বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জিয়াউদ্দিন চলেগেলেন

মুক্তিযুদ্ধের সাব সেক্টর কমাণ্ডার মেজর জিয়াউদ্দিন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ তার মৃত্যু হয়।

 মেজর জিয়ার বর্নাঢ্য জীবন: মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৯ নম্বর সেক্টরের সুন্দরবন সাব-সেক্টর কমান্ডার, রহস্য রোমাঞ্চে ঘেরা সুন্দরবন একটি স্বাধীন জাতির অভ্যুদয়, ৭৫ এর নভেম্বরের অভ্যুত্থান, গণবাহিনী এবং জানা অজানার রূপকথার নায়ক ও দুবলা ফিসারমেন গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন পিরোজপুরের সন্তান মেজর (অবঃ) জিয়াউদ্দিন আহমেদ।

 সুন্দরবনের ‘মুকুটহীন সম্রাট’ মেজর (অবঃ) জিয়াউদ্দিন আহমেদ (৭৫) ১৯৫০ সালের ডিসেম্বরে পিরোজপুর শহরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা অ্যাডভোকেট আফতাব উদ্দীন আহমেদ পিরোজপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৬৮ সালে পিরোজপুর ছাত্র ইউনয়িনের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী জিয়াউদ্দিন আহমেদ ১৯৬৯ সালে পাকিস্থান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন এবং সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনীর মেজর হিসেবে পশ্চিম পাকিস্থানে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জুলাই মাসে পাকিস্থান থেকে পালিয়ে এসে যোগ দেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। দায়িত্ব পান ৯ নম্বর সেক্টরের সুন্দরবন অঞ্চলের সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে।

 এরপর সুন্দরবন, বাগেরহাট, শরণখোলা, মংলা অঞ্চলে অসংখ্য সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানিদের পরাস্ত করেন। এর মধ্যে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ৭১ সালের ১৬ আগস্ট টানা ১২ দিন সম্মুখসমরে ১৩টি পাকিস্তানি সমুদ্র জাহাজ ডুবিয়ে দেয়ার ঘটনা উল্লেখযোগ্য। দেশের জন্য ১৯৭৩ সালে তাকে কারা ভোগ করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরবন অঞ্চলে শত্রুদমনে বিরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য তাকে মুকুটহীন সম্রাট উপাধি দেয়া হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ব্যারাকে ফিরে যান। পরে তিনি মেজর হিসেবে পদমর্যাদা পান।

 ৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু যখন সপরিবারে নিহত হন তখন তিনি ঢাকায় ডিজিএফআইতে কর্মরত ছিলেন। ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহি-জনতার বিপ্লবে তিনি অংশ নেন। এরপর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কর্নেল তাহেরের সৈনিক সংস্থার পক্ষে অবস্থান নিয়ে তার অনুসারীদের নিয়ে সুন্দরবনে আশ্রয় নেন। ৭৬ সালের জানুয়ারিতে সুন্দরবনে সেনা অভিযানে মেজর জিয়া গ্রেফতার হন। সামরিক আদালতে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি ও আ স ম আবদুর রব, মেজর জলিলসহ অন্যদের সঙ্গে মেজর জিয়াউদ্দিনকেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। এ নিয়ে তখন সারাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা আন্দোলন শুরু করলে আ স ম আবদুর রব, মেজর জলিলসহ অন্যদের সঙ্গে মেজর জিয়াউদ্দিনও ১৯৮০ সালে রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি লাভ করেন। ৮৩ সালে জেনারেল এরশাদের সময় মেজর জিয়াউদ্দিন দেশ ছেড়ে আশ্রয় নেন সিঙ্গাপুরে। এরপর ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে ছোট ভাই কামালউদ্দিন আহমেদ, ভাগ্নে শাহানুর রহমান শামীম ও কয়েককজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে চলে যান সুন্দরবনের দুবলার চরে।

 বনদস্যু বাহিনীগুলোর হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত সুন্দরবনের জেলেদের সংগঠিত করে শুরু করেন শুঁটকি মাছের ব্যবসা। ৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুন্দরবনের মূর্তিমান আতঙ্ক ডাকাত দল কবিরাজ বাহিনীর সঙ্গে শ্যালারচরে সরাসরি বন্দুকযুদ্ধ হয়। এতে নিহত হয় কবিরাজ বাহিনীর প্রধান কবিরাজ। মেজর (অবঃ) জিয়াউদ্দিন ১৯৮৯-৯১ সালে বিপুল ভোটে পিরোজপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর গড়ে তুলেন ‘সুন্দরবন বাঁচাও’ কর্মসূচি নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দুবলা ফিসারমেন গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কখনও জেলেদের নিয়ে, কখনও প্রশাসনকে সহায়তা দিয়ে ডাকাতদের নির্মূলে নায়কের ভূমিকা রেখেছেন তিনি। এ কারণে সুন্দরবনের একাধিক ডাকাত গ্রুপ বিভিন্ন সময়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এসব ডাকাত গ্রুপ জিয়াউদ্দিনকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। তিনি একাধিকবার হামলার শিকার হয়েছেন। সর্বশেষ মোর্তজা বাহিনীর সদস্যরা পূর্ব সুন্দরবনের হারবাড়ীয়া ও মেহেরালীর চর এলাকার মাঝামাঝি চরপুঁটিয়ায় মেজর জিয়াকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। বন্দুকযুদ্ধে মোর্তজা বাহিনীর চার সদস্য নিহত ও মেজর জিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। মেজর জিয়া মুক্তিযুদ্ধে নিজের ও অন্যদের অংশগ্রহণ এবং যুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে ‘সুন্দরবন সমরে ও সুষময়’ নামে একটি বই লিখেছেন।

 

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *