গরীবের সুন্দরী-বৌ সুন্দরবনের কোন নিজস্ব গবেষণা কেন্দ্র নেই, নেই বৃক্ষ ও জীব-জন্তু’র রোগ-বালাই’র খতিয়ান এবং চিকিৎসা !

ভালোবাসার সাথে দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধ অংগাঙ্গি ভাবে জড়িত যা প্রকৃত প্রেমিকমাত্রেই যুগ যুগ ধরে প্রমাণ করে আসছেন। একজন ধর্ষক নিঃসন্দেহে ধর্ষণ করতে ভালোবাসে কিন্তু যাকে সে ধর্ষণ করে তার প্রতি ধর্ষকের কোন দায়িত্ব বা কর্তব্যের কোন প্রশ্নই আসে না, আর এখানেই প্রেমিকের সাথে ধর্ষকের পার্থক্য।

আমাদের দেশে সুন্দরবনের কথা উঠলেই মন্ত্রী-আমলা-বুদ্ধিজীবী থেকে আমজনতা সকলের ‘সুন্দরবন প্রেম’ উথলে উঠে উপচে পড়তে থাকে। সুন্দরবন কে সপ্তাশ্চর্য’র ‘লোগো’ বানাতে (অনলাইন ধন্ধার আড়ালে) এবং এটাকে সুযোগ করে যার যার ধান্ধা বাগাতে তথাকথিত ভোট প্রদানের হুজুগে কাপতে থাকে দেশ।

সকলের সেই উথলেওঠা ভালোবাসার সুন্দরবন প্রকৃত অর্থে কেমন আছে ? তার কি আদর-যত্ন হচ্ছে ? তার অসুখ-বিসুখ করলে কি চিকিৎসা হয় ? এ সব খবর কি সুন্দরবন প্রেমিকরা কখনও নেওয়ার চেষ্টা করছেন, না-কি ‘বিশ্বের বিস্ময় আমাদের সুন্দরবন’ এই আনন্দ ভোগ করছেন ধর্ষকের মত, প্রেমিকের দায়িত্ব-কর্তব্য ছাড়াই ?

বিষয়টি আশ্চর্য হলেও সত্য, বিশ্বের একক বৃহত্তম ও অনন্য (ইউনিক) সুন্দরবন’র নিজস্ব কোন গবেষণা কেন্দ্র বা গবেষণা ইনষ্টিটিউট নেই। ফলে সুন্দরবনের শত শত প্রজাতির মৎস্য সম্পদ, বৃক্ষ ও বন্যপ্রণীর জীবন যাত্রা, রোগ-বালাই, বংশবিস্তার ও পরিমাণ ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে কোনো গবেষণা লব্ধ তথ্য উপাত্ত বন বিভাগের নিকট নেই। এ অবস্থায় সুন্দরবনে ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে ছড়িয়ে পড়া তেলে বনের প্রাণ-বৈচিত্র্যে কি কি ক্ষতিকর প্রভাব ভবিষ্যতে দেখা দিতে পারে তা জানার জন্য প্রয়োজন গবেষণা, যার কোন ব্যবস্থা বন বিভাগের নেই। আর সংশ্লিষ্টগণের সাথে আলাপে জানা যায়, এ সকল বিষয়ে বন বিভাগের বিশেষ কোন আগ্রহও নেই। রহস্য জনক কারণে সুন্দরবনের নিজস্ব গবেষণা ইনষ্টিটিউট’র পরিবর্তে গবেষণা প্রকল্পই অধিক পছন্দ তাদের। এ অবস্থায় সুন্দরবনকে সুস্থ্যভাবে বাঁচিয়ে রাখতে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার কোন বিকল্প নেই। আর “তেল দুর্ঘটনার” পর সে দাবী আরও জোরালো হয়েছে।

এ দেশে গরু-ছাগল এমনকি কুকুর-বিড়ালও অসুখ হলে চিকিৎসা পায়, তাদের জন্য ডাক্তার আছে, আছে হাসপাতালও। কিন্তু আমাদের জাতীয় পরিচয় ও মর্জাদার প্রতিক এবং লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ ‘সুন্দরবনের’ অসুখ হলে তাকে মরতে হয় বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে! তার জন্য কোন চিকিৎসক নেই, হাসপাতাল তো দূরের কথা! ধুকে ধুকে অনেকেই হয়ত বিলুপ্ত অথবা বিলুপ্তির পথে, যার কোন পরিসংখ্যানও মিলবে না। আসলে লুটের মালের প্রতি দরদ বা কর্তব্যবোধ আশা করাইতো হাস্যকর ব্যাপার।

সুন্দরবনের প্রতি যত্ন ও কর্তব্য বিষয়ে যদি বলতে হয় তবে বলতে হবে, ‘সুন্দরবন হ’ল একটি এতিমখানা।’ এতিমখানায় এতিম শিশুরা যেমন অবহেলা ও বিনা যত্নে লালিত-পালিত হয় সুন্দরবনও সে ভাবে লালিত হচ্ছে! আর এতিমখানার অভিভাবকরা যেমন এতিমদের টাকা মেরে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়, সুন্দরবন সংশ্লিষ্টগণও সুন্দরবন লুট করে হচ্ছেন গণিমিয়া ।

প্রকৃত পক্ষে গরীবের সুন্দরী বৌ ‘সুন্দরবন’ হ’ল পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা, লুটের মাল। তাই সুন্দরবনের জন্য যত রকম ব্যবস্থাপনা আছে তার সবটুকুরই উদ্দেশ্য হ’ল ‘সম্পূর্ণ বিনা প্রযত্নে প্রাকৃতিক ভাবে’ সুন্দরবনে যে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার বহুমাত্রিক সম্পদ উৎপন্ন হচ্ছে তা আহরণ (লুট) করা, কোন আবস্থাতেই তাকে সংরক্ষণ করা নয়। আর এ প্রক্রিয়া সচেতন ভাবে শুরু হয়েছে বৃটিস ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী আমলে, আর তা একই ভাবে চলছে আজও এই স্বাধীন বাংলাদেশেও!

বৃটিস ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর জলদস্যুরা ১৭৫৭ সালে বাংলা দখলের পর বাংলার দেওয়ানী লাভ করে অর্থাৎ আইনী উপায়ে বাংলা লুটের ব্যবস্থা করে। ১৮২৮ সালে বৃটিস ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী সুন্দরবনের স্বত্বলাভ করে, এবং সুন্দরবন থেকে কি পরিমাণ সম্পদ লুট করা যাবে এ উদ্দেশ্যে ১৮২৯ সালেই সমগ্র সুন্দরবনের জরীপ শুরু করে। বৃটিস রানীর আমলে ১৮৭৮ সালে সুন্দরবন কে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করে বৃটিস সরকার এবং ১৮৭৯ সালে বন বিভাগের উপর সুন্দরবনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। মূলত বন বিভাগের দায়িত্ব হয় সুন্দরবনের সম্পদ সংগ্রহ করা, আদৌ সুন্দরবনের প্রাণ-বৈচ্যিত্রের বিকাশ এবং তার সংরক্ষণ নয়।

এ কারণে সুন্দরবনের প্রাণ-বৈচ্যিত্র নিয়ে গবেষণা এমন কি রোগবালাই প্রতিরোধে সামান্যতম কোন প্রতিষ্ঠান তারা গ’ড়ে তোলে নি! একই অবস্থা আজও বর্তমান !!

‘চামড়া আর শিং’ বিক্রি করে টাকা কামানোর লোভে বৃটিসরা মাত্র এক শ’ বছরের মধ্যে সুন্দরবন থেকে ‘গন্ডার, জল মহিস ও মার্স ক্রোকোডাইল বা ঝিল কুমিরের’ বংশ নিপাত করে ছেড়েছে। আজ আর সুন্দরবনে এদের অস্তিত্বও নেই।

অভাগা সুন্দরবন : যে সুন্দরী গাছের (এ বনের প্রায় ৭০ শতাংশ সুন্দরী গাছ,বন বিভাগের প্রদেয় তথ্য) নামে নাম হয়েছে সুন্দরবন, সেই সুন্দরী গাছ আজ ব্যাপক হারে মারাত্মক রোগে আক্রান্ত। বন বিভাগ এ রোগের নাম জানে না, কেন এ রোগ হয় তাও জানে না ! এ রোগে আক্রান্ত গাছের মরণ শুরু হয় গাছের আগা থেকে, তাই বন বিভাগের বোদ্ধারা (এবং অন্যান্য খয়ের খাঁ তালকানারা) এ রোগের নাম দিয়েছেন ‘আগামরা’ রোগ। প্রায় আড়াই দশকের বেশী সময় যাবৎ এ রোগের প্রাদুর্ভাব পরিলক্ষিত হলেও এ রোগের প্রতিকার নিয়ে বন বিভাগের কোনো মাথা ব্যাথা নেই।

বিগত ২০১২ সালে সুন্দরবনের কয়েকটি পয়েন্ট’র পানি পরীক্ষা ও বেশ কিছু এলাকা নিরিক্ষণ অন্তে এ প্রতিবেদকের নিকট প্রতিয়মান হয় যে সুন্দরী গাছের আগামরা রোগে আক্রান্ত গাছের পরিমাণ বিগত সময়ের তুলনায় কম। এ সময় সুন্দরী গাছের আগামরা রোগ বিষয়ে অধিকতর তথ্য’র জন্য যোগাযোগ করা হয় খুলনাস্থ সুন্দরবন বন বিভাগে। তখন বিভাগীয় বন অফিসার সহ অন্যান্যরা জানান, সুন্দরবন বন বিভাগ শুধু প্রশাসনিক কাজ করে। সুন্দরবনের নিজস্ব কোন গবেষণা কেন্দ্র আজ অবধি তৈরী হয় নি, ফলে উদ্ভিদ ও জীবজন্তুর কোন রোগবালাই প্রতিরোধ ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কোন কাজ বা কোন ধরনের গবেষণা বা পরীক্ষা-নিরিক্ষামূলক কর্মকান্ড তারা করেন না। তাদের একমাত্র কাজ হ’ল বন পাহারা দেওয়া এবং বনের সম্পদ আহরণ করা। তাই তাদের নিকট বনের গাছপালার রোগ-বালাই বা অন্য কোনো সমস্যা সংক্রান্ত কোন প্রকার তথ্য নেই !

সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও প্রাণী সম্পদ : সুন্দরবনের প্রাণী ও উদ্ভিদ সম্পর্কে বন বিভাগের প্রদেয় তথ্যানুযায়ী, সুন্দরবনে ২০ থেকে ২২ প্রজাতীর ম্যানগ্রোভ সহ ৩৩৪ প্রজাতীর উদ্ভিদ, ১৬৫ প্রজাতরি শৈবাল ও ১৩ প্রজাতীর অর্কিড পাওয়া যায়। এ ছাড়া ২১০ প্রজাতীর সাদা মাছ, লবস্টার সহ ২৭ প্রজাতীর চিংড়ি, ১৩ প্রজাতীর কাঁকড়া ও ৪২ প্রজাতীর মলাস্কা, লবন ও মিষ্টি পানির কুমির, কচ্ছপ সহ ৩৭৫ প্রজাতীর বন্যপ্রাণী এবং তিন শতাধিক প্রজাতীর পাখি বাস করে সুন্দরবনে। তবে এ সকল তথ্য কতটুকু সঠিক ও তথ্য নির্ভর তা নিয়ে আছে বিস্তর সন্দেহ, কারণ এগুলি কোন গবেষণালব্ধ তথ্য নয়।

বৃহত্তম মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র : সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রগুলির মধ্যে অন্যতম। প্রতি বছর শত শত প্রজাতীর হাজার হাজার টন মাছ উৎপাদিত হয় সুন্দরবনে। এ সকল মাছের উৎপাদন ও রোগ-বালাই নিয়ে সুন্দরবন বন বিভাগের কোন গবেষণা নেই। প্রতিনিয়ত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বর্তমানে এ সকল মৎস্য প্রজাতীর সবগুলি টিকে আছে কি-না, অথবা এদের মধ্যে কোন প্রজাতী বিলুপ্ত হয়েছে কি-না বা কোন প্রজাতী বিলুপ্তির হুমকির সম্মুখিন কি-না, এর কোন সঠিক তথ্য পাওয়ার কোন উপায় নেই, কারণ এ সকল বিষয়ে বন বিভাগের নিকট গবেষণামূলক কোন তথ্য নেই এবং এ ধরনের কোন সমস্যা নিয়ে বন বিভাগ কোন কাজও করে না অর্থাৎ এগুলো বনবিভাগের কাজের আওতায় পড়ে না।

সুন্দরবন বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রমতে, সুন্দরবনে কত প্রজাতীর বিণ্যপ্রাণী আছে এর সুনির্দিষ্ট কোন পরিসংখ্যান বনবিভাগের নিকট নেই। সুন্দরবনের নিজস্ব কোন গবেষণা কেন্দ্র না থাকায় মাঝে মাঝে অন্যের সহয়তায় কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। বর্তমানে ভারতের সহায়তায় ক্যামেরা ট্রাপ’র সাহায্যে চলছে বাঘ গননা প্রকল্প। এ ছাড়া একতি বে-সরকারী সংস্থা লবন পানির কুমির সুরক্ষা ও সংরক্ষণের উপর কাজ করছে। তবে সুন্দরবন নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন গবেষণার কোন সুযোগ বন বিভাগের নেই বলে জানায় সূত্রটি।

এ অবস্থায় সুন্দরবনের সুস্থ্যভাবে টিকে থাকা ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য জরুরী ভিত্তিতে সুন্দরবনের নিজস্ব গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ ,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *