জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি পোষাতে ভাষমান-মাটি বিহীন চাষ হতে পারে টেকসই বিকল্প কর্ম সংস্থান

ভাসমান-মাটি বিহীন কৃষিঃ সাধারণত গাছের প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ ও দাড়িয়ে থাকার মাধ্যম হিসেবে গাছ মাটির উপর নির্ভর করে। মাটি ছাড়া অন্য কোন ভাবে গাছের এই প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও অবলম্বন পেলে উদ্ভিদ যথাযথ বৃদ্ধি পায় ও ফলন দেয়। এই পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক নামকরণ হয়েছে হাইড্রোফনিক্স। হাইড্রো অর্থ পানি আর ফনিক্সঅর্থ ক্রিয়া। অর্থাৎ হাইড্রোফনিক্সঅর্থ পানির ক্রিয়াশীলতার মাধ্যমে চাষাবাদ। হাইড্রোফনিক্সভাসমান ও অভাসমান উভয় প্রকার হতে পারে।

পানিতে যথেষ্ট পরিমাণঅক্সিজেনথাকায় এই পদ্ধতিতে গাছের পুষ্টি গ্রহণ ক্ষমতা মাটির তুলনায় অধিক হয়। ফলে গাছের বৃদ্ধি ও ফলন মাটির তুলনায় অনেক বেশী। এই ভাসমান ধাপ চাষে বিভিন্ন প্রকার জলজ উদ্ভিদ যেমনঃ কচুরীপানা, ধানের লম্বা নাড়া (বোনা আমন ধানের গোড়া), নলখাগড়া, বিভিন্ন ধরনের অর্ধ-পচনশীল জলজ উদ্ভিদ যেমন- টোপাপানা, খুদিপানা, কাটাশেওলা, ইন্দুরকানী, দুলালী লতা ইত্যাদি ব্যবহার করে ভাসমান বেড তৈরী করা হয় এবং ইহার উপর বিভিন্ন প্রকার শাকসবজি ও বিভিন্ন প্রকার ফল ও ফুলের চাষকরা হয়।

যেমনঃ পানিভর্তি পাত্রে ভাসমান পলিষ্টারিন সিট বা শোলার ছিদ্রের পুষ্টিযুক্ত পানিরমধ্যে উদ্ভিদের শিকড় প্রবেশ করিয়ে হাইড্রোফনিক্সকরা যায়।

স্থান নির্বাচনঃ ভাসমান চাষ যে কোন জলাশয়ে সম্ভব, যেমন: হাওড়, বাওড়, মরা খাল, মরা নদী ইত্যাদি। এ ছাড়া যে সব অঞ্চলের পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীর নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে যার ফলে বিল অপেক্ষানদী বক্ষউঁচু হয়েছে এবং বিলের পানি নিস্কাশন সম্ভব না হওয়ায় নতুন নতুন জায়গা জলাবদ্ধ হয়েছে সে সব অঞ্চলেও এই চাষ সম্ভব।

সাধারণতভাসমান চাষ ক্ষেত্র বা ধাপ তৈরীর জন্য যেসব উপকরণলাগে তা স্থানীয়ভাবে সব জলাভুমি থেকে সংগ্রহ করা হয়। স্থানীয়ভাবে সকল উপকরণপাওয়া না গেলে ভাসমান চাষ বেশ ব্যয়সাপেক্ষও কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। কাজেই যেসব জলাশয়ে প্রয়োজনানুযায়ী ধাপ তৈরীর উপকরণপাওয়া সম্ভব সেসব জলাশয় ভাসমান চাষের সহায়ক। এছাড়া যেসব জলাশয়ে জৈব উপাদান প্রচুর মাত্রায়মজুদ আছে সেসব জলাশয়ে এই চাষ ব্যাপকভাবে সম্ভব। কারণ এই সকল জৈব উপাদানকে কাজে লাগিয়ে প্রচুর পরিমাণজলজ উদ্ভিদ জন্মানো সম্ভব এবং সেগুলো পরবর্তিতে ভাসমান চাষের ধাপ তৈরীতে ব্যবহার করা যায়।

কচুরীপানার ধাপ তৈরীর উপকরণঃ বিভিন্ন প্রকার জলজ উদ্ভিদ যেমন,কচুরীপানা, টোপাপানা, খুদিপানা, কাটা শেওলা, ইন্দুরকানী শেওলা, দুলালী লতা, ভাল মানের বীজ, নৌকা, থোড়া বাঁশ, বাঁশ, কাঁচি/ দা ইত্যাদি।

সময়ঃ বর্ষাকালের শুরুতে (আষঢ়-শ্রাবণ) বামে-জুন মাস থেকেই কচুরীপানা সংগ্রহ করে ধাপ তৈরী শুরুহয়। পরবর্তী শুকনো মৌসুম পর্যন্ত এই চাষ চলে। যে সব জলাভূমিতে সারা বছর পানি থাকে সেখানে সারা বছর ধরে এই চাষাবাদ করা সম্ভব।

পদ্ধতিঃ ভাসমান ধাপ তৈরী করতে প্রচুর পরিমাণ কচুরীপানা প্রয়োজন। বিলাঞ্চল বা নিম্নাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন নদী-নালা, খালে সাধারণত কচুরীপানা জন্মায়। সাধারণত যেখানে জন্মায় বা যে স্থানে পর্যাপ্ত পরিমান কচুরীপানা থাকে সেখানেই ধাপ তৈরী করা হয়। ধাপ তৈরী করতে পানির গভীরতা কোন সমস্যা নয়। যে কোন গভীরতায় কৃষকরা ধাপ তৈরী করতে পারে। ধাপ তৈরীরপ্রথম পর্যায়ে পানিতে ভেসে থাকা কচুরীপানার উপর একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের বাঁশ ফেলে তার উপর দাড়িয়ে শরীরের ভারসাম্য ঠিক করতে হয়,এরপর দুপাশ থেকে পচুরীপানা টেনে এনে পা দিয়ে মাড়াতে হয়এবং এই ভাবে আগাতে হয়বাঁশের অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। এভাবে বাঁশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত কচুরীপানা স্তুপকরার পর বাঁশটি বের করে ফেলতেহয় এবং পুনারায় কচুরীপানা স্তুপের উপর ফেলে একই পদ্ধতিতে কচুরীপানা জমা করতে থাকে যতক্ষণপর্যন্ত নির্র্দিষ্ট প্রস্থ ও পুরুত্বে ধাপ তৈরী না হয়। ধাপ তৈরী করতে পরিণত কচুরীপানা ব্যাবহার করা হয়। কারণ অপরিণত (কম বয়সী ) কচুরীপানা খুব তাড়াতাড়ি পঁচে যায়। প্রথম পর্যায়ে ধাপ তৈরীর পর সাত থেকে দশ দিন পর আবার ধাপের উপর কচুরীপানা দেওয়া হয়। কোন কোন স্থানে দ্বিতীয় পর্যায়ে কচুরীপানার উপর টোপাপানা দেওয়া হয়। এর দুই দিন পর তৃতীয় পর্যায়ে দুলালী লতা ব্যাবহার করা হয়। প্রথম স্তরে কচুরীপানাগুলি সম্পূর্ন ভাবে পচে না বিধায় ধাপটি পানির উপরেপ্লাবতা রক্ষাকরতে পারে। প্রথম স্তরের কচুরীপানাই হচ্ছে সম্পূর্ণ ধাপটির ভিত্তি এবং এই স্তরের উপরেই ধাপের স্থায়িত্ব, প্লাবত্ব ও পুরুত্ব নির্ভর করে। ধাপের উপরের অংশ চাষের উপযোগী হতে প্রথম থেকে সর্বমোট ১৫/২০ দিন সময় লাগে।ধাপের উপর বিভিন্ন ধরণের জলজ উদ্ভিদ, আগাছা দেওয়া হয় প্রধানত তিনটি কারণে-ধাপের উপরের অংশ দ্রুত পচনের জন্য, গাছের চারার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও পুষ্টি সরবরাহ এবং অংকুরিত চারা রোপনের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্রতৈরীর উদ্দেশ্যে।

আকার ও আকৃতিঃ ধাপের কোন নির্দিষ্ট আকার আকৃতি নেই। কৃষকরা তাদের জমির পরিমাণও ধাপ তৈরীর সুবিধা অনুযায়ী ধাপের আকার নির্ধারন করে। তবে ধাপের দৈর্ঘ্য অবশ্যই জমির দৈর্ঘ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণহতে হবে এবং ধাপ যখন পানিতে জমতে থাকে তখন দুটি ধাপের মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমান ফাকা রাখা হয় নৌকা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ করার জন্য। সাধারণতঃ ধাপের মাপ নিম্নরূপ হয়ে থাকে- দৈর্ঘ্যঃ ৩০ ফুট,প্রস্থ ৪ ফুট এবংউচ্চতা ৩ ফুট।

ফসল বিন্যাসঃ শাক-সব্জিও তরিতরকারী ভাসমান চাষ পদ্ধতির প্রধান ফসল। প্রায় ২৩ ধরনের শাক-সবজি ও ৫ ধরনের মসলার চাষ করা হয় এ পদ্ধতিতে। কান্দি এবং ধাপে যে সমস্ত শাক-সবজি চাষ হয় ও চারা উৎপাদিত হয়তার মধ্যে বর্ষাকালীন হ’লশসা, ঝিঙে, ঢেড়শ, বরবটি, ডাটাশাক, করলা, বেগুন, চিচিংগা, মিষ্টিকুমড়া, পুইশাক, কচু, চালকুমড়া, হলুদ ইত্যাদি।

এছাড়া শীতকালীন- পালংশাক, লালশাক, লাউ, শিম, টমেটো, ফুলকপি, বাধাকপি, ওলকপি, আলু, মূলা, গাজর, আদা, পিয়াজ, সরিষা,মরিচ, কচু, ধনে, রসুন ইত্যাদি। এ ফসলগুলোর মধ্যে কোন কোন ফসল সারা বছর ধরে চাষ করা হয়ে থাকে।

ভাসমান-মাটি বিহীন কৃষির আয়-ব্যয়ঃ ৩০ ফুট লম্বা, ৪ ফুট চওড়া এবং ৩ ফুট পুরু১০ টি ধাপ তৈরীতে ব্যয় –

ধাপ তৈরীতে ৬০ দিনের মজুরী ১৫০ টাকা হারে মোট খরচ ৯০০০ টাকা, প্রয়োজনীয় উপকরণ (কচুরীপনা ও অন্যান্যজলজ উদ্ভিদ) সংগ্রহ ও ধাপ স্থানান্তরে ২০ দিনের মজুরী ১৫০ টাকা হারে ৩০০০ টাকা, চারা, বীজ ও টেমা ইত্যাদি ক্রয়ে ১০ টি বেডের জন্য ১৫০ টাকা হারে ১৫০০ টাকা, বাশঁ ক্রয়, পোকামাকড় দমন, পরিচর্যা ও উত্তোলনে ১০ টি বেডের জন্য ২৫০ টাকা হারে ২৫০০ টাকা অর্থাৎ সর্বমোট ব্যয় ১৬০০০ টাকা।

১০ টি ধাপ থেকে শুধু মাত্র বর্ষাকালীন আয়ঃ ঢেঁরস ১৮০০ কেজি,প্রতি কেজি ১০টাকা মূল্যে ১৮০০০ টাকা, ঝিঙে ৪০০ কেজি, প্রতি কেজি ১০টাকা মূল্যে ৪০০০ টাকা, লালশাক ৬০০ কেজি, প্রতি কেজি১০ টাকা মূল্যে ৬০০০ টাকা এবংঅন্যান্য ৬০ কেজি ফসলে প্রতি ধাপে ২০০ টাকা আয়ে ২০০০ টাকা ও জৈবসার (ধাপ পচা সার) ২০৪০০ কেজিতে আনুমানিক মূল্য ১২০০০ টাকা।সর্বমোট আয় ৪২,০০০ টাকা

মোট লাভঃ(৪২,০০০ -১৬,০০০) =  ২৬,০০০ টাকা। কৃষক যদি জৈব সার বিক্রি না করে পরবর্তী বছরের জন্য রেখে দেন তাহলে কৃষকের মোট আয় হবে টাকা ২৬,০০০- ১২,০০০ =১৪,০০০টাকা। কৃষক যদি নিজেই শ্রম বিনিয়োগ করেন তাহলে কৃষকের মোট আয় হবে, টাকা ১৪,০০০ +  ১২,০০০ = টাকা ২৬,০০০।

উল্লেখ্য যে,একটি ধাপ তৈরীতে প্রারম্ভিক ব্যয় বেশী হয় এবং লাভ তুলনামূলক ভাবে কমে যায়। প্রতি ধাপ থেকে সবসময় একটি নির্দিষ্ট পরিমান ফসল পাওয়া যায়না বিধায় কমপক্ষে৫-১০ টি ধাপ তৈরী করলে গড় ফসল উৎপাদন ব্যয় কমে যায়। তাছাড়া পানির স্তর নেমে গেলে ধাপটি যখন মাটিতে লেগে যায় তখন ধাপটিকে ভেঙে বিছিয়ে দিয়ে কোন প্রকার চাষ, মই, সার ছাড়াই প্রচুর পরিমান শীতকালীন শাক সবজি উৎপাদন করা যায়। এ ক্ষেত্রে নামমাত্র বিনিয়োগে অধিক লাভবান হওয়া যায়।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *