এখন বিষাক্ত জলাধারে পরিণত হয়েছে। আলুতলা স্লুইস গেইট থেকে বুড়োমৌলভীর দরগাহ্ (এটুকু বর্তমানে এ নদীর সবচেয়ে চওড়া ও গভীর অংশ) পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার এলাকার পানি কিছুটা ভাল হলেও এর পর থেকে বিল পাবলা (নদীর উৎস মুখ) পর্যন্ত প্রায় আট কিলোমিটার এলাকার নদীর পানি দুষণে পচে গিয়ে কিছুটা ঘন হয়ে কালচে-বাদামী রং ধারণ করেছে। নদীর পানি থেকে ড্রেনের পানির দুর্গন্ধ আসছে, আর পুরো নদটাই এখন মশা প্রজনন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। নদীর পানি ভর্তি ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন মশার লার্ভা যা প্রতিদিন মশা হয়ে পঙ্গপালের মত পার্শ্ববর্তি গ্রাম ও খুলনা মহানগরের বাসিন্দাদের উপর হামলে পড়ছে।

নদী পাড়ের বিল পাবলা, লাইন বিল পাবলা গ্রামের রেবা রায়, লক্ষ্মিরাণী শিকদার, স্বপন বিশ্বাস, জতির্ময় শিকদার সহ গ্রামবাসীর আক্ষেপ, “ এ নদী ছিল আমাদের জীবনের প্রধান অবলম্বন। নদীর পানিতে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীর সকল কাজ ও চাষাবাদ চলতো। আমাদের পানির সমস্যা ছিল না, কিন্তু এই নদীই এখন আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। ঘরের সামনে পঁচা পানি নিয়ে বসবাস, এ পানি গায়ে লাগলেই বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ হয়, আর বিকাল হতেই পাল কে পাল মশা এসে বাড়িঘর সব দখল করে নেয়, গরু-ছাগল, শিশু আর পরিজনদের নিয়ে আমরা এখন দিশাহারা, এই নদীই এখন আমাদের নরক।”

নদী দুষনের প্রধান কারণ খুলনা সিটি কর্পোরেশনের ২২টি ড্রেনের মুখ এ নদীর সাথে সংযুক্ত আছে। এ ছাড়া নদীর পাড়ের অনেক বাসিন্দা বাড়ির পয় নিষ্কাশনের ড্রেনের মুখ নদীতে সংযুক্ত করেছেন। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, দুষণের দ্বারা নদী ধ্বংস করে নদীর জমি দখল করে নেওয়া প্রভাবশালীদের একটা কৌশল।

ময়ূর নদী নিয়ে একটি গবেষণাঃ আইডিআরসি বা ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট রিসোর্স সেন্টার, কানাডা’র (লোকাল এজেন্ট- বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট) উদ্যোগে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিন’র বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ড. দিলীপ কুমার দত্ত’র তত্ত্বাবধানে তাঁর বিভাগের শিক্ষার্থীগণ ময়ূর নদ’র উপর একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। গবেষণার শিরোনাম ‘কেসিসি ও এর আশপাশের এলাকার পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে ময়ূর নদ হতে পারে একটি বিকল্প।’

গবেষণায় বলা হয়েছে যে, ময়ূর নদ’র দৈর্ঘ্য (গবেষণা এলাকা আলুতলা স্লুইস গেইট থেকে রায়েরমহল হমিদনগর স্লুইস গেইট পর্যন্ত) ১১.৬৯ কিলোমিটার। নদীর গড় প্রস্থ ১২ মিটার থেকে ৮০ মিটার। নদীর তলদেশে জমে থাকা বর্জ্যের পরিমান গড়ে দেড় মিটারের অধিক। প্রাকৃতিক ভাবে ময়ূর নদ’র পানি ধারন ক্ষমতা ৭২ কোটি ৫৭ লাখ ৩২ হাজার ২৬৫ গ্যালন বা ৩৩০ কোটি ৯৩ লাখ ৩৯ হাজার ১২৮.৫৬ লিটার। বর্তমান ধারন ক্ষমতা ৫৫ কোটি ৬৫ লাখ ৪২ হাজার ৮২৪ গ্যালন বা ২৫৩ কোটি ৭৮ লাখ ৩৫ হাজার ২৭৭.৪৪ লিটার। নদীর সর্ব্বোচ্চ গভীরতা পুটিমারী-তালতলা এলাকায় ছয় মিটার। খুলনা সিটি কর্পোরেশনের প্রায় ২২টি ড্রেন এ নদীতে সংযুক্ত হয়েছে, যার মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ৪১ লাখ ৯৪ হাজার ২৫৮.৫৬ লিটার বর্জ্যপানি নদীতে পতিত হয়। এছাড়া নদী পাড়ের অনেক এলাকার মানুষ তাদের পয়নিস্কাষণ লাইন সরাসরি নদীর সাথে যুক্ত করেছে এবং নদী পাড়ের বাসিন্দারা তাদের সব ধরনের বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলে থাকে। হামিদ নগর এরাকায় নদী অত্যন্ত সরু। এখানে একটি স্লুইস গেইট আছে যার মাধ্যমে বীল পাবলা থেকে আসা পানি নিয়ন্ত্রণ করা হত, কিন্তু বর্তমানে এ স্লুইস গেইট অকেজো হয়ে পড়েছে। এই এলাকার নদী শুধু ময়লা ফেলার কাজে ব্যবহৃত হয়। এ এলাকায় জনবসতীর ঘনত্ব অত্যাধিক।  নদীর পানির গুনগত মান ১৫০০ পিপিএম’র বেশী যা প্রাণীকূলের ব্যবহারের যোগ্য নয়, তবে বর্ষা মৌসুমে নদীর সবচেয়ে গভীর ও চওড়া এলাকায় এ পরিমাণ অনেক কমে ব্যবহার যোগ্য মাত্রার কাছাকাছি হয়। নদী দুষণে দায়ী বর্জ্যরে ধরন বায়োলজীক্যাল। নদীর দুষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বায়োলজীক্যাল ট্রিটমেন্টই যথেষ্ট।

গবেষণার পরামর্শ : ময়ূর নদ বাঁচাতে নদী পূনঃখনন প্রয়োজন ( নদী খনন করা হলে এলাকাবাসী স্বেচ্ছা শ্রম দিতে প্রস্তুত আছে )। আলুতলা ও রায়েরমহল (হামিদনগর) স্লুইস গেইট সংস্কার এবং এর সঠিক পরিচালনা আবশ্যক।

গবেষকদের মতামতে বলা হয়েছে যে, ভূ-উপরিতলের জলাধার হিসাবে ময়ূর নদী হতে পারে একটি বিকল্প যা খুলনা মহানগরী ও এর আশপাশের এলাকার মানুষের সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে সক্ষম, যদি এর প্রকৃত সংস্কার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

এ নদীকে কি ভাবে ব্যবহার যোগ্য করা সম্ভব জানতে চাইলে ড. দিলীপ দত্ত বলেন, নদীর সমস্ত অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে নদীকে তার পূর্বের আয়তনে পূনঃখনন করতে হবে। এতে নদীর পানিধারণ ক্ষমতা বর্তমান হিসাবের চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পাবে। নদীকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করতে হবে। সুবিধা জনক এলাকায় একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বসাতে হবে এবং সিটি কর্পোরেশনের উল্লিখিত সকল ড্রেনের পানি ওই প্লান্টে নিয়ে যাওয়া হবে। এর ফলে নদী শুধু দুষনের হাত থেকেই রক্ষা পাবে না বরং প্রতিদিন ড্রেনের সরবরাহকৃত ১ কোটি ৪১ লাখ ৯৪ হাজার ২৫৮.৫৬ লিটার বর্জ্যপানি ট্রিটমেন্ট হয়ে নদীতে সংরক্ষণ করা বা নগরীতে সরবরাহ করা সম্ভব হবে, যা প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণকে বৃদ্ধি করবে। এছাড়া নদীর আপ-স্ট্রিম (রায়েরমহল) ও ডাউন-স্ট্রিম’র (আলুতলা) স্লুইস গেটের প্রয়োজন অনুযায়ী সংস্কার, রক্ষনাবেক্ষন ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর এসব কাজ সম্পন্ন হলে নগরীর প্রতিদিনের পানির ঘাটতি ময়ূর নদ থেকেই পুরণ করা সম্ভব হবে।

বিগত একযুগ যাবৎ ময়ূর নদী বাঁচাও আন্দোলন এখন গণদাবীতে রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন নাগরীক সংগঠন, পরিবেশবাদী সংগঠনসহ সব স্তরের সাধারণ মানুষের দাবী ময়ূর নদীকে বাঁচাতে হবে, একে নগরবাসীর ব্যবহার উপযুক্ত করতে এর অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও দুষণ মুক্ত করতে হবে।

ময়ূরনদী দুষনকারীদের বিরুদ্ধে কোন সংস্থা এখনও পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি। খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে উচ্চ আদালতের নির্দেশে নদী দুষণ ও দখলকারী প্রায় তিন শতাধীক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা উচ্চ আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে তবে নদী দুষণ কখনও বন্ধ হয় নি।

ময়ূরনদী দখলকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি-না জানতে চাইলে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের এস্টেট অফিসার মোঃ নুরুজ্জামান বলেন, ২০২০-২১ অর্থ বছরে খুলনা সিটি কর্পোরেশন ও জেলা প্রশাসন যৌথ উদ্যোগে ময়ূরনদীর অবৈধ দখল যতদূর সম্ভব উচ্ছেদ করে ডিমার্কেশন পিলার পুতে দিয়েছে যা এখনও সেভাবে আছে।

ময়ূরনদীর দূষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে কেসিসি’র নির্বাহী প্রকৌশলী ম্যাকানিক্যাল এন্ড কঞ্জারভেন্সি আব্দুল আজিজ বলেন, “খুব শিঘ্রই ময়ূর নদ দূষণের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। নদীর সমস্ত পানি ফেলে দিয়ে নদী সম্পূর্ণ খনন করা হবে। এজন্য সম্ভবত দুই-এক মাসের মধ্যেই দরপত্র আহবান করা হবে এবং নদী খননের পর দূষণমুক্ত রাখতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

ময়ূরনদী দূষণমুক্ত করতে কি ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সাইফুর রহমান খান বলেন, “আমরা নিদিষ্ট সময় অন্তর পানি পরীক্ষা করে প্রধান কার্যালয়ে প্রেরণ করি। এছাড়া এ মূহুর্তে আমাদের অন্য কিছু করনণীয় নেই।”

 

 

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *