ভারতবর্ষের শত বছরের পুরাত ঐতিহ্যবাহি রাস মেলা এ বছর শুরু হবে ২৪ নভেম্বর অর্থাৎ ৯ অগ্রহায়ণ। দুবলারচরের মেলা চলবে তিনদিন অর্থাৎ ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত। কার্তিক-অগ্রাহায়ণ পূর্ণীমাতিথিতে এ উৎসব শুরু হয়। ভারতীয় উপ-মহাদেশে দুটি অঞ্চলের রাস মেলা সবচেয়ে বৃহৎ ও শত বছরের ঐতিহ্যে লালিত। সবচেয়ে পুরাতন রাস মেলা হ’ল ভারতের কোচবিহারে, এবং দ্বিতীয় প্রাচীন রাস মেলা হ’ল বাংলাদেশের সুন্দরবনের সাগরদুহিতা দুবলারচরে অনুষ্ঠিত রাস মেলা।
১৮১২ সালে কোচবিহারের ভেটাগুড়িতে প্রথম রাস মেলার আয়োজন করা হয়। কোচবিহারের মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ’র ভেটাগুড়িতে নির্মিত রাজপ্রাসাদে প্রবেশ উপলক্ষ্যে শুরু হয় রাস উৎসব। রাজা হরেন্দ্রনারায়ণ কুলদেবতা শ্রীকৃষ্ণ বা মদনমোহন দেব’র উদ্দেশ্যে রাস মেলার প্রচলন করেন। রাজা নিজে রাসচক্র ঘুরিয়ে রাস মেলার উদ্বোধন করেন। পরে কোচবিহার শহরের বৈরাগীর দীঘির পাড়ে মদনমোহন মন্দির নির্মাণ সম্পন্ন হলে মন্দির প্রাঙ্গনে রাসচক্র স্থাপন করে রাস উৎসব পালন করা হয়।
রাসচক্র’র মুসলিম ঐতিহ্যঃ বাঁশের চটার তৈরী সিলিন্ডার আকৃতির একটি কাঠামো যা কাগজ দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়। পরে মুড়ে দেওয়া কাগজের উপর শ্রীকৃষ্ণের নাম ও বৃন্দাবন লীলার ছবি সেটে সাজানো হয়। রাসচক্রটিকে এমন ভাবে স্থাপন করা হয় যাতে এটি ঘোরানো যায়। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত কোচবিহারের রাজারা রাসচক্র ঘুরিয়ে মেলা উদ্বোধন করেছেন। উৎসবের লগ্নে মদনমোহন মন্দিরের পুরোহিতের নির্দেশে বিশেষ মন্ত্র উচ্চারণ করে রাসচক্র ঘুরিয়ে উৎসবের উদ্বোধন করা হয়। মেলায় আগত দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্য থাকে রাসচক্র ঘোরানো, কারণ মেলায় আগতরা মনে করেন রাসচক্র ঘোরালে বিশেষ পূণ্যার্জন হয়। খানিকটা যেন বৌদ্ধদের ধর্মচক্রের মত।
কোচবিহারের এই ঐতিহ্যবাহী রাস মেলার রাসচক্র নির্মাণ করে পুরুষানুক্রমে একটি মুসলিম পরিবার। বর্তমানে যিনি এই রাসচক্র নির্মাণ করছেন তার নাম আলতাফ মিঁঞা। প্রায় ২২ ফুট উচ্চতার এই রাসচক্র তিনি নির্মাণ করছেন ৩০ বছর যাবৎ। এর আগে তাঁর পিতা আজিজ মিঁঞা, এবং তারও আগে তার দাদা পান মহম্মদ মিঁঞা রাসচক্র তৈরী করতেন। কোচবিহারের ঐতিহ্য হ’ল হিন্দু-মুসলিম পরিবারগুলি একই সাথে রাস মেলায় অংশ নেয়।
দুবলারচরের রাস মেলাঃ বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাস উৎসব হয় সুন্দরবনের শেষ প্রান্তে সাগরদ্বীপ দুবলারচরে, যা আসলে সুন্দরবনেরই অংশ। কথিত আছে ১৯২৩ সালে গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দির হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুসারী হরি ভজন নামে এক সাধু সুন্দরবনের দুবলারচরে রাস পূর্ণিমায় পুঁজা-পার্বনাদি ও অনুষ্ঠান শুরু করেন। তার পর থেকে শুরু হয়েছে রাস মেলা।
পৃথিবীর বিস্ময় ও বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবন, যেখানে সমুদ্রে অবগাহন করছে, সেই অপার সমুদ্রের কোলে দুবলারচরে তিনদিন ব্যাপি চলে এই মেলা। হিন্দু সম্প্রদায়ের নর-নারীরা এ মেলাকে তীর্থস্থান হিসেবে মনে করেন। আর তাই রাসপূর্ণিমার পূণ্যতিথিতে পূণ্যার্জনের উদ্দেশ্যে হাজার হাজার নর-নারী দুবলারচরের রাস মেলায় ছুটে আসেন। একই সাথে পূণ্যার্জন আর বিস্ময়কর ম্যানগ্রোভ বন ও সমুদ্রের মিলনে যে অপার প্রাকৃতিক অপার্থিব সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে তাকে উপভোগ করার আনন্দ যেন পূণ্যানন্দে পরিণত হয়, যার আকর্ষণ অস্বিকার করা বড়ই কঠিন। সুন্দরবনের দুবলারচরের রাস মেলা এখন আন্তর্জাতিক মেলায় রূপ নিয়েছে। শুধু হিন্দু সম্প্রদায় নয়, সকল ধর্মের দেশী-বিদেশী দর্শনার্থী সহ হাজার হাজার মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ এ মেলায় অংশগ্রহণ করেন। মেলাকে উপলক্ষ্য করে বহু বিদেশী পর্যটক এ সময় সুন্দরবন ভ্রমণে আসেন এবং একসাথে মেলায় এ দেশের ধর্মীয় রীতিনীতি ও সংস্কৃতি এবং সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করেন।
সুন্দরবন সম্পূর্ণ সংরক্ষিত বন, এবং রাস মেলা সুন্দরবনের অভ্যন্তরে হওয়ায় বন বিভাগের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে এ মেলা পরিচালিত হয়। বন বিভাগের নিয়ন্ত্রনের প্রধান কারণ মেলায় আগত বহু মানুষ যাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে চোরা বা অবৈধ ভাবে সুন্দরবনের হরিণ শিকার করা। চোরা শিকারীদের প্রতিষ্ঠিত কিছু দল আছে যারা প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক হরিণ শিকার করে। অভিযোগ আছে এদের সহয়তা করে বন বিভাগের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মী। তবে বর্তমানে বন বিভাগ, র্যা ব ও কোস্টগার্ড হরিণ নিধন বন্ধে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে কিন্তু তারপরও থামানো যায় না অবৈধ হরিণ নিধন! আর সে কারণে মেলায় আগমন ও নির্গমনের জন্য বিশেষ রুট নির্ধারন করে দেয় বন বিভাগ।
এ বছর রাস মেলায় গমনের নির্দিষ্ট রুট হ’ল বুড়িগোয়ালিনী, কোবাদক থেকে বাটুলা নদী-বল নদী-পাটকোষ্টা হংসরাজ নদী হয়ে দুবলারচর। কদমতলা হতে ইছামতি নদী, দোবেকী হয়ে আড়পাঙ্গাসিয়া-কাগাদোবেকী হয়ে দুবলারচর। কৈখালী স্টেশন হয়ে মাদার গাং, খোপড়াখালী ভাড়ানী, দোবেকী হয়ে আড়পাঙ্গাসিয়া-কাগাদোবেকী হয়ে দুবলারচর। কয়রা, কাশিয়াবাদ, খাশিটানা, বজবজা হয়ে আড়ুয়াশিবসা-শিবসা-মরজাত নদী হয়ে দুবলারচর। নলিয়ান স্টেশন হয়ে শিবসা-মরজাত নদী হয়ে দুবলারচর। ঢাংমারী স্টেশন হয়ে পশুর নদী দিয়ে দুবলারচর। চাঁদপাই স্টেশন হয়ে শেলা নদী দিয়ে বগি-বলেশ্বর-সুপতি-কচিখালী-শেলারচর হয়ে দুবলারচর।
দুবলারচর, একদিকে মাইলের পর মাইল প্রশস্ত বালুকাময় বেলাভূমি যার উপর প্রতিনিয়ত সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে এক উদ্দাম ণৃত্যে বয়ে চলেছে, অন্যদিকে দীগন্ত বিস্তৃত প্রকৃতির বিস্ময় সুন্দরবন, যেন এক স্বর্গীয় লীলাভূমি। তীর্থযাত্রী আর পর্যটকদের মাঝে এই অপার্থিব সৌন্দর্য এক ঘোরলাগা অনুভুতির সৃষ্টি করে, যা তাদের বার বার এখানে ফিরিয়ে আনে। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি দুবলারচর এ অঞ্চলের সবচেয়ে বৃহৎ মৎস্য পল্লিও। প্রায় ১৫ হাজার জেলে সমুদ্র থেকে মাছ ধরে এই চরে গড়ে তুলেছেন বিশাল শুটকি পল্লি। মেলার তিনদিন এখানে কুটিরশীল্পের মেলা বসে, অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন প্রকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মেলা রূপ নেয় আবহমান গ্রামবাংলায় উদ্যাপিত মেলার চরিত্র।
by
সর্বশেষ মন্তব্যসমূহ