জলবায়ু পরিবর্তন জনিত দূর্যোগ পরবর্তী সমস্যা ও করণীয়

দূর্যোগ হচ্ছে প্রাকৃতিক বা মানব সৃষ্ট এমন ঘটনা যা হঠাৎ করে অথবা ধীরে ধীরে ঘটতে পারে। যা আক্রান্ত জনগোষ্ঠিকে অবশ্যই ব্যাতিক্রমী প্রচেষ্টার মাধ্যমে মোকাবেলা করতে হবে।

দূর্যোগ এমন এক চরম ঘটনা বা পরিস্থিতি যা একটি জনগোষ্ঠী বা সমাজ ও তার পারিপার্শ্বিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং স্বাভাবিক জীবনধারাকে বিপর্যস্ত করে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যা মোকাবেলা করার জন্য ঐ সমাজের বাইরের সাহায্যও দরকার হতে পারে।

একটা দূর্যোগকালীন সময়ে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারা, নারী, পুরুষ না অন্য কেউ? এ প্রশ্নের উত্তর একটাই আর তা হলো নারীরা। কেন তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বা তারা কেন এত বেশি ঝুঁকির মধ্যে ?

এর কারণগুলি হ’লঃ বৃদ্ধ ও শিশুসহ নিরাপদে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়া, দূরবর্তী স্থানে আশ্রয় কেন্দ্র থাকা, সন্তান সম্ভবা, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, সচেতনতার অভাব, পুরুষের উপর নির্ভরশীলতা, সিদ্ধান্তহীনতা, পরিবার ও সংসারের জিনিসপত্রের উপর বিশেষ আকর্ষণ, সামাজিক অবজ্ঞা, পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র না থাকা ইত্যাদি।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে দুর্যোগের প্রভাব এবং ক্ষয়ক্ষতি কতটা ভয়ংকর ও তার বিভিন্নতাঃ

শারীরীকঃ

মৃত্যু, শারীরীক আঘাত, রক্তপাত,গর্ভপাত,প্রজননস্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা।

অর্থনৈতিকঃ

ফসলাদির ব্যাপক ক্ষতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি, পশু সম্পদ ও পশুখাদ্য বিনষ্ট,হাঁস মুরগীর মৃত্যু, রাস্তাঘাট, ব্রীজ, কালভার্টের ক্ষতি, ফসলের বীজের ক্ষতি,খাদ্যাভাব, বসতবাড়ি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি, শিল্প ও বানিজ্য কেন্দ্রের ক্ষতি, কুটিরশিল্পের ক্ষতি।

সামাজিকঃ

বিভিন্ন ধরনের অপরাধ প্রবনতা বৃদ্ধি, ভিক্ষাবৃত্তি বৃদ্ধি, শিক্ষা পরিবেশ ও সুযোগ সংকোচন, সামাজিক সম্পর্কের অবনতি, পরনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি, ত্রান নির্ভরশীলতা, কর্মসংস্থানের অভাব, শোষনের নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি, সামাজিক জীবনের স্থবিরতা, ভূমিহীন পারিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি, ঋণগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, পতিতাবৃত্তি, মাদকসেবীর সংখ্যা বৃদ্ধি,

পরিবেশগতঃ

গাছপালা ও বনজ সম্পদের ক্ষতি, বন্যার ফলে ডায়রিয়াসহ নানা ধরনের সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব, পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থার অবনতি, জলাবদ্ধতা সৃষ্টি, কোন কোন এলাকার জমিতে বালির পরিমান বৃদ্ধি পেয়ে ভূমির উর্বরতা নষ্ট, নদীভাঙ্গনের সৃষ্টি, বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তুর মরদেহ পচে বায়ু ও পানি দুষণ

মানসিকঃ

বেদনাবোধ, ভয়, অসহায়ত্ববোধ, হতাশা, বিষন্নতা, কর্মে অনীহা, জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধা, দুর্বলতা, ক্লান্তি, আত্মহনন প্রবণতা, দুঃস্বপ্ন, অনিদ্রা, অবসাদ, অস্থিরতা, অসংলগ্ন আচারণ।

বন্যার আগের করণীয়ঃ

বাড়ির ভিটা, পুকুর পাড় ও রাস্তা উঁচু করুন, জ্বালানী ও শুকনো খাবার যেমন- চিড়া, মুড়ি, খই, গুড় এবং পানি সংরক্ষনের পাত্র ইত্যাদি সংরক্ষণ করুন, গবাদি পশুর আবাস উঁচু করুন ও খাবার সংরক্ষণ করুন, একটি ছোট নৌকা প্রস্তুত রাখুন, বীজ ধান প্লাষ্টিক প্যাকেটে সংরক্ষণ করুন, নিয়মিত সঞ্চয় করুন ও কিছু টাকা হাতে রাখুন, পাইপ লাগিয়ে টিউবওয়েল উঁচু করে নিন, মানুষের আশ্রয়ের জন্য স্কুল, কমিউনিটি সেন্টার, উঁচু স্থান নির্বাচন করুন, নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করুন এবং অস্থায়ী শৌচাগার নির্মানের জন্য স্থান নির্বাচন/ স্থাপন করুন, এলাকার উঁচু স্থান, বেড়ীবাঁধ, রাস্তা গুলো চিহ্নিত করুন যেখানে গবাদী পশু রাখা যায়, নিরাপদ স্থানে লোকজন স্থানান্তরের জন্য নৌকার ব্যবস্থা রাখুন, স্থানীয় চিকিৎসক, এনজিও ও সরকারী সহায়তায় মেডিকেল টিম গঠন করুন, নিরাপত্তার জন্য গ্রাম প্রতিরক্ষা দল ও আনসারদের প্রস্তুত হতে সহায়তা করুন।

বন্যাকালীন করণীয়ঃ

যারা ঘরে আছেন তারা ঘরের আশপাশে পোকা মারার ঔষধ দিন,

নিরাপদ পানি পান করুন,  ফিটকিরী ও পানি শোধনকারী ট্যাবলেট সংগ্রহ করে রাখুন এবং ব্যবহার করুন, ঘরে শুকনো খাবার, দিয়াশলাই ও মোমবাতি মজুদ রাখুন, প্রয়োজনে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যান, নির্দিষ্ট জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করুন, গবাদি পশুর যত্ন নিন, প্রয়োজনীয় ঔষধ ও খাবার স্যালাইন হাতের কাছে রাখুন, গর্ভবতী নারী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এবং শিশুদের বিষয়ে বিশেষ নজর দিন, শিশুদের পানি থেকে সাবধানে রাখুন, ডায়রীয়া বা যে কোন ধরনের অসুস্থ হলে মেডিকেল টিমের সাথে যোগাযোগ করুন, রোগীকে স্থানান্তর বা হাসপাতালে নেওয়ার জন্য এবং খাদ্য পরিবহনের জন্য নৌকার ব্যবস্থা রাখুন।

বন্যার পর করণীয়ঃ

পানি নেমে গেলে বাড়ী-ঘর ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পরিস্কার করুন বা আশ পাশে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দিন, নলকূপ মেরামত করে আধা ঘন্টা একটানা পানি চেপে ফেলে দিয়ে এরপর পানি পানের কাজে ব্যবহার করুন, জমিতে চাষ দিন, তাড়াতাড়ি আবাদ করুন, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিওদের সাথে যোগাযোগ করুন, পুঁজি না থাকলে পুঁজি সংগ্রহের উদ্যোগ নিন, বুঝেশুনে ঋণ গ্রহণ করুন।

সতর্কতাঃ বন্যার পানি যেন পেটে না যায়, মশা, মাছি, কীটপতঙ্গ ও সাপ থেকে সাবধান থাকুন, ডায়রীয়া হলে খাবার স্যালাইন খান, শিশুদের প্রতি লক্ষ্য রাখুন যাতে পানিতে পড়ে না যায়, বিষাক্ত সাপ সম্পর্কে সতর্ক থাকুন, বাসি পঁচা খাবার খাবেন না।

ঘুর্ণীঝড়, টর্নেডো এবং কাল বৈশাখীর আগের করণিয়ঃ

নিয়মিত আবহাওয়ার খবর শুনুন, বাড়ির চার পাশে সারি ধরে গাছ লাগান, বিশেষ করে বাড়ির চারপাশে নারিকেল, খেজুর এ ধরনের গাছ লাগান, বাঁধ ও রাস্তার ধারে গাছ লাগান, গবাদি পশুর ঘর মজবুত করুন এবং গবাদি পশুর প্রতি খেয়াল রাখুন, ঘরের টানা ও বাধঁন শক্ত করে নিন, আসবাবপত্র, প্রয়োজনীয় সামগ্রী ভালোভাবে গুছিয়ে রাখুন, প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ঔষধপত্র আগেই সংগ্রহ করে রাখুন, দিয়াশলাই ও মোমবাতি যত্ন করে রাখুন, দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য সেচ্ছাসেবক দল গঠন করুন।

ঘুর্ণীঝড়, টর্নেডো এবং কাল বৈশাখীর সময় করণীয়ঃ

আশ্রয়কেন্দ্র বা অন্য কোন নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিন, মেয়েরা শক্ত করে খোপা বাধুঁন এবং গায়ের জামা কাপড় শক্ত করে বাধুঁন, গবাদি পশুর বাঁধন খুলে দিন ও যতটা সম্ভব নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিন, চুলা নিভিয়ে ফেলুন, কোন খোলা জায়গা বা গাছের নীচে থাকবেন না, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিন।

ঘুর্ণীঝড়, টর্নেডো এবং কাল বৈশাখীর পর করণীয়ঃ

আহতদের উদ্ধার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নিন, মৃতদেহ সৎকার ও মৃত পশুপাখি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাটিতে পুতে ফেলুন, রাস্তায় গাছ পড়ে থাকলে রাস্তা থেকে গাছ সরানোর ব্যবস্থা নিন, ভেঙ্গে যাওয়া টিউবওয়েল, পায়খানা ও ঘর দরজা মেরামতের ব্যবস্থা নিন, নতুন করে গাছ লাগান, চাষাবাদ শুরু করুন।

খরার আগে করণীয়ঃ

গভীর নলকূপ স্থাপন, গভীর করে পুকুর খনন করে পানি জমা রাখুন, চিড়া, মুড়ি, খই, গুড় ইত্যাদি শুকনো খাবার সংরক্ষণ করুন, গবাদী পশুর খাবার সংরক্ষণ করুন, গভীর করে জমি চাষ দিন, পানি ধরে রাখার জন্য গাছের গোড়ায় জাবড়া দিন, পরিত্যক্ত পুকুর ডোবা পরিষ্কার করে নিন, রাতে বা বিকালে জমিতে সেচ দিন, এমন ফলজ বৃক্ষসমূহ লাগাতে হবে যেগুলো দীর্ঘদিন পর্যন্ত পানি ধরে রাখতে পারে বা যেগুলোতে পানি না দিলেও চলে (যেমন- কলা, পেঁপে, আতা, বেল ইত্যাদি )। সয়াবিন, বাদাম, তিল প্রভৃতি ফসলও লাগানো যেতে পারে। মাটিতে অধিকহারে জৈব সার ব্যবহার করা এবং খরা মোকাবেলার জন্য সচেতনতা সৃষ্টি ও কমিউনিটি ভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করুন।

খরার সময় করণীয়ঃ

গোসল, ধোয়া-মোছা ও সেচের কাজে পানির অপচয় করবেন না, গবাদি পশুর যত্ন নিন, ওদের ঠান্ডা স্থানে রাখুন, খরা সইতে পারে এমন ফসল চাষ করুন, প্রচুর নিরাপদ পানি পান করুন, মাঝে মাঝে পানির সাথে একটু লবন মিশিয়ে নিন, পুকুরের পানি নোংরা করবেন না, রোদের মধ্যে বাইরের কাজের চেয়ে ঘরে বসে রোজগার করা যায় এমন কাজ করতে চেষ্টা করুন, উপায় না থাকলে মাথায় মাথাল অথবা সরাসরি রোদ না লাগে এমন কিছু দিয়ে মাথা ও শরীর ঢেকে রাখুন।

খরার পর করণীয়ঃ

বাড়ীর আশেপাশে জাম, কাঁঠাল, জাম্বুরা লেবু, কুল, বেল, আমড়া, করমোচা, পেয়ারা, কামরাঙ্গা, নারিকেল, সুপারি, খেজুর, তাল, আমলকি, জামরুল, গোলাপ জাম, কলা, ডালিম, নিম, তুত বিভিন্ন রকম পাতা বাহার এবং বাড়ীর অল্পদুরে বাঁশঝাড়, বাড়ীর দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে নীচু উচ্চতারগাছ, পশ্চিম ও উত্তর দিকে উচুঁ শ্রেণীর গাছ লাগানো যেতে পারে। রবি ফসল চাষ করুন, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিওদের সাথে যোগাযোগ করুন, পুঁজি না থাকলে পুঁজি সংগ্রহের উদ্যোগ নিন, বুঝে-শুনে ঋণ গ্রহণ করুন, ফসলের আবাদ করুন।

খরার সময় সতর্কতাঃ

বেশী সময় একটানা রোদে থাকবেন না, শরীর থেকে যাতে প্রচুর ঘাম বের হতে না পারে সে ব্যবস্থা নিন, পঁচা ও বাসি খাবার খাবেন না, বেশী করে পানি পান করুন, ডায়রীয়া থেকে সতর্ক থাকুন, অসুস্থ হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

শৈত্য প্রবাহের আগে করণীয়ঃ

নিয়মিত আবহাওয়ার খবর শুনুন, পৌষ-মাঘ মাসের পূর্বেই প্রস্তুতি নিতে হবে, গরম কাপড় সংগ্রহ করতে হবে, আমন ধান কাটা এবং মাড়াই কাজ যাতে ব্যহত না হয় সেজন্য আগাম ব্যবস্থা নিন, গর্ভবতী, বৃদ্ধ এবং শিশুরা যাতে শীতাক্রান্ত না হয় সেজন্য শীতবস্ত্র, কাঁথা-কম্বল ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখুন, দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য সেচ্ছাসেবক দল গঠন করুন, শৈত্য প্রবাহে শীতার্ত মানুষকে সহায়তার জন্য সামর্থ্যবানদের কাছ থেকে শীতবস্ত্র ও কম্বল সংগ্রহ করুন, দুস্থ তালিকা তৈরী করুন।

শৈত্র প্রবাহের সময় করণীয়ঃ

ডায়রীয়া, রক্ত আমাশয়, সর্দ্দি-জ্বর, টনসিল, কানে ব্যথা রোগীদের চিকিৎসা সহায়তা দানের ব্যবস্থা করুন, বৃদ্ধ, শিশু, গর্ভবতী ও অসুস্থদের যাতে শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা না হয় বা না বাড়ে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে, হাঁস-মুরগী ও গবাদি পশু যাতে রোগাক্রান্ত না হয় কিংবা হলে পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া ও চিকিৎসার ব্যববস্থা করা, হাঁস-মুরগী, পশু-পাখির ঘর চট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে, গবাদি পশুকে চট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে, পুকুরে চুন প্রয়োগ করে পানির তাপ বাড়াতে হবে।

শৈত্য প্রবাহের পরে করণীয়ঃ

অসুস্থদের চিকিৎসার ব্যবস্থা নিন, তাঁত, কৃষি কার্যের দ্রুত উদ্যোগ নিন, শৈত্য প্রবাহ সহনীয় এবং দ্রুত ফল দেয় এমন সবজি আবাদ করতে কৃষি বিভাগের পরামর্শ গ্রহণ করুন, নতুন করে গাছ লাগান।

আমাদের এখন দুটি দিক বিবেচনায় রেখে এগুনো উচিত; অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেয়ার জন্য যথাসম্ভব অভিযোজন কৌশল গ্রহণ করা এবং গ্রীনহাউজ গ্যাসের জন্য দায়ি ধনী দেশগুলোর সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করা, যাতে দায়ি ধনী দেশগুলো গ্রীনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনতে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরন দিতে বাধ্য হয়।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *