ব্যবসায়ীদের সামাজিক দায়বদ্ধতা বা কর্পোরেট সোশাল রেস্পনসিবিলিটি (সিএসআর) আজকের দিনে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে একটি বিশেষ কার্যকরি পন্থা হিসেবে স্বীকৃত, যা সামাজিক সমস্যাকেও সঠিক প্রচেষ্টা ও প্রযতেœর মাধ্যমে সম্পদে পরিণত করতে সক্ষম। আর এ জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত প্রকল্প প্রণয়ন ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, যা পিছিয়ে পড়া মানুষদের জীবনযাত্রায় ঘটাতে পারে বৈপøিবক পরিবর্তন।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত খুলনা শিল্পাঞ্চল হিসেবেই খ্যাত। এখানে গড়ে উঠেছে দেশের বৃহত্বম বিপুল সংখ্যক পাট কল, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শতাধিক হিমায়ীত মৎস্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প, যা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্বম রপ্তানী পণ্য উৎপাদক। এ ছাড়া আছে মংলা পোর্ট ও তৎসংলগ্ন বিশেষ শিল্প এলাকা (ইপিজেট), যেখানে গড়ে উঠেছে শুধু রপ্তানী পণ্য উৎপাদক অনেক দেশী-বিদেশী শিল্প প্রতিষ্ঠান। এ সকল প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে লক্ষাধিক নারী-পুরুষ শ্রমিক কর্মরত, যারা আসলে বিভিন্ন বিষয়ে বঞ্চিত সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ।
আলোর নীচে অন্ধকারের মত খুলনাঞ্চলে এই শত শত শিল্প-কারখানা গড়ে উঠলেও শিল্প মালিকদের ব্যবসায়ীক সামাজিক দায়বদ্ধতা বা কর্পোরেট শোসাল রেস্পনসিবিলিটি এখানে একেবারেই নেই বললে চলে। যা আছে তা হ’ল ব্যক্তিগত দান-ধ্যান , যা পরিকল্পিত কোন ব্যবস্থাপনা আদৌ নয়। অথচ এ সকল শিল্প মালিকগণ যদি একটু দায়িত্ব নিয়ে একটু পরিকল্পিত ভাবে কিছু করার জন্য এগিয়ে আসেন তা হলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে এ অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া মানুষদের জীবনযাত্রায় ঘটতে পারে বৈপøিবক পরিবর্তন, যা একটি মাত্র উদাহরণ থেকেই প্রমাণ করা সম্ভব।
বিদ্যমান এ অবস্থার মাঝেই কর্পোরেট শোসাল রেস্পনসিবিলিটি নিয়ে এগিয়ে এসেছে খুলনা মহানগরীর খালিশপুর অঞ্চলে গড়েওঠা বিদ্যুৎকেন্দ্র খুলনা পাওয়ার কোম্পানী লিঃ। আর তাদের এ কর্মে যিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি এ অঞ্চলের সিএসআর’র প্রাণপুরুষ ও পথিকৃত বে-সরকারী সংস্থা পরিবর্তন’র নির্বাহী পরিচালক নাজমুল আজম ডেভিড। খুলনা পাওয়ার কোম্পানী পরিচালিত সিএসআর প্রোগ্রাম’র ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব শুরু থেকেই পালন করে আসছে বে-সরকারি সংস্থা পরিবর্তন-খুলনা। খুলনা পাওয়ার কোম্পানী পরিচালিত সিএসআর প্রোগ্রাম সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবর্তন’র নির্বাহী পরিচালক নাজমুল আজম ডেভিড বলেন, খুলনা মহানগরীর খালিশপুরস্থ খুলনা পাওয়ার কোম্পানীর বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকার প্রায় ১৩ হাজার মানুষ এ প্রকল্পের আওতায় সারাবছর যে সকল সুবিধা ভোগ করেন সেগুলি হ’ল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কারিগরি প্রশিক্ষণ, বিনোদন, পরিবেশ সংরক্ষণ, স্যানিটেশন ইত্যাদি।
তিনি বলেন, ২০১৩ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যে কর্মকান্ডগুলি চালু আছে সেগুলি হ’ল প্রকল্প এলাকার সুবিধা বঞ্চিত মহিলাদের জন্য সাধারণ শেলাই প্রশিক্ষণ ও বিশেষ প্রশিক্ষণ, অফিস কেন্দ্রীক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও কম্পিউটার স্কিল্ড ডেভেলপমেন্ট ট্রেইনিং, স্বাস্থ্য সেবা, যার মধ্যে আছে সাধারণ দৈনন্দিন চিকিৎসা, স্পেসাল মেডিকের ক্যাম্প যেমন ইএনটি ইস্ক্রিনিং ক্যাম্প, হার্ট ডিজিজ ইস্ক্রিনিং ক্যাম্প, চক্ষু শিবির ও অপারেশন, ব্লাড ইস্ক্রিনিং ও ব্লাড ব্যাঙ্ক গঠন, ডেন্টাল ইস্ক্রিনিং ক্যাম্প, সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা বৃত্তি , স্কুল ড্রেস ও শিক্ষা উপকরণ প্রদান, স্কুল শিক্ষার বাইরে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ প্রদান, আর্ট ক্যাম্প ও নিয়মিত প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন জাতীয় দিবসের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড উপস্থাপনের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ সহ বিভিন্ন কর্মকান্ড।
এ সকল কর্মকান্ডের ফলে ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত সাধারণ শেলাই প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ৩৬০ জন মহিলা যাদের অধিকাংশই শেলাই কর্মকেই জীবীকা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এ ছাড়া বিশেষ প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ৭৫ জন মহিলা, যারা স্বপ্নিল নামে একটি বুটিকস্ ব্রান্ড তৈরী করতে সক্ষম হয়েছেন এবং সমবায়ের ভিত্তিতে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছেন। অফিস ওরিয়েন্টেড কম্পিউটার ট্রেইনিং পেয়েছেন ৩৬২ জন ছেলেমেয়ে। উচ্চতর কম্পিউটার ট্রেইনিং পেয়েছেন ৫০ জন শিক্ষার্থি যারা ওয়েবসাইট নির্মাণ সহ আউট সোসিং কমে পারদর্শি। এ ছাড়া বিভিন্ন স্কুলের ১০ জন শিক্ষককে কম্পিউটার ট্রেইনিং প্রদান ও দুটি স্কুলে দুইটি কম্পিউটার প্রদান করা হয়। এ সময় ২২৪৯ টি পরিবারকে হেল্থ কার্ড প্রদান, ৫৪৩৩ জনকে সাধারণ চিকিৎসা প্রদান এবং ২৪ জনকে বিশেষ চিকিৎসা প্রদান, একই সময়ে হার্ট, নাক-কান-গলা ও দন্ত রোগের সাধারণ চিকিৎসা প্রদান করা হয় ৩৪১ জনকে এবং ১১৯২ জনকে সাধারণ চক্ষু চিকিৎসা এবং ৬৬ জনকে অপারেশনের সুবিধা প্রদান। এলাকার বিভিন্ন স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৬০০ সেট স্কুল ড্রেস, ১০ হাজার নোটবুক এবং চার হাজারটি কলম প্রদান করা হয়। এছাড়া এলাকার বিভিন্ন স্কুল, মাদ্রাসা, ঈদ গাঁ, খেলার মাঠের সীমানা ও বাড়িতে প্রায় ৮শ’ বৃক্ষ রোপণ করা হয়। এ ছাড়াও আছে স্যানিটেশন ও হাউজহোল্ড গার্বেজ ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থাপনা। আর এ সকল কর্মকান্ডে খুলনা পাওয়ার কোম্পানী প্রতি বছর খরচ করে থাকে ৫০ লাখ টাকা।
উল্লিখিত চিত্র থেকে প্রনিধানযোগ্য যে, খুলনাঞ্চলের শতাধিক মৎস্য প্রক্রিয়াজাত ইন্ডাস্ট্রি, সরকারি-বে-সরকারি পাটকল, মংলা ইপিজেড এলাকায় স্থাপিত ইন্ডাস্ট্রি সহ সকল কল-কারখানার মালিকগণ যদি সামাজিক খাতে তাদের ব্যয়িত অর্থ একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে খরচ করেন এবং সকলেই তাদের সাধ্যমত এগিয়ে আসেন তা হলে এ অঞ্চলের সুবিধা বঞ্চিত লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব বলে মনে করেন বিভিন্ন স্তরের বিশেষজ্ঞগণ। আর এটা ব্যবসায়ীগণ কর্তৃক এক ধরনের সামাজিক ক্ষতিপূরণ, কারণ, বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা পরিবেশ ও লোকালয়ের দূষণজনিত গুরুতর ক্ষতি সাধন করে, যা থেকে মানুষ ও প্রকৃতি অমোচনিয় ক্ষতির শিকার হয়। আর এ ধরনের কর্মকান্ডের জন্য সরকারও দিয়ে থাকে সরাসরি কর ছাড় ও উৎসাহব্যাঞ্জক আর্থিক প্রণোদনা যা ব্যবসায়ীদের এ খাতের ব্যয়ভার অনেকটাই লাঘব করতে সক্ষম।
by
সর্বশেষ মন্তব্যসমূহ