মধ্যযুগের অন্ধকার পৃথিবী জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হয় রেনেসাঁ পুরুষ পয়গম্বর মোহাম্মদ (সঃ)’র নির্দেশনায়

ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রে ভারতবর্ষের মুসলমানদের উল্টো যাত্রা !

 

বায়েত-আল-হিকমা

প্রাচীন সভ্যতা বিশেষ করে গ্রিক সভ্যতার জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের অবসান ঘটে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংসের (পঞ্চম শতাব্দি, ৪৭৬ খৃঃ) মধ্য দিয়ে। আর শুরু হয় এক বর্বর উৎপিড়ন, অজ্ঞানতা, অন্ধকারের যুগ।

জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রগতির চর্চা নিষিদ্ধ হতে থাকে। লব্ধ প্রাচীন জ্ঞানের চর্চাও নিষিদ্ধ হয়। শুধু তথাকথিত ধর্মাধিশদের বিকৃত আদেশ-নির্দেশই সমাজের কর্তব্য নির্দেশিত হয়। সমগ্র ইওরোপে তখন প্রতিক্রিয়াশিল পোপতন্ত্র, আর খোদ ইওরোপের  রাজারাই পোপ’র প্রজা। একমাত্র পুরোহীততন্ত্রই ইওরোপের চালিকা শক্তিতে পরিণত হয়। আর সে পুরোহীততন্ত্র হ’ল সকল প্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য-দর্শন ইত্যাদির চর্চা নিষিদ্ধ। এ সবের চর্চার শাস্তি হ’ল আগুনে পুড়িয়ে মারা। এই অন্ধকার জগতের কেন্দ্রভূমি হ’ল ইওরোপ। বাকি দুনিয়ার অবস্থাও প্রায় তদ্রুপ।

এরকম এক অন্ধকার পৃথিবীতে আলোর দিশারী হিসেবে আবির্ভুত হন পয়গম্বর মোহাম্মদ (সঃ)। পয়গম্বর নিজেও জন্মগ্রহণ করেন বিভিষিকাময় ভয়ঙ্কর দুর্বিনীত কুসংস্কারাচ্ছন্ন বর্বর লুটপাট-খুনধর্ষণে জর্জরিত অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত এক আরবভূমিতে। সে সমাজ ছিল সকল প্রকার জ্ঞান চর্চায় অপারগ মানবিক চিন্তার পরিপন্থি। পয়গম্বর বলেন “সর্ব জ্ঞানের আধার হলেন আল্লাহ।” তিনি ঘোষণা করেন “ জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে পবিত্র।” “ মূর্খের ইবাদতের চেয়ে জ্ঞানীর নিদ্রা উত্তম।” “ জ্ঞান আহরণের জন্য সুদূর চীনদেশে যাও।” চীনদেশে যেতে বলে পয়গম্বর দুটি বিষয় পরিস্কার করেছেন। সেকালে আরব থেকে চীনের পথ ছিল ভয়ংকর দুর্গম, যেতে হলে জীবন বাজি রেখে যেতে হ’ত। আর চীনারা ছিল ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতার দর্শনে বিশ্বাসি। অর্থাৎ জ্ঞান আহরণের জন্য জীবন বাজি রাখো, আর জ্ঞানীর ধর্ম বিচার না করেই তাকে গুরু মানো।

উল্লিখিত হাদিসগুলি পয়গম্বরের অবশ্যকর্তব্য শ্রেণীর নির্দেশনামূলক হাদিস। এই নির্দেশনার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ ইসলামী জগৎ গড়তে চেয়ে ছিলেন পয়গম্বর। ইসলামী রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ডামাডোল শেষে পয়গম্বরের নিজ চাচা আব্বাস-ইবনে-আব্দ-আল মুত্তালিব’র বংশধর আবুল আব্বাস-আল সাফ্ফা আব্বাসী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করে ইসলামী জগতের শাসনভার গ্রহণ করেন ৭৫০ খৃষ্টাব্দে। আর উপরে উল্লিখিত হাদিসগুলি আব্বাসী খেলাফতের সংবিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

শুরু হয় ইসলামের নির্দেশনায় জগতের বদলে যাওয়ার ইতিহাস। ইসলাম কোন ঝাড়ফুক-তুকতাক ভিক্ষা কুড়ানোর ধর্ম নয়। শুদ্ধ জ্ঞানের আলোকে ইসলাম মধ্যযুগের চরম অনাচার অন্ধকার তুকতাকের ভুতুড়ে জগৎকে আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত করে পৃথিবীর শিক্ষকরূপে আবির্ভুত হয়।

জগৎ আবার অজ্ঞতার মূঢ়তার মূর্খ শেকল থেকে মুক্ত হ’ল। শুরু হ’ল প্রাচীন জ্ঞানজগতের পূনর্জন্ম , রেনেসাঁ। খলিফা আল-মনসুর (৭১৪-৭৭৫) ঘোষণা করেন, “ সমগ্র আরব দুনিয়ায় জ্ঞানের চাষ করতে হবে।”  তবে তাঁর বংশধর ও উত্তরসুরিগণ পরবর্তী পাঁচ শতাব্দীকাল যাবৎ শুধু আরব নয় সমগ্র দুনিয়ায় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চাষ করে সর্বোৎকৃষ্ট ফসল ফলিয়ে ছিলেন। তাদের হাতেই শুরু হয় রেনেসাঁ বা প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের পূনর্জন্ম। যার অধিকতর বিকাশ ঘটে তাদের যোগ্য ছাত্র উওরোপীয়দের মাধ্যমে।

আব্বাসী আমল হ’ল ইসলামের স্বর্ণযুগ তথা পৃথিবীরও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার স্বর্ণযুগ। আব্বাসীগণ পয়গম্বরের বাণী- ‘জ্ঞানীর কলমের কালি শহিদের রক্তের চেযে পবিত্র’ এই ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শুরু করেন এক অনুবাদ আন্দোলন। যা ছিল প্রকৃত অর্থে এক বিশাল জ্ঞান বিপ্লব। এ বিপ্লব সফল করতে তাঁরা হাজার হাজার কোটি টাকাই খরচ করেছেন শুধু নয়, এর গুরুত্ব বোঝাতে দেশ-বিদেশের সমকালিন সব পন্ডিতদের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং পান্ডিত্যের মূল্য অমূল্য এটা স্বীকার করে বিখ্যাত পন্ডিতদের অনুবাদকর্মের সমান ওজোনের স্বর্ণ প্রদান করে তাঁদের পারিশ্রমিক দেওয়া হ’ত। বাগদাদে গড়ে তোলা হয় অনুবাদ বিশ্ববিদ্যালয় “ বায়ত-আল-হিকমা” (৭৫৭ সালের নিকটবর্তী সময়ে) বা জ্ঞানালয়। সমগ্র পৃথিবী থেকে বিভিন্ন ভাষার হাজার হাজার পুস্তক সংগ্রহ করে শুরু হয় তার অনুবাদ, আর অনুবাদ কর্মে নিয়োযিত হন চীন, ভারত, গ্রীসসহ বিভিন্ন দেশের নির্দিষ্ট বিষয়ের বিখ্যাত পন্ডিতগণ, যা না হলে এসকল পুস্তকের অধিকাংশই হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যেত। মুসলিম অমুসলিম বিদ্যানগণ পৃথিবীর প্রাচীন জ্ঞান ভান্ডার অনুবাদ করতে থাকেন আরবী ও ফার্সী ভাষায়, এবং পরে হিব্রু,তুর্কী আর ল্যাটিন ভাষায়ও।

এ সময় রোমান,চীনা, ভারতীয়, পার্সিয়ান, মিশরীয়, আফ্রিকান, প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় গ্রীক ইত্যাদি সর্ব বিষয়ে বিশেষ করে এ্যাস্ট্রোনমি, আলকেমী, গনিত, মেডিসিন, অপটিকস্, ফিলোসফি, সাহিত্যসহ বহুবিধ বিষয়ের পুস্তকাদি সংগ্রহ, অনুবাদ, সম্পাদনা ও নতুন জ্ঞানের সম্মিলন হতে থাকে। রাজকীয় বিজ্ঞানীগণ সকল ক্ষেত্রে অবদান রাখতে থাকেন পুরাতনের সাথে নতুন আবিষ্কারের সম্মিলনে।

বায়েত-আল-হিকমা’র অনুবাদ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা ছিল অত্যন্ত সযত্ন ও নির্ভুল। একটি বই যেখানে পঠিত ও অনুদিত হ’ত, সে বইটি অনুবাদে এক বা একাধিক ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট ভাবে দায়িত্ব দেওয়া হ’ত। যেমন প্রকৌশল ও গনিত বিষয়ক পুস্তক অনুবাদের নিরিক্ষণের দায়িত্ব ছিল আবু-জাফর-ইবনে-মুসা-ইবনে সাফির (৮০০-৮৭৩) এবং তাঁর পরিবার। দর্শন এবং মহাকাশবিদ্যা বিষয়ক পুস্তক অনুবাদের নিরিক্ষকের দায়িত্ব ছিল ইবনে ফরকান আল-তাবারি, ইয়াকুব আল-কিন্দি (৮০১-৮৭৩)। ইবনে ইসহাক আল-হারানির দায়িত্ব ছিল ওষুধ বিষয়ক (Medicine) পুস্তকের।

এ সকল অনুবাদকগণ ছিলেন বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ, যারা একটি ঐক্যবদ্ধ ব্যবস্থাপনা ও উদ্দেশ্য নিয়ে চমৎকার শিক্ষার পরিবেশে অনুবাদ উন্নয়নে কাজ করতেন।

এ সময় প্রধান অনুবাদক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন হুনায়ন ইবনে ইসহাক আল-ইবাদি (৮০৮-৮৭৩)। তিনি ছিলেন খৃষ্টান। তিনি শতাধীক পুস্তক অনুবাদ করেন যার মধ্যে ছিল গ্যালেন (১২৯-২১৬)’র “ অ্যানাটমি অব দ্য ভেইন এন্ড আর্টারী।” তিনি ছিলেন একাধারে চিকিৎসক, দার্শনিক এবং লেখক। তিনি ফার্সি, গ্রীক, আরবী, সিরিয়াক, চিনাসহ বহু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। গ্যালেন, হিপ্পোক্রেটাস (৪৬০-৩৭৫ খৃঃপূঃ), সক্রেটিস (৪৭০-৩৯৯ খৃঃপূঃ), প্লেটো (৪২৪-৩৪৮ খৃঃপূঃ), অ্যারিস্টোটোল (৩৮৪-৩২২ খৃঃপূঃ), ডায়োসকরিডেস, টলেমী (১০০-১৭০), হোমার (খৃঃপূঃ নবম শতাব্দী) , পিথাগোরাস (৫৭০-৪৯০ খৃঃপূঃ), প্লটিনাস (২০৪-২৭০), ইউক্লিড (৩০০ খৃঃপূঃ), শুশ্রæত (৮০০-৭০০ খৃঃপূঃ, শুশ্রুত সংহিতার লেখক কাশিবাসি শুশ্রুত ছিলেন চিকিৎসক ও সার্জন), চরক (প্রথম শতাব্দী, তিনি ছিলেন কুশান সম্রাট কনিষ্ক’র চিকিৎসক), আর্যভট্ট (৪৭৬-৫৫০ খৃঃ, গনিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ), ব্রহ্মগুপ্ত (৫৯০-৬৬৮ খৃঃ, ব্রহ্মগুপ্তই হলেন ‘শূন্য’র আবিষ্কারক) হ’ল কয়েকটি নাম মাত্র যাদের বই তিনি অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর এ সকল কর্মকান্ডই পরবর্তীতে ইসলামী সাম্রাজ্য তথা তৎকালীন জগতের বিজ্ঞানের মেরুদন্ডে পরিণত হয়।

এ সময় প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়ান ম্যাথমেটিক্স, জিওমেট্রি অর্থাৎ ইউক্লিড, টলেমী’র জ্ঞানকে অরও উন্নয়ন ও পরিমার্জন করেন পারস্যের বিজ্ঞানী, গনিতবিদ আল-বিরুনী (৯৭৩-১০৫০) এবং আবু নাসের মনসুর (৯৬০-১০৩৬)।

গুন্দেসাপুর একাডেমীতে (ইরানের এই শহরটি রোমানদের তৈরী। সাসানিদ সম্রাট কোয়াত ও তাঁর পুত্র কাবুস এই শহরটিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের পিঠস্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন যার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে আব্বাসিগণ) এ সময় ব্যাপক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। পার্সিয়ান বিজ্ঞানী মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খাওয়ারিজমি তাঁর বিখ্যাত এ্যালজেবরা বিষয়ক পুস্তক “ কিতাব আল-জাবের ওয়াল-মুকাবালা” রচনা করেন। এই পুস্তকের নাম থেকে উৎপত্তি ‘এ্যালজেবরা’ শব্দের। তাঁকে এ্যালজেবরার জনক বলা হয়, যে ভাবে ডাকা হয় গ্রিক গনিতবিদ ডায়োফান্টাসকে। এ্যালগোরিজম এবং এ্যালগোরিদম নাম এসেছে খাওয়ারিজমির নাম থেকে। তিনি আরবী সংখ্যা তত্ত্বেরও প্রবর্তক।

ইবনে আল-হাইথাম (৯৬৫-১০৪০খৃঃ, দ্য ফাদার অব অপটিকস্)- হাইথাম তাঁর পুস্তক ‘বুক অব অপটিকস্-এ প্রাচীন পদ্ধতির উন্নয়ন ঘটান। তাঁকে এ বিষয়ে পৃথিবীর প্রথম প্রকৃত বিজ্ঞানী বলা হয়।

প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী পার্সিয়ান আবু আলী ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭) তাঁর এনসাইক্লোপিডিয়া- “The canon of medicine” এবং “The book of healing” রচনা করেন। এবং তার বিপুল সংখ্যক প্রবন্ধ-নিবন্ধ যা পরবর্তীতে বিজ্ঞানীদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে এবং ইওরোপিয় বিজ্ঞানীদের প্রত্যক্ষভাবে পথ প্রদর্শন করে নতুন নতুন আবিস্কারে।

জোতির্বিদ্যার ব্যাপক উন্নতি ঘটান আল-বাত্তানী (৮৫৮-৯২৯), নাসির আল-দিন আল-তুসি (১২০১-১২৭৪), মায়উদ্দিন উর্দি, ইবনে আল-সাতির (১৩০৪-১৩৭৫), আবু রুশদ্ (১১২৬-১১৯৮) সম্মিলিতভাবে জ্যোতির্বিদ্যার উন্নয়নে নতুন নতুন আবিস্কার সংযুক্ত করেন যা পরবর্তীতে কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩)’র হেলিওসেন্ট্রিক মডেল উদ্ভাবনে প্রত্যক্ষ অবদান রাখে। তাঁদের হাত ধরেই পরবর্তীতে ইওরোপে জ্যোতির্বিদ্যা প্রতিষ্ঠিত হয়।

মুসলিম আলকেমিস্টগণই ইওরোপীও আলকেমিস্টদের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেন। জাবের ইবনে হাইয়ান (৭২১-৮১৫) তাঁর বিভিন্ন আবিস্কার ও লেখনীর দ্বারা আল কেমির ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন।

মুসলিম দর্শিনিকগণ দর্শনেরও ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন। এ সময় প্রথম শুরু হয় এ্যারিস্টোটল, প্লেটোর দর্শনের অনুবাদ যা পরবর্তীতে নতুন দর্শনের ভিত গড়ে তোলে ও পুরনো দর্শনের অনেক কিছু পরিবর্ধন-পরিমার্জন ও সংযোজন সধিত হয়। আল-কিন্দি, আল-ফারাবী (৮৭২-৯৫০), আবু রুশদ্, আবু আলী ইবনে সিনা দার্শনিকগণ আধুনিক দর্শনের পথপ্রদর্শক হিসেবে ব্যাপক চিন্তাভাবনা ও কর্মকান্ড সম্পাদন করেন। তিন প্রধান দার্শনিক আল-কিন্দি, আল-ফারাবী ও আভেসিন্না (ইবনে সিনা’র ইওরোপীয় উচ্চারণ) সম্মিলিত ভাবে এ্যারিস্টোটেলিয়ানিজম ও নিও-প্লেটোনিজমসহ অন্যান্য দার্শনিক বক্তব্য ইসলামী দর্শনে প্রবর্তন করেন যা পরবর্তীতে পশ্চিমে প্রচার পায়। তাদের মৌলিক দার্শনিক কর্ম এবং চিন্তাভাবনা মধ্যযুগে খৃষ্টান দর্শনকে প্রভাবিত করে বিশেষ ভাবে থমাস এ্যাকুইনাস (১২২৪-১২৭৪)’র কর্মকান্ডের মাধ্যমে। আভেসিন্নাইজম মৌলিক দর্শনের স্বীকৃতি লাভ করে।

এযুগে প্রযুক্তিবিদ্যারও ব্যাপক উন্নতি হয়। অনেক মৌলিক আবিস্কার আধুনীক শিল্পবিপ্লবের দ্বার উন্মোচন করে দেয়। চীন থেকে আসে কাগজ শিল্প ( চীনে কাগজ শুধু অভিজাত শ্রেণীর ব্যবহারের অধিকার ছিল)। বাগদাদে প্রথম কাগজের কল প্রতিষ্ঠিত হয়। আব্বাসীদের নিকট থেকে সারা পৃথিবীর মানুষ কাগজের মন্ড থেকে কাগজ তৈরী করতে শেখে। চীনাদের মাধ্যমে গানপাউডার’র ব্যবহারও আব্বাসীরা রপ্ত করে এবং আরও উন্নত ফর্মূলা আবিস্কার করে যা তাদের মাধ্যমে ইওরোপে প্রবেশ করে। আব্বাসী প্রকৌশলীরাই প্রথম উইন্ডমিল আবিস্কার করেন। এ সময় তারা হাইড্রোপাওয়ার, উইন্ডপাওয়ার, পেট্রোলিয়াম (কেরসিন ডিস্টিলেশন) আবিস্কারের মাধ্যমে ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনোলজী বা প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটান এবং নানা রকম শিল্প গড়ে তোলেন। হরাইজন্টাল হুইল, ভার্টিক্যাল হুইল, গিয়ার, ক্রাঙ্কশ্যাফ্ট আবিস্কার ও এর মাধ্যমে নানাবিধ মেশিনারিজ আবিস্কার ও তার ব্যবহার শুরু হয়। ফলে মনুষ্য সমাজ শারীরিক শ্রম থেকে কল-কারখানার শ্রমের যুগে প্রবেশ করে। গড়েওঠে চিনি কল, টেক্সটাইল শিল্প, কাগজের কল, আধুনীক কামারশালা, সিল্কমিল, কার্পেটমিলসহ নানা জাতের কারখানা যা আসলে পৃথিবীর বুকে প্রথম শিল্পবিপ্লব। এ সকল যন্ত্রপ্রকৌশল আরবদের নিকট থেকে প্রথম ইওরোপের ইটালিতে ছড়িয়ে পড়ে (এর প্রধান কারণ ইটালিতেই প্রথম স্বাধীন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যার বিকশিত পরবর্তী রূপ ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব)। ইটালীর হস্তশিল্প গিল্ডগুলো রাজা ও জমিদারদের নিকট থেকে অনেকগুলি শহর কিনে নেয়, ফলে গিল্ডের নেতৃত্বে সেখানে স্বাধীন পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে ওঠার সুযোগ পায়। আর ইটালীর বনিকপুঁজি শিল্পপুঁজিতে রূপান্তরিত হওয়ার পিছনে প্রধান ভূমিকা রাখে ক্রুসেড বা তথাকথিত ধর্মযুদ্ধ। ইটালীর বিশেষ করে ভেনিসের ব্যবসায়ীরা তাদের বিশাল বিশাল বানিজ্য জাহাজ ক্রসেডারদের ধার দেয়, যার প্রধান শর্ত হ’ল জাহাজে যে লুটের মাল আসবে তা জাহাজ মালিকদের নিকটই তাদের বেধে দেওয়া দামে বিক্রি করতে হবে। দুই শতাব্দির (একাদশ শতাব্দির শেষ ভাগ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দির শেষ ভাগ) ক্রসেডে ইটালীর ব্যবসায়ীরা লুটের মালে ফুলেফেঁপে ওঠে। আর সেই থেকে ভেনিসের ভেনিস হয়ে ওঠা। ভেনিস হয়ে ওঠে ইওরোপের রানী, এটা ক্রসেড শেষে চতুর্দশ শতাব্দির প্রথমার্ধ, যে সময়টাতেই কথিত ইওরোপীয় রেনেসাঁ শুরু হয় বলে ইওরোপীয়দেরও দাবি।

স্বাধীন শ্রমিক ছাড়া পুঁজিবাদের বিকাশ সম্ভব নয়, যে কারণে আব্বাসী আমলে (রাজতন্ত্র) শিল্প বিপ্লবের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও পরবর্তী বিকাশ সম্ভব ছিল না। ইওরোপের ইটালীতে স্বাধীন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা শুরু হওয়ার ফলে সেখানে যন্ত্রশিল্পের আধুনীক বিকাশ শুরু হয় এবং ফরাসী বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পর যন্ত্রশিল্পের বিকাশের পথ উন্মুক্ত হয় অর্থাৎ যন্ত্রশিল্প স্বাধীন হয়। এর ফলে ইওরোপে অর্থাৎ ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সম্ভব হয়। কারণ ততদিনে ইংল্যান্ডের হাতে ভারতবর্ষ লুটসহ সাম্রাজ্যবাদী লুটের পুঁজি জমেছে।

এ সময় বিশ্বসাহত্যের অসাধারণ বিকাশ ঘটে যাকে বিশ্বসাহিত্যের স্বর্ণযুগ বললেও কিছুই প্রকাশ হয় না। যেমন বিপুল সংখ্যায় খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের আগমন ঘটে তেমন ভাবে সৃষ্টি হয় বিপুলায়তনের সাহিত্যকর্ম যা বিশ্বসাহিত্যে ধ্রুবতারা হিসেবে আজও চিহ্নিত হয়ে আছে।

এ সকল বিশ্বখ্যাত সাহিত্য শ্রষ্টাদের মধ্যে এমন সব মনিষিরাও আছেন যারা শুধু কবি-সাহিত্যিকই নন একাধারে জগৎবিখ্যাত গনিতজ্ঞ, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিকিৎসক, জ্যোতির্বিদসহ বহুমাত্রিক প্রতিভাধর মানুষ, যাদের মধ্যে আছেন আবুল কাশেম ফেরদৌসি তুসি (৯৪০-১০১৯/২৫), জালাল আদ-দিন মোহাম্মদ রুমী (১২০৭-১২৭৩), সেখ সাদী শিরাজী (১২১০-১২৯২), ওমর খৈয়াম (১০৪৮-১১৩১), আবু আলী ইবনে সিনা, আল-বিরুনি, আল-কিন্দি, আল-ফারাবী, আবু রুশদ, আত্তার অব নিশাপুর (১১৪৬-১২২১), নাসির আল-দিন (১২০১-১২৭৪), হাসান-ই-সাব্বা (১০৫০-১১২৪), ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬)সহ অজস্রর নাম যাঁরা সৃষ্টি করেছেন বিশ্বের দীর্ঘতম কবিতা মহাকাব্য শাহ্নামা, আরব্য রজনীর কাহিনী সহ অজস্রর কাব্য-মহাকাব্য গল্প-কাহিনী, যেন সমুদ্রের ঢেউ যার শুরু আছে শেষ নেই। বিশ্বের সাহিত্য রসিকদের কাছে যা কালজয়ী হয়ে আজও রসের ভান্ডার।

জ্ঞানের প্রায় সকল শাখায় আব্বাসীদের এই জ্ঞানবিপ্লব চলেছিল ৫শ’ বছরেরও অধিককাল যাবৎ তিন মহাদেশ তথা এশিয়া, আফ্রিকা আর ইওরোপের বিশাল ভূখন্ড জুড়ে। আব্বাসী সাম্রাজ্যের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল পয়গম্বরের নির্দেশনা তথা জ্ঞান চর্চা। তাই সাম্রাজ্য পরিচালিত জ্ঞানবিপ্লবের পিছনে তাঁরা হাজার হাজার কোটি টাকা ও মেধা-মনন ব্যয় করেছেন যা আজকের আধুনীক যুগেও বিরল। এ সব কিছুরই প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের ধর্মনিরেপেক্ষ সাম্যনীতির প্রতিষ্ঠা, জাতিতে জাতিতে সৌভ্রাতৃত্ব, আর সেটা সম্ভবও হয়েছিল অনেক ক্ষেত্রে। ইসলামের এই জ্ঞানবিপ্লব আব্বাসীদের পতনের সাথে সাথে শেষ হয়ে যায় নি। তাদের ধ্বংসকারী চেঙ্গিস-হালাকু খানের বংশধর তৈমুর (মুঘল সম্রাট বাবুর’র পুর্বপুরুষ) স্থাপিত সাম্রাজ্যই সে জ্ঞানপ্রদীপ প্রজ্জ্বলিত রাখে অরও প্রায় তিন শতাব্দীকাল অর্থাৎ শোড়োষ শতাব্দি পর্যন্ত।

ইসলাম তথা বিশ্বের নতুন জ্ঞানকেন্দ্র হয়ে ওঠে তৈমুর বংশের রাজধানী সমরখন্দ। তৈমুরের নাতি যুবরাজ উলুগ বেগ (১৩৯৪-১৪৪৯)’র হাতে সমরখন্দে গড়ে ওঠে জগৎ বিখ্যাত কালজয়ী বিদ্যাপিঠ ‘ উলুগ বেগ মাদ্রাসা’ যা প্রকৃতপক্ষে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়। উলুগ বেগ নিজে ছিলেন একজন মহাকাশ বিজ্ঞানী। তিনি টেলিস্কোপ ছাড়া খালি চোখে তারাদের নিখুত মানচিত্র (Star map) তৈরী করেছিলেন যা আধুনিক কালের বিজ্ঞানীরা আজও সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেন। এ মাদ্রাসায় ধর্মতত্ত্ব, বিশ্বসাহিত্যের পাশাপাশি আর যে সকল বিষয় পাঠ্য ছিল তার মধ্যে কয়েকটি হ’ল মহাকাশবিদ্যা, আবহাওয়া বিজ্ঞান, ভূপদার্থবিদ্যা, সমুদ্র বিজ্ঞান, ভল্কানোলজী বা আগ্নেয়গিরি বিদ্যা।

‘উলুগ বেগ’ আসলে ছিল একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়, এমন দাবি ফ্রেন্স ঐতিহাসিক, গবেষক পিয়েরে চুভিন’র।

আব্বাসীরা যখন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন তখন ইওরোপে সবচেয়ে বিখ্যাত রাজা ছিলেন গল’র রাজা শার্লিমেন (৭৪৬-৮১৪)। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংসের পর ইওরোপে প্রায় চার শতাব্দী কোন সম্রাট ছিলো না। ৮০০ খৃষ্টাব্দে রাজা শার্লিমেন বা শার্ল দ্য গ্রেট সম্রাট পদবী লাভ করেন। সে সময় ইওরোপে সাধারণ মানুষ লেখাপড়া জানতো না। লেখাপড়া সিমাবদ্ধ ছিল সিমিত আকারে কিছু অভিজাত এবং  মূলত যাজকদের মধ্যে, তাও শুধু লাতিন ভাষায় (যা ছিল বাইবেলের ভাষা) ধর্মতত্ত্ব। সম্রাট শার্লিমেনও লেখাপড়া জানতেন না। কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি তাঁর বিশেষ টান ছিল। তাই বৃদ্ধ বয়সেও তিনি লেখাপড়া শিখতে চেষ্টারত ছিলেন। তার রাজ্যে তিনি কিছু লেখাপড়া চালু করার চেষ্টা করেন। তাঁর পছন্দের বিষয়ে তিনি স্বাধীন ভাবে চলার চেষ্টা করেন কিন্তু পোপ’র সেটা না পছন্দ ছিল। ইওরোপ ছিল পোপের রাজ্য। পোপ ইওরোপের রাজারাদের ভাবতেন তাঁর প্রজা, আর বিভিন্ন বাস্তবতায় সেটাই সত্য ছিল। পোপ তৃতীয় লিও শার্লিমেনের স্বাধীন ভাবনায় ক্ষুব্ধ ছিলেন, যদিও তাঁকে তার শত্রুদের হাত থেকে শার্লিমেনই রক্ষা করে ছিলেন। পোপ লিও’র দাবি শার্লিমেনকে স্বাধীন চিন্তা ত্যাগ করতে হবে, অন্যথায় তাঁর রাজ্যাভিষেক হবে না। শার্লিমেন কিছুকাল রোঁয়াব দেখান, কিন্তু শেষপর্যন্ত পোপের পদতলে হাটু গেড়ে বসেন শর্লিমেন, আর পোপ তৃতীয় লিও তাঁর মাথায় রোমান সম্রাটের মুকুট পরিয়েদেন। শার্লিমেনের ক্ষমতা ছিলনা পোপের বিরুদ্ধাচরণ করা যদিও শার্লিমেন ফ্রান্স, জার্মানি, বেরজিয়াম, নেদারল্যান্ড, উত্তর স্পেন, উত্তর ইটালী জুড়ে বিস্তৃত এক বিশাল ভূখন্ডের সম্রাট ছিলেন। তাঁর রাজধানী ছিল জার্মানির পশ্চিমের আখেন শহরে ( তাঁর সমাধি পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছে এ প্রতিবেদকের)।

অথচ উমাইয়াদ ও আব্বাসীদ উভয় যুগেই মুসলিম স্পেন ছিল ইওরোপের জ্ঞানকেন্দ্র। সে সময় কর্ডোভা শহরে ২০টির অধিক লাইব্রেরী এবং ১০০টির অধিক মাদ্রাসা (স্কুল) ছিল। সেখানে মুসলিম অমুসলিম সকলেই বিনা বেতনে শিক্ষা পেত। নগরীতে ৯শ’টি গণস্নাগার ছিল, অন্যদিকে ক্যাথলিক চার্চ’র দৃষ্টিতে গণস্নানাগার ছিল অনৈতিক বিষয় এবং নিষিদ্ধ (Blasphemous) কর্ম (যে ঐতিহ্যে আজও ইওরোপের সাধারণ মানুষ স্নান বিমুখ)। সকল বিষয়ে পন্ডিৎগণ কর্ডোভাকে ইওরোপের জ্ঞানকেন্দ্রে (Intellectual hub) পরিণত করেন। উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় আল-হাকাম (৯১৫-৯৭৬) ’র রাজকীয় লাইব্রেরীতে ছয় লক্ষ পুস্তক ছিল। তিনি নিজে ছিলেন গ্রন্থকিট। ধর্মত্ত¡, দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান, গনিত, জ্যোতির্বিদ্যা, আবহাওয়া বিদ্যা, রসায়ন, এ্যালজেব্রা, স্থাপত্যবিদ্যা, মেডিসিন ও অন্যান্য বিষয়ের পুস্তক এবং শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল সেখানে।

“The History of the Moorish Empire in Europe”র লেখক S.P Scott বলেছেন, “এ সময় ক্যাথলিক ইওরোপ বাদে স্পেনের সর্বত্র জ্ঞান এবং শিক্ষার জন্য পঠন-পাঠন চালু ছিল। তখন ইওরোপের রাজারাও লেখাপড়া জানতো না, অথচ মুসলিম খলিফার ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে ছয় লক্ষ পুস্তক ছিল। ইওরোপের ৯৯ শতাংশ মানুষ ছিল অশিক্ষিত। অন্যদিকে কর্ডোভায় ৮শ’ স্কুল চালু ছিল। খলিফার সিমানার মধ্যে এমন কোন গ্রামও ছিল না যেখানে স্পেনের চরম দরিদ্র কৃষকের সন্তানটিও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল। এমন কি এমন একজন কৃষককেও খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য ছিল যে লিখতে এবং পড়তে জানে না। ইওরোপের পন্ডিৎ, গবেষক ও ছাত্রদের প্রধান গন্তব্য ছিল কর্ডোভা।”

মুসলিম কর্ডোভার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হ’ল তার বাসিন্দাদের মধ্যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ বৈসম্যহীনতা অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism)। সেখানে খৃস্টান-মুসলিম-ইহুদিসহ সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষ সমান সামাজিক সম্মান ও অধিকার ভোগ করতো যা তার ধর্মনিরপেক্ষতার ফসল। জ্ঞানের চর্চাই এই ধর্মনিরপেক্ষতার উৎস। আসলে পয়গম্বরের শিক্ষা এই ধর্মনিরপেক্ষতাই (সাম্য) সে সময়ের সমগ্র ইসলামী সাম্রাজ্যে মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে, যেটা তার আকাশচুম্বি সমৃদ্ধিরও মূলমন্ত্র।

ঐতিহাসিক ভিক্টর রবিনসন (victor Robinson) তৎকালিন স্পেনের কর্ডোভার সাথে সমগ্র ইওরোপের একটি প্রতিতুলনা করে বলেন- সূর্য ডোবার পর সমগ্র ইওরোপ যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত হ’ত কর্ডোভার রাস্তার ল্যাস্পের আলোয় শহর ঝলমল করতো। ইওরোপ ছিল নোংরা (Dirty), কর্ডোভা ছিল হাজার স্নানাগারের শহর। কর্ডোভার মানুষ প্রতিদিন তাদের অন্তর্বাস পরিবর্তন করতো, আর ইওরোপের চার্চ স্নানকে নিরুৎসাহিত করতো। ইওরোপের অভিজাতরাও নিজেদের নাম লিখতে জানতো না, কর্ডোভার শিশুরা স্কুলে যেত। ইওরোপের সাধারণ খৃষ্টান পুরোহীতরা (Monk) ব্যাপ্টিজমের সার্ভিসটুকুও পড়তে জানতো না।

কর্ডোভার ইহুদি, খৃষ্টান, মুসলমানরা শুধু শহর রাস্তাঘাট স্নানাগার লাইব্রেরী স্কুল-মাদ্রাসাই ভাগাভাগি করতো না, তারা তাদের স্বপ্ন ও আকাঙ্খাও ভাগাভাগি করতো।

ইসলামের এই জ্ঞানবিপ্লব বিকাশের অনেক পরে দ্বাদশ শতাব্দির প্রথম দিকে ইওরোপে অর্থাৎ ফ্রান্সে সোর্বন এবং ইংল্যান্ডে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সোর্বন নামেই বিশ্ববিদ্যালয়, মূলত ছিল ধর্মতত্ত্ব (Theology) শিক্ষার কেন্দ্র। আর অক্সফোর্ডও প্রথমদিকে মূলত তা-ই ছিল। ইংল্যান্ডের ধর্মজগতের প্রধান পুরোহীত হলেন  (অষ্টম হেনরী কর্তৃক ১৫৩৪ সালে রোমান পোপের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার  পর থেকে) ক্যান্টারবুরি চার্চ’র আর্চবিশপ। মধ্যযুগে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যান্টারবুরির আর্চবিশপ বিশেষ ক্ষমতা ভোগ করতেন পদাধিকারবলে। তাঁরা নীতিনির্ধারকও ছিলেন, এমনকি চ্যান্সেলরও, যেমন- উইলিয়াম লাউড (১৫৭৩-১৬৪৫) , দ্য চ্যান্সেলর এবং ক্যান্টরবুরির আর্চবিশপ।

আর এই ক্যান্টারবুরির যাজকদের সম্পর্কে বিশ্বসাহিত্যের দিকপাল, ইওরোপ তথা ইংল্যান্ডের বিখ্যাত সাহিত্যিক জিওফ্রে চসার (১৩৪০-১৪০০) তাঁর বিখ্যাত বই “ক্যান্টারবুরি টেলস্”-এ যা বলেছেন মধ্যযুগের ইওরোপের সেটাই প্রকৃত চিত্র। এই বইয়ে দেখা যায় মূর্খ দুশ্চরিত্র হতদরিদ্র পাদ্রিদের নিয়ে সমাজের মানুষ ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ আর তামাশা করছে। যদিও সেকালের ইওরোপে যাজোকরাই না-কি কিছুটা লেখাপড়া জানতো।

মধ্যযুগে ইওরোপে বার বার মহামারী  (প্লেগ) ও আভ্যন্তরীন যুদ্ধবিগ্রহে কয়েক কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। ফলে চাষাবাদ আর হস্তশিল্পের উৎপাদনে দীর্ঘকালীন সমস্যা দেখা দেয় এবং ইওরোপ দীর্ঘস্থায়ী আর্থিক সংকটে নিপতিত হয়। জনগণের মাঝে শিক্ষাবিস্তার একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। মধ্যযুগের ইওরোপে এই ব্যয় বহনের ক্ষমতা এবং গণশিক্ষার সংস্কৃতি ও দায় কোন রাষ্ট্রেরই ছিল না। পাশাপাশি ইওরোপ ছিল পোপের রাজ্য এবং পোপতন্ত্র ছিল সাধারণ শিক্ষার বিরোধী।

ইওরোপের আর্থিক দুরাবস্থা কাটাতে পোপের নেতৃত্বে শুরু হয় ক্রসেড বা ধর্মযুদ্ধের নামে প্রাচ্য লুটের ব্যবস্থা (লুটের সময় প্রাচ্যের খৃষ্টান রাজ্যও বাদ যায় নি)। ১০৯৬ সাল থেকে ১২৯১ সাল পর্যন্ত দুই শতাব্দী ধরে (মোট ৮টি অভিযান) চলে এই লুটপাট। জোয়ারের মত লুটের মাল আসতে থাকে ইটালিতে। আর এর পরই শুরু হয় ( ১৩৫০ সালের পর) সেই ইটালীতেই তথাকথিত ইওরোপীয় রেনেসাঁ। বিদ্যার আমদানী অনেক দিন থেকেই হচ্ছিল মুসলমানদের মাধ্যমে। এবার পয়সার আমদানীর সাথে সাথে তাদের লব্ধ জ্ঞানের অধিকতর বিকাশ বিশেষ করে ব্যবহারিক বিকাশ ঘটতে থাকে। তবে একে নিশ্চই জ্ঞানের পুনর্জন্ম বা রেনেসাঁ বলা চলে না। কারণ মুসলমানদের হাতে আরও ছয়শ’ বছর আগে তার পুনর্জন্ম ঘটে। ইওরোপে যা ঘটেছে তা হ’ল তার অধিকতর বিকাশ।

ইওরোপের সরকারগুলি সাম্রাজ্যবাদী। সারাপৃথিবী লুটেপুটে তাদের সমৃদ্ধি, আর্থিক সঙ্গতি। আর এটা করতে গিয়ে তারা সব ধরনের হিংস্রতা, মিথ্যাচার আর ভন্ডামীর আশ্রয় নিয়ে থাকে। নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধি-শক্তি সম্পর্কে তারা মিথ্যা প্রচার করে যাতে দেশে দেশে অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, নিপিড়িত মানুষ তাদের জ্ঞান-বিদ্যায় অগ্রগামী দেবতুল্য ভাবতে শেখে। তেমনই এক মিথ্যা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতবর্ষে প্রচার করেছিল আর তা হ’ল হরপ্পা-মোহেনজোদরো নাকি আর্য সভ্যতা অর্থাৎ ইওরোপীয় জাতির সভ্যতা। এটা আমাদের পাঠ্যপুস্তকেও পড়ানো হ’ত। তারা কিন্তু জেনেশুনে এই মিথ্যা প্রচার করেছে অন্য জাতির তুলনায় ইওরোপীয়দের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারের জন্য। একই কারণে একই ভাবে তারা রেনেসাঁ’র দাবিদার। এ রেনেসাঁ’র খোল-নোলচে যে মুসলমানদের সৃষ্টি, মুসলমানরাই যে তাদের শিক্ষক একথা ভুলেও তারা উচ্চারণ করে না। তারা জানে মিথ্যা বহুবার প্রচার করলে সথ্যের কাছাকাছি পৌঁছে যায়, যার বাহ্যিক সুবিধা অনেক।

ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রে ভারতবর্ষের মুসলমানদের উল্টোযাত্রা ঃ মাদ্রাসা আলিয়া কেন উলুগ-বেগ হয়ে উঠলো না? এর প্রধান কারণ হ’ল উলুগ-বেগ’র প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন একজন জ্ঞানপিপাসু প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, পন্ডিৎ ব্যক্তি। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল পয়গম্বরের নির্দেশ মুসলমানগণ জ্ঞানকে সবচেয়ে মূল্যবান বিষয় মেনে তার সাধনা করবে, সেই নির্দেশ মেনে ইসলামের যে জ্ঞানবিপ্লব চলছে তাকে আরও বেগবান করা, যাতে ইসলামের ঝান্ডাতলের পৃথিবী হয় সবচেয়ে পরিশিলিত, ধর্মনিরপেক্ষ, মনুষ্যজাতীর শান্তির বসতি।

অন্যদিকে মাদ্রাসা আলিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা ওয়ারেন হেস্টিংস জীবন শুরু করেন দাঙ্গাবাজ, ধূর্ত, জলদস্যু চরিত্রের এক কোম্পানীর একজন কেরানী হিসেবে। একজন ষড়যন্ত্রকারী, তস্কর ব্যক্তি হিসেবে তার নিজ দেশেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। বিখ্যাত পার্লামেন্টারিয়ান এডমন্ড বার্ক’র নেতৃত্বে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে (হাউস অব কমন্স)  হেস্টিংস’র বিচার (অভিশংসন) শুরু (১৭৮৮ সাল) হয় (স্পিচ অন দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া বিল)। বার্ক তাকে ”অপরাধের ক্যাপ্টেন জেনারেল”, “দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিকারী”, “নরকের মাকড়সা” এবং “শকুন” বলে অভিযুক্ত করেন।

হেস্টিংস’র উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষের মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণ করা। সারা পৃথিবীতে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রবর্তক হ’ল মুসলমানগণ। ভারতবর্ষের মুসলমানরা যাতে সেই ধারায় অগ্রণি হতে না পারে সেটাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। কাজেই মুসলমানদের শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ তারা নিজেদের হাতে রাখতে চায়, আর এজন্যই সবার আগে তারা ভারতবর্ষে তাদের প্রধান শত্রুর (মুসলমানদের নিকট থেকেই তারা রাজ্য কেড়ে নেয়) শিক্ষা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যস্ত হয়ে মাদ্রাসা আলিয়া খুলে বসে (অথচ সেই মাদ্রাসার শিক্ষাকে তারাই কোন দিন সরকারী স্বীকৃতি দেয় নি!)। আর এভাবেই তারা ভারতবর্ষের মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে নেয়।

অশিক্ষিতদের চেয়ে অর্ধশিক্ষিত মানুষ বেশী মূর্খ এবং হটকারী হয় এ জ্ঞান ব্রিটিশদের ছিল। আসলে মাদ্রাসা আলিয়া ছিল তাদের ষড়যন্ত্রের  অংশ, কোন বিদ্যাপিঠ তৈরী তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। ষড়যন্ত্র হ’ল মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষার নামে এমন শিক্ষা দেওয়া যাতে ইসলামের জ্ঞানবিপ্লবের মূল আরবি ভাষাটাই তারা না শিখতে পারে। আর আরবি ভাষা না শিখতে পারলে কোরআনসহ আরবিতে রচিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে হাজার-লক্ষ পুস্তক আছে তা কিছুই তারা বুঝবে না। শুধু মুখস্ত করে সার্টিফিকেটই পাবে কিন্তু কোন জ্ঞানই অর্জনে সক্ষম হবে না। ফলে শুধু সার্টিফিকেটধারী একটি বিভ্রান্ত জবুথবু সম্প্রদায় তৈরী হবে, যারা কোন দিনই ইসলামের জ্ঞানবিপ্লবের পথের সন্ধান পাবে না। তাই তাদের ইচ্ছামত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

আরবি ভাষা না জানার কারণে তাঁরা আরবি ভাষায় রচিত শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান সহ বিভিন্ন ধরনের পুস্তক অধ্যয়ন এবং আত্মস্থ করতে অক্ষম। আরবি ভাষায় কথা বলতেও অক্ষম। অথচ আরবি ভাষা-মাধ্যমে লেখাপড়া করে তাঁরা কেউ দাখিল (মাধ্যমিক), কেউ আলীম (উচ্চ মাধ্যমিক), কেউ ফাজিল ( ডিগ্রি) এবং কেউ কামিল (মাস্টার্স) পাসের সার্টিফিকেট পেয়েছেন! ঠিক যেমন ইংরেজদের (মেকলে) প্রতিষ্ঠিত (১৮৩৭ সালে) সাধারণ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী পড়ে সার্টিফিকেট পাচ্ছে কিন্তু তারাও ইংরেজীতে কথা বলতে পারে না, ইংরেজী পুস্তক স্বাভাবিক ভাবে অধ্যয়ন ও আত্মস্থ করতে পারে না! কি অদ্ভুত মিল! জনগণ পড়ছে সার্টিফিকেট পাচ্ছে কিন্তু আসলে শিখতে পারছে না। অথচ বিশাল ভারতবর্ষের অন্যান্য জাতির মানুষদের দাবি ভারতবর্ষে বাঙালীরাই সবচেয়ে বুদ্ধিমান জাতি। একজন প্রখ্যাত অবাঙালী জাতীয় নেতার (বালগঙ্গাধর তিলক) উক্তি- What Bengal thinks today India thinks tomorrow । বাঙালীদের মেধা ও বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে আর একজন বিখ্যাত পন্ডিত ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব পন্ডিত জওয়াহেরলাল নেহেরু তার ডিসকভারী অব ইন্ডিয়া বইতে বিস্তারিত মতামত ব্যক্ত করেছেন (এটা বাঙালী জাতিয়তাবাদ নয়, নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস)। আর আজ তাদের এ-কি দশা ? ২৪২ বছর যাবৎ মাদ্রাসায় পড়ে এবং ১৮৫ বছর যাবৎ সাধারণ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তারা আরবি এবং ইংরেজী ভাষাটাই শিখতে পারছে না! ভাষা শিক্ষা কি এতই কঠিন? অথচ ৬ মাস থেকে এক বছরের কোর্স করে বাংলাদেশ সহ সারা পৃথিবীর মানুষ যে কোন ভাষা শিখছে। তা হলে ষড়যন্ত্রটা কোথায় ? এখনও কারা চালু রেখেছে ? যাদের সার্টিফিকেট আছে তারা সকলেই শিখেছে বিনা ব্যাতিক্রমে এমন হতে হবে, অন্যথায় সার্টিফিকেট ভুয়া বলে প্রতিয়মান হবে।

ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশে আজ শিক্ষাদিক্ষায় সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষরা হ’ল মাদ্রাসায় পড়া মুসলমানগণ। অথচ অন্যদের চেয়ে তাদের মেধা কোন দিক দিয়েই কম নয়। আর এটাই হ’ল ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র। ব্রিটিশ তো বিদায় নিয়েছে সেই কবে, কিন্তু তাদের কাজ (ষড়যন্ত্র) এখনও চালু রেখেছে কারা ?

একটি অনুসন্ধান ঃ আলিয়া মাদ্রসার প্রাথমিক (ইফতেদায়ী), মাধ্যমিক (দাখিল ), উচ্চ মাধ্যমিক (আলিম ), ডিগ্রি (ফাজিল ) ও মাস্টার্স (কামিল ) এবং দারুল উলুম মাদ্রাসার বিভিন্ন শ্রেণীর ও এলাকার ছাত্র, মাদ্রসা শিক্ষক, আলিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল, মসজিদের ইমাম সহ মোট ৭৪ জনের সাথে তাঁদের শিক্ষা বিশেষ করে আরবি ভাষা শিক্ষা নিয়ে আলাপ হয়। এঁদের মধ্যে একজনও ছিলেন না যিনি আরবি ভাষা জানেন! তারা জানান মাদ্রাসায় তাদের পাঠ্য তালিকায় আছে আরবি বর্ণমালা, আরবি ব্যাকরণ, আরবি সাহিত্য এবং কোরআন ও হাদিস।

শ্রেণীকক্ষে পাঠদানকালে শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের সাথে আরবি ভাষায় কথা বলেন কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রত্যেক শিক্ষার্থী বলেছেন না তাঁরা আরবিতে কথা বলেন না। শিক্ষকগণ আরবি ভাষায় কথা বলতে পারেন কি-না জানতে চাইলে শিক্ষার্থীগণ বলেন যে না তাঁরা পারেন না। তাদের মাদ্রাসার কোন শিক্ষার্থী আরবি ভাষা জানে কি-না জানতে চাইলে কেউ কেউ বলেন যে দুই-একজন জানতে পারে। তারা আরবি মুখস্ত বলতে পারে অথচ তার মানে কেন জানে না এবং আরবিতে কেন কথা বরতে পারে না জানতে চাইলে তারা জানায় এর উত্তর তাদের জানা নেই।

একটি আলিয়া মাদ্রাসার (নাম প্রকাশ করা হ’ল না) শিক্ষকগণ শেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের সাথে আরবি ভাষায় কথা বলেন কি-না জানতে চাইলে মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল বলেন যে, না তাঁরা শ্রেণীকক্ষে আরবি ভাষায় কথা বলেন না। এ মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ আরবি ভাষা জানেন কি-না জানতে চাইলে ( এসময় তাঁর সামনে কয়েকজন শিক্ষক উপবিষ্ট ছিলেন) তিনি উপবিষ্ট শিক্ষকদের মুখের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করেন এবং একপর্যায়ে বলেন যে কেউ কেউ জানেন, তবে কে কে জানেন তা নির্দিষ্ট করে বলেন নি।

এ সকল বাস্তবতায় মাদ্রাসা শিক্ষাকে এবং মাদ্রাসা থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের এদেশে এখনও বিশেষ মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা হয় না এবং তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের দৃষ্টি তাঁদের প্রতি বিমাতাসুলভ। আবশ্য এর প্রধান কারণ উপযুক্ত শিক্ষা ছাড়াই শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সমাপ্ত হচ্ছে।

এই মাদ্রাসাই হতে পারে জ্ঞানবিপ্লবের নতুন দিগন্ত ঃ মাদ্রাসা শিক্ষা পিছিয়ে আছে, কিন্তু একটা বিশাল প্রতিষ্ঠান তো তৈরী হয়ে আছে যেখানে হাজার হাজার মেধাবী শিক্ষার্থীগণ উপস্থিত। দরকার শুধু ব্যবস্থাপনায় মৌলিক কিছু পরিবর্তন। সবার আগে প্রয়োজন কয়েক হাজার অরবি ভাষা জানা শিক্ষক তৈরী করা যারা শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের সাথে আরবি ভাষায় কথা বলবে এবং ধাপে ধাপে প্রাথমিক শিক্ষার কয়েক বছরেই শিক্ষার্থীরা আরবি ভাষা শিখতে সক্ষম হবে ( অন্যান্য বিষয়ও তারা পড়ছে)। আর এভাবে দেশে আরবি ভাষা জানা একটা বিশাল শ্রেণী তৈরি হবে।

বর্তমান বিশ্বরে সবচেয়ে ধনি ও সম্পদশালী অনেকগুলি দেশের ভাষা আরবি। মাদ্রাসা থেকে পাশ করা আরবি ভাষা জানা বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ যদি এ সকল দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ডে জড়িত হতে পারে তা হলে এর অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব কি হতে পারে সেটা এতই বিশাল যে তা অনুমানেরও আওতার বাইরে। তবে এ সুযোগ তৈরী হয়ে আছে, আর তা এই অবহেলিত মাদ্রাসাগুলোর কল্যাণেই। শুধু প্রয়োজন একটা বৈপ্লবিক সংস্কার।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *