বাংলাদেশ জাতি বৈচিত্র্যের দেশ। বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্বা ও ভাষাভাষী মানুষ এ দেশে বাস করেন। দেশের বিভিন্ন অংশ জুড়ে বসবাস করছেন বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী।বাংলাদেশে আদিবাসী জনসংখ্যা কত এবং কয়টি আদিবাসী জাতি রয়েছে এ নিয়ে সঠিক তথ্যের অভাব রয়েছে। সরকারি তথ্যের সঙ্গে আদিবাসীদের দেওয়া তথ্যের ব্যবধান অনেক।তবুও সর্বজন গ্রাহ্য না হলেও প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যসূত্রের আলোকে অনেকাংশে গ্রহণযোগ্য মতামত অনুসারে বাংলাদেশে ৪৫টি আদিবাসী জাতির বসবাস এবং সবমিলিয়ে সংখ্যা হবে প্রায় ৩০ লাখ
স্বাধীনতার তিন যুগের বেশিসময়েও আমাদের দেশে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি বাস্তবায়িত হয় নি। অনেক কাল থেকেই তাঁরা অব্যাহত ভাবে বৈষম্য, প্রান্তিকীকরণ, চরমদারিদ্র্য, শোষণ ও বঞ্চনার শিকার।অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮(১ও৩) এ বলা হয়েছে “কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না। ” কিন্তু সংবিধানের একথাটির প্রতিফলন আদিবাসীদের জীবনে নেই, কারণ আদিবাসীদের অধিকার যে মানবাধিকার, এটির স্বীকৃতি এখনও মেলেনি। তাঁরা যুগ যুগ ধরে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের ক্ষেত্রে বৈসম্যের শিকার।অন্যদিকে যে ভূমিকে আদিবাসীরা মনেকরত তাদের অস্তিত্বের স্মারক, নিজভূমে এখন সেই ভূমির অধিকার দিনদিন সঙ্কুচিত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০-এ আদিবাসীদের ভূমি অ-আদিবাসীদের নিকট হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সরকারি বিধিনিষেধ থাকার পরও আদিবাসীরা ভূমি হারাচ্ছেন।
আইএলও কনভেনশনে ১০৭’র দ্বিতীয় অংশের ১১অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ” সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠির সদস্যদের ঐতিহ্যগত ভাবে অধিকৃত ভূমিরওপর যৌথ কিংবা ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার স্বীকার করতে হবে।” মূলকথা হলো আদিবাসীদের ভূমির কাগজ বা দলিল থাকুক বা না থাকুক যেভূমি ঐতিহ্যগত ভাবে আদিবাসীরা ব্যবহার করছেন সে ভূমি তাদের।বাংলাদেশ আইএলও কনভেশন ১০৭ সমর্থন করার পরও কোন সরকার আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ভূমির অধিকার কে স্বীকার করে ব্যবস্থা গ্রহণ করে নি। এর আলোকে আইন প্রণয়ন না করায় আদিবাসীরা ভূমি রক্ষা করতে পারছে না। তাঁরা তাদের আদি বসতভিটা, পেশা ও সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলা, ভাষা ও জীবনযাপন প্রণালী ধ্বংস হওয়া এমন কি নিজ অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
সাংবিধানিক অস্বীকৃতি, অধিকারহীনতা, ক্রমাগত ভূমি হারানো, আইনের আশ্রয় না পাওয়া, জীবনের নিরাপত্তাহীনতা ও হুমকি, উন্নয়নের নামে বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ, মিথ্যা মামলা ও হয়রানি, এ রকম বহুমাত্রিক সমস্যায় আদিবাসীরা জর্জরিত। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য আদিবাসীরা সব সময় উচ্চকিত থেকেছেন।
ঐতিহাসিক সাঁওতাল ও মুন্ডা বিদ্রোহ, তেভাগা ও টঙ্ক আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সহ সকল গণতান্ত্রিক সংগ্রামে তাঁরা সামিল হয়েছেন। অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে স্বাধীনতা-উত্তরকালে প্রাণ দিয়েছেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, কল্পনা চাকমা, আলফ্রেড সরেন, সত্যবান হাজং, পিরেন স্নাল, চলেশ রিছিল সহ অনেকে।
এই পটভূমিতে সর্বব্যাপী হতাশার মধ্যেও আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় ক্ষেত্রে কিছু আশার আলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এ গুলোর মধ্যে রয়েছে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর গৃহীত সিদ্ধান্ত (৪৯/২১৪)’র মাধ্যমে ৯ আগষ্ট কে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ ঘোষণা, ১৯৯৫-২০০৪সাল কে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক’ হিসেবে ঘোষণা। এর ধারাবাহিকতায় প্রথম দশক শেষ হওয়ার পর ২০০৫-২০১৪ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ কর্তৃক ‘আদিবাসী দ্বিতীয় দশক’ ঘোষণা করা হয়। জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্বের আদিবাসী জনগণের জন্য এই আন্তর্জাতিক ঘোষণা ছাড়াও আদিবাসী জনগণের মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত নিয়োগ এবং আদিবাসী জনগণের বিষয় নিয়ে আলোচানার জন্য জাতিসংঘে একটি ‘স্থায়ী ফোরাম প্রতিষ্ঠা’ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নি:সন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।
জাতীয় ক্ষেত্রে সরকার কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। পার্বত্যচট্রগ্রাম মন্ত্রণালয় ও পার্বত্যচট্রগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন, সমতল আদিবাসীদের জন্য স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স ডিভিশনের বাজেট বরাদ্দ চলতি অর্থ-বছরে কিছুটা বেড়েছে এবং অতি সম্প্রতি সমতলের আদিবাসীদের জন্য ইউনিয়ন পরিষদে সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।সেই সঙ্গে আদিবাসী ইস্যুতে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি সহ তাদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। মিডিয়াও অনেকটা এগিয়ে আসছে। এ সব উদ্যোগের ফলে আদিবাসীদের বিষয়ে দেশের মানুষ সচেতন হয়ে উঠেছে। এরই ধারাবাহিকতায় “ন্যাশনাল কোয়ালিশান ফর ইনডিজিন্যাস পিপলস” (এনসিআইপি) বাংলাদেশের ৬৪ টি জেলাকে ২১টি অঞ্চলে ভাগ করে গঠিত হয়েছে আদিবাসী বিষয়ক জাতীয় কোয়ালিশন। এরই অংশ হিসাবে বৃহত্তর খুলনায় (খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট) আদিবাসী বিষয়ক জাতীয় কোয়ালিশন’র আঞ্চলিক কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এই কমিটির নব-নির্বাচিত সভাপতি এম নাজমুল আজম ডেভিড’র কাছে সংগঠনের কার্যক্রম ও আগামীদিনের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংগঠনটি বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের আদিবাসীদের দুঃখ-দুর্দশার কথা জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছে দিতে সচেষ্ট হবে।এ ছাড়া আদিবাসীদের নাগরিক অধিকার, সুশাসন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, নারী ও শিশু অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংগঠনটি কাজ করবে বলে তিনি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
by
সর্বশেষ মন্তব্যসমূহ