বাঘ দিবসে মৃত্যু আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, লুটের মাল সুন্দরবন অবৈধ টাকার কামধেণু

আজ ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস। বাঘ সুরক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সারা বিশ্বে এ দিনটি বাঘ দিবস হিসেবে পালন করা হয়, অথচ এই মূহুর্তে বাঘের অন্যতম বৃহিৎ আবাসস্থল সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগাররা মৃত্যু আতংকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, কারণ ইতোমধ্যে মাত্র কয়েক বছরের ব্যাবধানে শত শত বাঘকে হত্যা করা হয়েছে, এ অবস্থায় বাঘের পরিবর্তে মিলছে শুধু বাঘের চামড়া! আর এ জন্য একমাত্র দায়ি বনের পাহারদার সুন্দরবন বন বিভাগ, অভিযোগ সাধারণ মানুষের।

বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ বাঘ বিচরণ ক্ষেত্র হ’ল সুন্দরবন যা আজ বাঘ শূন্য হওয়ার হুমকির মুখে পড়েছে। সুন্দরবন বন বিভাগ ২০০৪ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রকল্প (ইউএনডিপি)’র সহয়তায় সুন্দরবনের বাঘের উপর জরিপ চালিয়ে ঘোষণা করেছিলো যে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪০টি। আর সুন্দরবন বন বিভাগের ২০১৫ সালের জরিপের ফলাফল বলছে সুন্দরবনে এখন বাঘের সংখা মাত্র ১০৬টি অর্থাৎ বন বিভাগের হিসেব অনুযায়ী মাত্র ১০ বছরে ৩৩৪টির অধিক বাঘকে হত্যা করা হয়েছে। জরিপ ত্রুটির কারণে বাঘের ঘোষিত সংখ্যা ৪৪০ এর জায়গয় হয়তো ৩০০টি বা তার কম-বেশী হওয়া সম্ভব ছিলো আর সে ক্ষেত্রেও গত ১০ বছরে শত শত বাঘকে হত্যা করা হয়েছে!

সুন্দরবন বন বিভাগ কি করেঃ বন বিভাগ সূত্রমতে, বন বিভাগের কাজ হ’ল বন পাহারা দেওয়া এবং সুন্দরবনের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার বহুমাত্রিক সম্পদ বিভিন্ন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রাজস্ব আকারে আহরণ করা। তবে এ সকল সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রতিপালনের উদ্দেশ্যে তারা কোন কাজ করে না।

সুন্দরবনের কোন গবেষণাকেন্দ্র নেইঃ আশ্চর্য হলেও সত্য যে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন বাংলাদেশের সুন্দরবনের কোন গবেষণাকেন্দ্র নেই! এ বিষয়ে আলাপকালে বন বিভাগের উচ্চপদস্থ অফিসারদের বক্তব্যে মনে হয়েছে গবেষণাকেন্দ্রের বিশেষ কোন প্রয়োজনও নেই। তাদের বক্তব্য, প্রয়োজন হলে বিদেশী গবেষণাকেন্দ্রের সাহায্য নেওয়া সম্ভব, যেমন ভাবে তারা বাঘ গননার ক্ষেত্রে নিয়েছেন।

সূত্রমতে, সুন্দরবনে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল, ১৩ প্রজাতির অর্কিড, ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রণী, ২১০ প্রজাতির সাদামাছ, ২৬ প্রজাতির চিংড়ি, এক প্রজাতির গলদা, ১৩ প্রজাতির কাঁকড়া,  ৪২ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক এবং তিন শতাধিক প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। এ ছাড়াও আছে মধু, বাগদা চিংড়ির কোটি কোটি পোনা সহ অন্যান্য সম্পদ। তবে, এর কোন কিছুই জীববৈচিত্র বা অর্থিক সম্পদ হিসেবে সুন্দরবন বন বিভাগের নিকট গবেষণার উপযুক্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়! প্রকৃতপক্ষে আসল রহস্য অন্যত্র।

সুন্দরবন এক লুটের কামধেণুঃ একশত ৩৬ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৭৯ সালে সুন্দরবনের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় সুন্দরবন বন বিভাগের উপর, অথচ এত দিনেও সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রতিপালনে গবেষণাকেন্দ্র সহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি কেন ? এর উত্তর হ’ল বৃটিস দখলদারদের মালিকানায় সুন্দরবন ছিলো লুটের মাল। গন্ডারের শিং’র মূল্য সবকালেই চড়া ( বর্তমানে এক কিলোর মূল্য ৭৫ হাজার ডলার)। ডলারের লোভে বৃটিসরা মাত্র একশ’ বছরের মধ্যে সুন্দরবনের দুই প্রজাতির গন্ডার নির্মূল করে ছেড়েছে! বন বিভাগের সূত্রমতে, ইতোমধ্যে সুন্দরবনের দুই প্রজাতির গন্ডার, এক প্রজাতির মহিষ, দুই প্রজাতির হরিণ ও একাধিক প্রজাতির কুমির বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে কি কি কারণে এরা বিলুপ্ত হ’ল বন বিভাগের কাছে সেটা কোন গবেষণার বিষয় নয়! সুন্দরবন সেই বৃটিসদের উদ্দেশ্য ও সিস্টেমেই চলছে।

বিগত প্রায় তিন দশক যাবৎ সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ এক ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বন বিভাগের অফিসারদের এ রোগ বিষয়ে কোন ধারনাই নেই। রোগে সুন্দরী গাছের আগা আক্রান্ত হয়ে আগা মরে যায় বলে তারা এর নাম দিয়েছেন টপ ডাইং রোগ। শত শত সুন্দরী গাছ এ রোগে আক্রান্ত। এ রোগ ও তার প্রতিকার বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনা বিভাগীয় বন অফিসার বলেন, এ সকল বিষয়ে তাদের কোন ধারনা নেই, এবং এটা তাদের কর্মকান্ডের অন্তর্ভুক্ত নয়! তাদের কাজ হ’ল বন পাহারা দেওয়া এবং ব্যবস্থাপনা করা।

পত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী বিগত ৩/৪ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী র‌্যাব-পুলিশ-কোষ্টগার্ডের হাতে বেশ কিছু বাঘ হত্যাকারী ধরা পড়েছে যাদের নিকট থেকে ৩০টির অধিক বাঘের চামড়া উদ্ধার কার হয়েছে, যদিও বন পাহারাও চলছে।

সুন্দরবনের বাঘ, হরিণ সহ অন্যান্য প্রাণীর রোগ-বালাই, প্রজনন, বিলুপ্তি বা অন্য কোন পরিবর্তন, প্রাণীকূলের উপর জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব ইত্যাদি বিষয়ে তাদের কাছে কি ধরনের তথ্য আছে জানতে চাইলে বিভাগীয় বন অফিসার, ওয়াইল্ড লাইফ, জানান, বিভাগীয় ভাবে তাদের কাছে এ সকল বিষয়ে তেমন কোন তথ্য নেই, কারণ এ সকর বিষয়ে তাদের কোন কাজ নেই। অর্থাৎ এগুলিও বন বিভাগের কাছে গবেষণার উপযুক্ত কোন বিষয় নয়!

বিশ্ব বাঘ দিবসের উদ্দেশ্য হ’ল বাঘের জীবনের নিরাপত্তা ও নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিৎ করার ব্যাপারে সাধারণ মানুষ ও বন বিভাগের কর্মীদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা। বাঘ হত্যা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করা এবং বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বন বিভাগের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করা।

এবারের বাঘ দিবসের বাস্তবতা হ’ল বন বিভাগের পাহারা বাঘের জীবনের নিরাপত্তা ও নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিৎ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আর তাদের কর্মকান্ডই প্রমান করছে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বাঘের প্রজনন নিয়ে কাজ করতে যে সকল গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত ও কাজের অভিজ্ঞতা অর্থাৎ কাজের সংস্কৃতি প্রয়োজন তাও তাদের নেই, ফলে বাঘের সংখ্যা নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতাও তাদের হবে না। এ অবস্থায় আর কতদিন বাংলাদেশ ‘বাঘ দিবস’ পালন করতে পারবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। কারণ বাঘ না থাকলে বাঘ দিবসও থাকবে না।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ ,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *