জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি

কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানে সর্বোচ্চ ৭ দিনের জন্য বায়ুমন্ডলে বিরাজমান অবস্থার রূপ হচ্ছে আবহাওয়া। জলবায়ু বলতে জল এবং বায়ু এই দুইটির সংমিশ্রণের ফলাফলকে বোঝায়। মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে ভূ-পৃষ্ঠের নানা ধরনের জিনিস অপরিকল্পিত ভাবে ব্যাবহার করছে। মানুষ তাদের প্রয়োজন মেটানোর সময় কখনো চিন্তা করে না যে, এর ফলে পরিবেশের বা অন্য কোন সৃষ্টির প্রতি কোন প্রকার প্রভাব পড়ছে কিনা। মূলত এই কারণেই মানুষ আজ পরিবেশের নির্মমতার শিকার হচ্ছে। জল এবং বায়ু’র সাথে সম্পৃক্ত সকল কিছুর অপরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট সমস্যাই হলো জলবায়ুর প্রভাব।

জলবায়ু পরিবর্তন কি এবং কেন? বায়ুমন্ডলে গ্রীনহাউজ গ্যাসের (কার্বন-মনো-অক্সাইড, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লুরো কার্বন, সালফার, মিথেন প্রভৃতি) পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় পূথিবীর উষ্ণতা দ্রুত হারে বাড়ছে। আর উষ্ণতার ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে। উপরন্ত গরমের প্রতিক্রিয়ায় সমুদ্রের পানির প্রসার ঘটছে। এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। সমুদ্রের এই বর্ধিত পানিরাশি উপকূল এলাকা প্লাবিত করবে। বায়ুমন্ডলে এই উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ছাড়া আরও কিছু পরিবর্তন ঘটছে। যেমন, বৃষ্টিপাতের পরিমান কোথাও কমে যাওয়া, আবার শীত প্রধান এলাকায় শীতের প্রকোপ আরও বেড়ে যাওয়া প্রভৃতি। অবশ্য সাধারণভাবে আমরা জানি, ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ বছরের গড় আবহাওয়াকেই জলবায়ু বলা হয়।

সৃষ্টির স্বাভাবিক নিয়ম হ’ল পরিবর্তন, সেই নিয়মে পৃথিবীর সবকিছুই পরিবর্তনশীল। প্রতি মূহুর্তে পৃথিবীর সবকিছুই পরিবর্তন হচ্ছে বা সকল বস্তুর বিবর্তন ঘটছে। একই ভাবে জলবায়ুরওএকটা স্বাভাবিক পরিবর্তন আছে।বায়ু স্তরে অতি মাত্রার গ্রীনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ এই স্বাভাবিক পরিবর্তনকে এক অস্বাভাবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে বিপজ্জনক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। ধনী দেশগুলোর শিল্প-কল কারখানা এবং সে দেশগুলোর নাগরিকদের আরাম আয়েশের জন্যে ব্যবহৃত গাড়ি, এয়ার-কন্ডিশন প্রভৃতি থেকে এই গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গত হচ্ছে। আর ধনী দেশগুলোর এই আরাম আয়েশের বিষে আমাদের মত উপকূলীয় দেশগুলোর বিপন্নতা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।

সাধারণভাবে বিজ্ঞানীরা এই গোটা পরিবর্তনকে জলবায়ু পরিবর্তন বলছেন। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, জলবায়ুর এই অস্বাভাবিকপরিবর্তনের ফলে ঘূর্নিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, এসিড বৃষ্টি প্রভৃতির মত দুর্যোগ এবং এর ফলে প্রাকৃতিক ধ্বংসযজ্ঞ বেড়ে যাবে। ২০০৭ এবং ২০০৯’র দুটি ঘূর্নিঝড়- সিডর এবং আইলার প্রচন্ডতা এই আশঙ্কার বাস্তবতা প্রকাশ করেছে।

পৃথিবী পৃষ্ঠে সব থেকে উপকারি হচ্ছে গাছ, তার কারণ গাছ পৃথিবীর বায়ুমন্ডল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে অক্সিজেন প্রদান করে, যার ফলে পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক থাকে। মানুষ তার প্রয়োজনে গাছ-পালা কেটে নিজ প্রয়াজনে ব্যবহার করছে কিন্তু তাদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য পরিবেশের ক্ষতি বিবেচনায় আনছে না।

বর্তমানে বিশ্বের প্রয় অধিকাংশ মানুষ জলবায়ুর প্রভাব সম্পর্কে অবগত। পরিবর্তিত অবস্থায় বিশ্বের সব থেকে অসহায় সমুদ্র উপকূলের বাসিন্দারা, কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়ে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে আর এ কারণেই সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে আর পৃথিবীর নিম্নাঞ্চল হুমকির মুখে পড়ছে। জলবায়ু অস্বাভাবিক পরিবর্তন মানবসৃষ্ট কারণেই হচ্ছে। মানুষ তার ব্যবসায়ীক লাভের লোভে সচেতন ভাবে ফসিল জ্বালানী পুড়িয়ে ব্যাপক কার্বন উৎপাদন করছে যা মূলত জলবায়ু অস্বাভাবিক পরিবর্তনের প্রধান কারণ।

জলবায়ু পরিবর্তন যে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সমস্যা তা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করার লোক বিশ্বে খুব কমইপাওয়া যাবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী নানা কর্মসূচী চোখে পড়ছে। কেউ প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই পরিবর্তনের মোকাবেলা করতে চায়, কেউ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানে বিভিন্নভাবে উদ্যোগী হয়েছেন। কেউ কেউ জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রাকৃতিক কারণ হিসেবে মেনে নিয়ে এর সাথে অভিযোজন করার বা মানিয়ে নেওয়ার বিভিন্ন কৌশল উদ্ভাবন করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের হার ক্রমাগত বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে কী পরিণতি হবে সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা নানাভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন।

জলবায়ু পরিবর্তনে কার্বনের ব্যাপক প্রভাব প্রশমিত না হলে এশিয়ার গ্রীষ্ম-মন্ডলীয় অঞ্চলের ১০০ কোটিরও বেশী লোক ২০২৫ সালের মধ্যে ব্যাপক ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারে। এর ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন বন্যা, কৃযি উৎপাদন ব্যাহত, বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেখা দেবে সংকট।

হিমালয়ের বরফ গলা পানিতে ভারত ও বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেবে। এক্ষেত্রে আমাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, প্রশমন কিংবা অভিযোজন কৌশল উদ্ভাবনে যুব সমাজ কার্বন নিরপেক্ষ জীবন-জীবিকা পরিচালনায় জনগোষ্ঠী গুলোকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।

অতিমাত্রায় গ্রীন হাইজ গ্যাস উৎপাদনের জন্য শিল্পে অগ্রসরউন্নত বিশ্বই দায়ী। উন্নত বিশ্বের সাথে সাথে আমাদের মত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অপরিকল্পিত উন্নয়নওদায়ী। অপরিকল্পিত ভাবেব্রীজ, কালভার্ট তৈরী হওয়ায় নদী ভরাট হচ্ছে, নদীতে চর পড়ছে এবং পানির সমস্যা প্রকটহচ্ছে। ফসলের জন্যপানি পাওয়া যায় না, সেচ কাজের জন্য স্যালো মেশিন ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে মাটির নিচে পানির স্তরস্বভাবিকভাবেই আরও নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে ভূমিধ্বসের আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে।

তাই জলবায়ু পরিবর্তন’র ফলে সৃষ্ট সমস্যা মোকাবেলার পদ্ধতি প্রণয়ন করে আমাদের বাঁচার পথ নিশ্চিত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে আমরা ঝড় বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে আসছি। বর্তমান অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য আমাদের বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হবে। যেমন-আমাদের দুর্যোগ প্রবণ এলাকায় দুর্যোগ সহনশীল ঘরবাড়ি তৈরী করতে হবে। আমাদের ইউনিয়ন পর্যায়ের সরকারী প্রতিষ্ঠানে দুর্যোগ সহনশীল ঘরবাড়ি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য দেওয়া আছে। তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। এই কাজের জন্য প্রয়োজনে আমরা বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার সাহায্য নিতে পারি।

বন্যায় আমাদের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটসহ নিম্নাঞ্চলের অধিকাংশ জায়গাই প্লাবিত হয়। এই জলাবদ্ধ এলাকায় পানির উপর মাঁচা তৈরী করে বিভিন্ন সবজি চাষ করা যেতে পারে। অথবা কচুরিপানা, খড়কুটা পঁচিয়ে বায়রা চাষ বা ধাপচাষও করা যেতে পারে। অনেক জলাবদ্ধ এলাকাতেই এখন ধাপচাষ হচ্ছে। এছাড়া বন্যা উপযোগী ফসল চাষ করার জন্য কৃষি বিভাগের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে।

আমাদের বাড়ির চারপাশে বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। নির্বিচারে গাছ কাটা কঠোরভাবে রুখতে হবে। কোন পরিস্থিতিতে গাছ কাটতে দেয়া যাবে না। বন্যারসময় অনেক ঘেরের মাছ ভেসে যায়। সুতরাং মাছ আটকে রাখতে পারলে আমরা তা থেকে আয় করতে পারব। তাই ঘেরের অথবা পুকুরের চারপাশ উঁচু করে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের পরামর্শ দেয়া যেতে পারে।

অনাবৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে খাল খননের ব্যবস্থা করতে হবে, বাড়ি ও তার চারপাশের পুকুরগুলো খনন করতে হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করতে হবে, তাতে পানীয় জলের সমস্যা কিছুটা কমবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিভিন্ন রকম রোগ-ব্যাধির সৃষ্টি হচ্ছে। বন্যায় প্রতি বছর ফসল নষ্ট হচ্ছে, অনাবৃষ্টির ফলে সেচ কাজের জন্য পানি পাওয়া যাচ্ছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে আমাদের বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। এছাড়া প্রাকৃতিক বির্পযয় ও বন্যা মোকাবেলার জন্য সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবসম্পর্কে স্থানীয় জনগণকে আরো বেশী সচেতন করে তুলতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিহ্রাস ওমোকাবেলা করা সহজ হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্লাইমেট চেঞ্জ সেল প্রণীত বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ইমপ্যাক্ট এবং ভালনারেবিলিটি শীর্ষক এক গবেষণাপত্রের তথ্য মতে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে উপকূলজুড়ে যে বাঁধ রয়েছে তা এখনই প্রচন্ড ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এই ঝুঁকি অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪২৭১ কিলোমিটার উপকূলীয় বাঁধ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ২০৫০ সালের মধ্যে এই ঝুঁকি আরও ধ্বংসাত্মক হয়ে ১৩,৯৯৫ কিলোমিটারে পৌঁছাবে। জলবায়ুপরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের পানি ক্রমেই ফুলে উঠছে। এর ফলে আশাঙ্কা করা হচ্ছে ২০৩০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে খুলনার কয়রা ও দাকোপ, বাগেরহাটের মোংলা, রামপাল, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা প্রায় ৩ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যাবে। তবে এ সবই এখনও ধারণার মধ্যে সিমাবদ্ধ অনুমান নির্ভর জ্ঞান যার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় এবং “জনগণের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে জলবায়ু ও পরিবেশিক ন্যায্যতা অর্জন” পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করেবে-সরকারী সংস্থা সিডিপি ও পরিবর্তন-খুলনা,খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলায় ২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৭ এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে কৈলাশগঞ্জ, রামনগর ও হরিনটানা গ্রামের সকল পুরুষ ও মহিলা সদস্যদের জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ, জলবায়ু কি, জলবায়ুজনিত ঝুঁকি কি, করণীয় কি, কিভাব ঝুঁকি হ্রাস করা যায় এবং কিভাবে নিজেদেরকে আত্মনির্ভরশীল ভাবে গড়ে তোলা যায় সে লক্ষ্যেকাজ করছে।

আমাদের দেশে গাছপালার সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে কারণ আমারা নগদের লোভেগাছ কেটে ফেলছি। ফলে বাতাসে অক্সিজনের পরিমাণকমে যাচ্ছে যা জলবায়ুর অস্বাভাবিকপরিবর্তনের ঝুঁকি বৃদ্ধিকরছে। আমরা যদি আগে থেকে এর প্রতিকারে ব্যবস্থা গ্রহণ না করি তাহলে ভবিষ্যতে এর পরিণাম আরো ভয়াবহ হতে পারে। আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকরতে বেশী করে গাছ লাগাতে হবে। জলবায়ু ঝুঁকিপ্রবণ এলাকায় বিকল্প কর্মের মাধ্যমে জনগণকে আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে হবে।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *