অপমানে নীল বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন আর বীর মুক্তিযোদ্ধা মঞ্জুরের মুখ

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দোসর, বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের বংশধর হিসেবে গড়ে ওঠে ঘৃণিত রাজাকার বাহিনী, আর তার জন্ম হয় খুলনা শহরে, যা খুলনাবাসির জন্য একটি লজ্জাকর, অপমানজনক ইতিহাস। কিন্তু সেই রাজাকার সৃষ্টির ‘অপবাদ’ই কি খুলনার মাথার ‘মুকুট’ হয়ে থাকবে ?

কারণ, খুলনা মহানগরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোন মুক্তিযোদ্ধার নামে স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরেও কোনো সড়কের নামকরণ হয় নি, অথচ ক্যুখ্যাত স্বাধীনতা বিরোধী দালাল শিরমনি ‘খান-এ-সবুর’র নামে সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ! তাও সেই যশোর রোডের নাম পরিবর্তন করে, যে যশোর রোডে সংঘটিত হয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা ‘শিরোমনি’ যুদ্ধ, যে যশোর রোড মুক্তিযুদ্ধের চিরকালীন ইতিহাস হয়ে গেছে আমেরিকান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ’র কবিতায়, যে যশোর রোড দিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আর তার দোসর রাজাকারদের অত্যাচারে ভিটেমাটি ছেড়ে লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশু আশ্রয় নিয়েছিলো ভারতে। তা হলে কি মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতেই মুক্তিযোদ্ধা সড়ক না হয়ে যশোর রোড হয়ে গেলো দালাল খান-এ-সবুর রোড ? এই স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কারা নিচ্ছে এই প্রতিশোধ ?

নোয়াখালী জেলার সূর্য সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন খুলনা এসেছিলেন যুদ্ধ করে খুলনাকে পাকিস্তানী হানাদার মুক্ত করতে। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী গানবোট ‘পলাশ,’ ‘পদ্মা’ ও ‘পানভেল’ নিয়ে মংলা বন্দর অতিক্রম করে শিপইয়ার্ড অঞ্চলে পৌঁছায় পাকিস্তানী নৌ-ঘাটি পি, এন, এস তিতুমীর (বর্তমান খুলনার খালিশপুর’র বি, এন, এস তিতুমীর) দখল করতে। বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন ছিলেন গানবোট পলাশ’র প্রধান ইঞ্জিন রুমের আর্টিফিসার। তাঁদের গানবোট শিপইয়ার্ড অঞ্চলে পৌঁছলে শত্রুর বিমানের আক্রমণের শিকার হয়। বিমানের ক্রমাগত আক্রমণে পদ্মার ইঞ্জিনরুম ধ্বংস হয়ে যায় এবং জাহাজ রক্ষা করতে গিয়ে বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন’র ডান হাত সম্পূর্ণ উড়ে যায়। এ সময় তিনি ঝাপদিয়ে পড়েন রূপসা নদীতে। প্রাণশক্তিতে বলিয়ান এ যোদ্ধা এক সময় রূপসা নদীর পাড়েও পৌঁছেযান, কিন্তু সেখানে এই দেশপ্রেমীক বীর যোদ্ধার জন্য অপেক্ষা করছিলো ঘৃণ্য শৃগাল দেশদ্রোহী রাজাকারের দল। ঘৃণ্য পশুরা এই বীর যোদ্ধা কে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। আর এ ভাবেই এই বীর যোদ্ধা দেশের প্রতি, খুলনাবাসির প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধ করেন।

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালাতে থাকে। এ সময় হানাদার বাহিনীর কমান্ডার হায়াত খান একটি ব্রিগেড নিয়ে খুলনার শিরোমনি, আটরা, গিলেতলা, তেলিগাতি, দৌলতপুর এলাকায় ক্যাম্প গড়ে তোলে। হায়াত খান খুলনা শহর কে ঘিরে তার সাঁজোয়া ও গোলোন্দাজ ব্রিগেডকে নিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলে এবং আটরা ও শিরোমনি এলাকায় যশোর রোডে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসি মাইন পুতে রাখে। ১৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্রবাহিনীর সদস্যরা শিরোমনি পৌঁছালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী অতর্কিতে হামলা চালালে যৌথ বাহিনীর বিপুল সংখ্যক যোদ্ধা হতাহত হন।

এর পর যুদ্ধের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর মঞ্জুর কে। মেজর মঞ্জুর ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর বিভিন্ন দিকে খন্ডযুদ্ধ চালিয়ে হানাদার বাহিনীকে শিরোমনি এলাকায় ঘিরে ফেলেন। ১৬ ডিসেম্বর রাতে মেজর মঞ্জুরের নেতৃত্বে শুরু হয় সর্বাত্মক সম্মুখ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে ব্যাপক হতাহতের পর বিদ্ধস্ত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ১৭ ডিসেম্বর সকালে ‘যশোর রোডের’ পাশে শিরোমনিতে জনৈক নসু খানের ইটভাটা এলাকায় আত্মসমর্পণ করে।

খুলনাবাসী পারেনি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের প্রতিক যশোর রোড কে বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন’র নামে নামকরণ করে তাঁকে সম্মানিত করতে, পারেনি বীর যোদ্ধা মঞ্জুরের বীরত্বের প্রতিক যশোর রোড তাঁর নামে নামকরণ করতে।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রতিক, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ‘যশোর রোড’ কে তারা তুলে দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শৃগাল ক্যুখ্যাত স্বাধীনতা বিরোধী দালাল খান-এ-সবুর’র নামে। এ কি মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ ?

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *