খুলনা সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি)’র নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর ফুটপাত খাদ্য প্রকল্প এখন বিপদজনক ও ঝুকিপূর্ণ খাদ্য প্রকল্পে পরিণত হয়েছে। নগরবাসির অভিযোগ, চার কোটি টাকার প্রকল্প সহয়তা পেয়েও কেসিসি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যের পরিবর্তে উন্নতমানের সিগারেট-পান’র দোকান প্রতিষ্ঠা করেছে।
সূত্রমতে, জতিসংঘ খাদ্য এবং কৃষি প্রতিষ্ঠান (এফ এ ও) এবং নেদারল্যান্ড সরকার খুলনা মহানগরির স্ট্রিট ফুড ডেভেলপমেন্ট এ্যাক্টিভিটিস বা ফুটপাথের খাদ্যমান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রায় চার কোটি টাকার একটি প্রকল্পের সকল উপকরণ সরবরাহ করে এবং খুলনা সিটি কর্পোরেশনের ভ্যাটেরিনারী বিভাগের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করে।
প্রকল্পের আওতায় দুই পর্যায়ে খাদ্য বিক্রেতাদের ( ২০১২ সালে ৩০০টি এবং ২০১৫ সালে ২০০টি) পাঁচশ’টি উন্নতমানের খাদ্য তৈরী এবং বিক্রির উপযুক্ত চার চাকার গাড়ী প্রদান করা হয় এবং প্রতিটি গাড়ীর সাথে একসেট করে ফুল প্লেট, হাফ প্লেট, কাপ-পিরিচ, ছুরি-চামচ, গামলা, চুলা, কড়াই, বালতি, চার্জার লাইট সহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রদান করা হয়।
কেসিসি’র ভ্যাটেরিনারি বিভাগের সূত্রমতে, নগরীতে আগেই যারা বিভিন্ন খাদ্য বিক্রয় ব্যবসায় জড়িত ছিলো তাদের আবেদনের ভিত্তিতে উল্লিখিত গাড়ী প্রদান করা হয়েছে এবং তাদের নিরাপদ ও স্বাস্থ্য সম্মত খাদ্য তৈরীর (ফুডসেপ্টি) প্রশিক্ষণও প্রদান করা হয়েছে যা ছিলো প্রকল্পেরই অংশ।
ফুটপাথের খাদ্র ব্যবসার ইতিহাসঃ নগরবাসির সুস্থ্য ভাবে বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই ফুটপাথের খাদ্র ব্যবসা প্রথম শুরু হয় প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে রোমান আমলে সাম্রাজ্যের বড় বড় শহরগুলিতে, যা আজ বিস্তার লাভ করেছে সারা দুনিয়ার শহরগুলিতে।
কেন ফুটপাথের খাদ্যঃ ষ্ট্রিটফুড বা ফুটপাথের খাদ্য’র মূল উদ্দেশ্য হ’ল প্রতিদিন একটি শহরে শহরের এবং শহরের বাইরে থেকে বিভিন্ন কাজে আসা হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন কাজে দীর্ঘক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকতে বাধ্য হয়। এ সময় তাদের ক্ষুধা মিটাতে খাদ্য প্রয়োজন। যাতে সল্পমূল্যে ভেজালমুক্ত পরিচ্ছন্ন ‘হালকা’ খাবার এই মানুষগুলিকে সরবরাহ করা যায় সে জন্যই ফুটপাথের খাদ্যের উদ্ভব হয়েছে। তবে পৃথিবীর বহু দেশে এ প্রয়োজনকে ছাড়িয়ে ফুটপাথের খাবার আজ তাদের গর্ব ও জাতীয় সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে। এ খাদ্যের প্রধান বৈশিষ্ট হ’ল ভেজাল মুক্ত ও সর্বোচ্চ পরিচ্ছন্নতায় তৈরী হতে হবে। এটাই এ খাদ্যের গ্রহণযোগ্যতার মূল ও একমাত্র উপাদান। স্বাস্থ্য সম্মত ও আকর্ষনিয় ষ্ট্রিটফুড বা ফুটপাথের খাবার হ’ল তুলনামূলক সস্তা এবং সম্পূর্ণ পরিচ্ছন্ন ও ভেজাল মুক্ত, যে কারণে সকল শ্রেণীর মানুষই অর্থাৎ ধনি থেকে দিনমজুর সকলেই এ খাদ্যের ক্রেতা। খাদ্যের বহুমাত্রিক স্বাদ গ্রহণ করতেই বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ ফুটপাথের খাবার খায়।
ষ্ট্রিটফুড বা ফুটপাথের খাদ্যঃ স্ট্রিটফুড বা ফুটপাথের খাদ্য হিসেবে থাকতে পারে তাজা রুটি বা পরাটা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভেজিটেবল রোল, চিকেন, বিফ, মাটন রোল, বিভিন্ন ধরনের ভেজিটেবল চপ, বিভিন্ন ধরনের সবজি এবং মাংস-ডিম-চিংড়ি দিয়ে রান্না নুডুল্স্’র বহু পদ, পরিস্কার তেলে ভাজা পুরি, সিংগাড়া, লুচি, ডাল, চটপটি-ফুসকা, বিভিন্ন ভেজিটেবল চপ, বিভিন্ন ধরনের নোনতা, ঝাল এবং মিষ্টি পিঠা (যেমন চিতাই পিঠা, ভাপা পিঠা, পাটিসাপ্টা, ভাজাপিঠা), বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি ফল, মিক্সড্ ফ্রুট, সব্জি এবং ফল মিশিয়ে বিভিন্ন ধরনের সালাদ, মাছ এবং মাংসের কাটলেট, মাখন-পাউরুটি, বোম্বেটোষ্ট (ডিম+দুধ দিয়ে পাউরুটি ভাজা), বিভিন্ন প্রকার কাবাব, চা-কফি সহ বহু প্রকার খাবারই তৈরী হতে পারে যা হবে সম্পূর্ণ পরিচ্ছন্ন ও ভেজাল মুক্ত। পৃথিবীর সকল জনবহুল সভ্য নগরেই ফুটপাথের খাবার একটি আকর্ষনীয় উল্লেখযোগ্য ও আবশ্যক বিষয় এবং নগর কর্তৃপক্ষ’র সঠিক ব্যাবস্থাপনায় তা প্রতিষ্ঠিত।
দেশে দেশে ফুটপাথের খাবারঃ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বড় বড় শহর তথা ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, জাপান থেকে শুরু করে ইউরোপ-আমেরিকার শহরগুলিতে ফুটপাথের খাদ্য তার বহুমাত্রিকতা ও গুনগত মানের জন্য উল্লেখযোগ্য আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। উল্লিখিত অঞ্চলগুলিতে ফুটপাথের খাদ্য তাদের দেশের খাদ্য সংস্কৃতিরই বিশেষ অঙ্গ হয়ে উঠেছে, যা তারা সারা পৃথিবীর মানুষকে উপভোগ করাতে আগ্রহী।
বিভিন্ন দেশের শহরগুলির ফুটপাতের খাবার– ভারতঃ লুচি আলুর দম, বিভিন্ন প্রকার মিট ও ভেজ চাওমিন (নুডুল্স্), কচুরি মসালা, মিট ও ফিস ফিঙ্গার, মোমো (মাংসের কুলিপিঠার মতো), বিভিন্ন স্যুপ, ফুসকা, চটপটি, পাকোড়া, লাচ্ছি, ফালুদা, আলু পরাটা, পানিপুরি,ভেলপুরি, ডালপুরি, স্যান্ডউইচ, বিভিন্ন ধরনের কাবাব, স্প্রিংরোল সহ বহু খাবার।
নেপালঃ মোমো, ফ্রায়েড পটেটো, ফিস-চিকেন ড্রামস্টিক, আলু পরাটা, পাকোড়া, সসেজ (মাংসের পেষ্ট দিয়ে রোল আকারে তৈরী), পানিপুরি, চটপটি।
পাকিস্তানঃ বান কাবাব, স্যান্ডউইচ, সামুচা, ভাজা ও পোড়ানো মাছ, পপকর্ন, ফালি করে কাটা নারকেল, গার্লিক চিকেন, পাকোড়া, শুকনো ফল, বিভিন্ন প্রকার বাদাম, ফ্রেন্সফ্রাই।
থাইল্যান্ডঃ বীফ পোর্ক চিকেন ভেজ নুডুল্স্ , বিভিন্ন ধরনের স্যুপ, ফ্রায়েড রাইস, সসেজ, পাকোড়া।
চায়নাঃ ফ্রায়েড নুডুল্স্ এন্ড রাইস, বিভিন্ন পদের স্যুপ, সেঁকা মিষ্টি আলু, ফ্রায়েড ব্রেড, গ্রীল্ড চিকেন, মুরগী ও হাসের পা ফ্রাই এন্ড স্টিম, বীয়ার দ্বারা সিদ্ধ স্পাইসি শামুক, সাপ ভাজা উইথ ভেজ, ভাজা কাকড়াঁ বিছা, মোমো, স্নাকস্।
জাপানঃ প্যানকেক উইথ বেকন, সেঁকা মিষ্টি আলু, পুরু প্যানকেক উইথ লাল মরিচ, চীজ, মিট ও আলু, পোর্ক’র পুর দেওয়া পিঠা, ঝলসানো স্কুইড ( অক্টোপাশ’র মত দেখতে), পোড়ানো ভুট্টা উইথ বাটার এন্ড সয়াসস, কারি রাইস, নুডুল্স্, প্যানকেক উইথ অক্টোপাশ।
ইংল্যান্ডঃ হ্যামবার্গার, কারি স্যান্ডউইচ, হগ রোস্ট, কাবাব, চীজ চিলিকর্ন, ডোনাটস, মটরশুটি ভাজা উইথ চীজ এন্ড সস, রোস্ট নাট, হটডগ, ফিস চিপস।
আমেরিকাঃ সিনামন স্নেইল, স্টাফড্ পিঠা স্যান্ডউইচ, চিকেন এন্ড রাইস প্লাটার, বার্গার, ফ্রেন্সফ্রাই, অইসক্রিম, ফিস টেম্পোরা, চীজ গ্রীলড্ চিকেন স্যান্ডউইচ, লবস্টার রোল, মিক্সড্ সালাদ।
খুলনা মহানগরীর ফুটপাথের খাবারঃ জতিসংঘ খাদ্য এবং কৃষি প্রতিষ্ঠান (এফ এ ও) এবং নেদারল্যান্ড সরকার খুলনা মহানগরির স্ট্রিট ফুড ডেভেলপমেন্ট এ্যাক্টিভিটিস বা ফুটপাথের খাদ্যমান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রায় চার কোটি টাকার একটি প্রকল্প খুলনা সিটি কর্পোরেশনের ভ্যাটেরিনারী বিভাগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করছে। নগরীতে সরেজমিনে অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে, প্রকল্পের আওতায় যে সকল গাড়ি প্রদান করা হয়েছে তার ৯০ শতাংশই এখন সিগারেট-পান-চা’র দোকানে পরিণত হয়েছে।
নগরীর হাজী মহসিন রোড, সাউথ সেন্ট্রাল রোড, খানজাহান আলী রোড, শের-এ-বাংলা রোড, যশোর রোড, শিববাড়ি মোড়, পিটিআই মোড় সহ বিভিন্ন এলাকায় ৫৫টি গাড়ির উপর অনুসন্ধান করা হয়, যার মধ্যে দেখা যায় ৫০টি গাড়িতে বিক্রি হচ্ছে সিগারেট-পান-চা এবং ক্রয়কৃত নিম্ন মানের অস্বাস্থ্যকর বেকারী সামগ্রি, একটি গাড়িতে চিতাই পিঠা ও ভাপা পিঠা, একটি গাড়িতে সিংগাড়া সামুসা চপ এবং তিনটি গাড়িতে চটপটি।
গাড়ির মালিক হাজী মহসিন রোড’র মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন, স্বপন, খানজাহান আলী রোড’র ফাতেমা বেগম, পারভীন, শিববাড়ি মোড়ের খাদিজা, হান্নান, শহীদ, আব্দুল করিম, শেফালী বেগম এরা সকলে শুরু থেকেই বিক্রি করছেন সিগারেট-পান-চা এবং ক্রয়কৃত নিম্ন মানের অস্বাস্থ্যকর বেকারী সামগ্রি। জানতে চাইলে বলেন, “সিগারেট বিক্রি করা নিষেধ তবে রেখেঢেকে বিক্রি করছি।” এদের অনেকে এক দিনের স্বাস্থ্য সম্মত ও নিরাপদ খাদ্য তৈরীর ট্রেইনিং পেয়েছেন, অনেকে পান নি। কি ট্রেইনিং পেয়েছেন জানতে চাইলে তারা হেসে বলেন,“ ফাকিবাজি ট্রেইনিং পেয়েছি। আমাদের কোন রান্না সেখানো হয় নি, তবে সবকিছু পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার শিক্ষা দেছে।” তাঁরা স্বাস্থ্য সম্মত ও নিরাপদ খাবার বিক্রি করছেন কি-না জানতে চাইলে সকলেই অপরাধির মত হেসে বলেন, “বোঝেনই তো এগুলো ভালো খাবার না, তবে আমাদের গাড়ি পরিস্কার আর চা ভালো।”
গাড়ির সাথে যে সকল প্লেট ডিস পিরিচ দেওয়া হয়েছিলো সেগুলি কোথায় জানতে চাইলে অনেকেই চুপকরে থাকেন আবার অনেকে বলেন বাড়িতে আছে। ওগুলি তো জনগণের সম্পত্তি বাড়িতে কেন রেখেছেন জানতে চাইলে তাঁরা জানান, “ বেচি চা-সিগারেট, প্লেট দিয়ে কি করবো” ? তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকেই বলেন তাঁরা সেগুলি বেঁচে দিয়েছেন।
এ সকল বিষয়ে জানতে চাইলে কেসিসি’র ভ্যাটেরিনারি অফিসার ডাঃ রেজাউল করিম বলেন, এ সকল গাড়িতে কি বিক্রি হচ্ছে তা নিয়মিত মনিটরিং করেন স্যানিটারী অফিসার ও ফুড সেপ্টি অফিসার। ৯০ শতাংশ গাড়িতে সিগারেট জর্দাসহ পান বিক্রি হচ্ছে যা সরাসরি ক্যান্সারের জন্য দায়ী, আর বিক্রি হচ্ছে জন স্বাস্থ্যের জন্য ঝুকিপূর্ণ নিন্ম মানের বেকারী পণ্য, এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভ্যাটেরিনারি অফিসার ডাঃ রেজাউল করিম ও ডাঃ পেরু গোপাল প্রতিবেদকের অনুসন্ধানের সাথে দ্বি-মত পোষন করেন। তাঁদের দাবি নগরীতে এ সকল গাড়ির মাধ্যমে স্বাস্থ্য সম্মত চটপচি, ফুসকা, চপ, সিঙ্গাড়া, সামুচা, স্বাস্থ্যকর বেকারী পণ্য সহ বিভিন্ন খাবার বিক্রি হচ্ছে।
by
সর্বশেষ মন্তব্যসমূহ