জীববৈচ্যিত্রে অনন্য সুন্দরবন –পর্ব ৫

সুন্দরবন বিচিত্র প্রজাতীর ডলফিন্‌’র স্বর্গ

সোয়াচ অব নো-গ্রাউন্ডঃবিজ্ঞানিরা বাংলাদেশকে চিহ্নিত করেছেন বিচিত্র প্রজাতীর ডলফিন্‌’র প্রাচুর্যে ভরপুর সারা বিশ্বের আদর্শ স্থান হিসেবে।সুন্দরবন থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটারদক্ষিণে বঙ্গপসাগরে অবস্থিত সাবমেরিন ক্যানিয়ন বা ‘সোয়াচ অব নো-গ্রাউন্ড’কে বলা হয় ডলফিন্‌’র গ্লোবাল হটস্পট বা ডলফিন্‌’র স্বর্গ।সোয়াচ অব নো-ল্যান্ড হ’ল সুন্দরবন সংলগ্ন বঙ্গপসাগরের মুখে গড়েওঠা ১৪ কিঃমিঃ চওড়া এবং সমূদ্রের তলদেশ থেকে হাজার মিটারের বেশী গভীর এক প্রাকৃতিক খাত (ক্যানিয়ন), যার গভীরতা পরিবর্তনশীল।যে কেউ একে চিনতে সক্ষম কারণ এ এলাকার পানির রং এর আশপাশের পানির রং থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

সুন্দরবনের ডলফিনঃ সুন্দরবনে তিন ধরনের ডলফিন্‌ ও এক প্রজাতীর পাখনা বিহীন পরপয়িজ বা শুশুক পাওয়া যায়।

ইরাবতী ডলফিনঃ ইরাবতী ডলফিন্‌দেখতে প্রায় পাখনা বিহীন পরপয়িজদের মত।তবে এদের পিঠে ছোট্ট ত্রিকোন একটি পাখনা আছে,যার অগ্রভাগ প্রায় গোলাকৃতি ও ভোঁতা।এদের ঠোটহীন মাথাও ভোঁতা।সোজা মুখাবয়ব এবং ঘাড়ের কাছে ভাজ সদৃশ্য মনে হয়।পূর্ণবয়স্ক ইরাবতী ডলফিন্‌আকারে ২ থকে ২.৭৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়।এদের পিঠ ও পাশের রং ধুসর ও নীলাভ-ধুসর এবং পেটের রং কিছুটা হালকা।এরা দলবদ্ধ প্রাণী।সাধারণত ৬টি ইরাবতী ডলফিন্‌মিলে একটি দল গঠিত হয়,তবে অনেক সময় একটি দলে ১৫টি পর্যন্ত ইরাবতী ডলফিন্‌ দেখা যায়।

ইরাবতী ডলফিন্‌ গ্রীষ্ম মন্ডলীয় ও উপ-গ্রীষ্ম মন্ডলীয় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের উপকূলীয় লবন,হালকা-লবন(ব্রাকিস)ও মিঠা পানিতে বাস করে।উত্তর অষ্ট্রেলিয়া ও নিউগিনি থেকে বঙ্গোপসাগর এবং ইরাবতী নদী,মেকং নদী,মহাকাম নদী,গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীতে এদের পাওয়া যায়।

গ্যাংগেজ রিভার ডলফিন বা শুশুঃ এদের শরীর বেশ মোটাসোটা মাংসল এবং ঘাড় নমনীয়।ঢালু কপাল থেকে শুরু হওয়া এদের ঠোঁট বেশ লম্বা।শুশু’র পিঠের ফিন বা পাখনা প্রস্থে খুব ছোট,ত্রিকোন ও চ্যাপ্টা আকৃতির।এদের চোখ খুব ছোট যা মুখের ভাজ যেখানে উপর দিকে বাক নিয়েছে তার কোনে অবস্থিত।শুশু’র দৃষ্টি শক্তি ক্ষিণ,প্রায় নেই বললেই চলে।পানির নীচে যে স্তর পর্যন্ত আলো প্রবেশ করে সে এলাকায়ই এরা চলাফেরা করে।শুশু মাছ বা অন্যান্য অমেরুদন্ডী প্রাণী শিকার করে শব্দ বা প্রতিধ্বনি অনুসরণ করে।পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী শুশু ২.৬ মিটার এবং পুরুষ ২.২ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়।এদের ওজন ১০৮ কিলোগ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে।শুশু’র গায়ের রং ধুসর এবং পিঠের রং গাঢ়-ধুসর।অনেকের পেটের দিকের রং গোলাপী আভার মত।শুশু দলবদ্ধ প্রাণী।সাধারণত ১০টি শুশু মিলে একটি দল গঠিত হয়।এরা গঙ্গা,ব্রহ্মপুত্র,কর্ণফুলী নদী ও এর সাথে সংযুক্ত বাংলাদেশ,ভারত,নেপাল ও ভুটানের নদ-নদীতে বাস করে।

গোলাপী ডলফিনঃ গোলাপী ডলফিন্‌’র মাংসল শরীরে উল্লেখযোগ্য লম্বা ঠোট থাকে।এদের পিঠের ঠিক মাঝখানে একটি কুঁজ আছে যার উপর এদের পিঠের ফিন্‌ অবস্থিত।পরিণত বয়সের পুরুষ গোলাপী ডলফিন্‌ লম্বায় ৩.২ মিটার এবং স্ত্রী ২.৫ মিটার পর্যন্ত হয়।ইন্দো-প্যাসিফিক পিঠকুঁজো এই ডলফিনের ওজন ২৮৪ কিলোগ্রাম পর্যন্ত হয়।এদের গায়ের রং বিভিন্ন ধরনের।গাঢ় পানি রঙের বাচ্চাগুলি বড় হলে হালকা রঙের হয়ে যায়।পরিণত  বয়সে এরা সাদাটে গোলাপি রঙের হয় এবং ছোপ ছোপ থ্যাবড়ানো দাগ থাকে গায়ে।

১০ থেকে ৩০টি গোলাপী ডলফিন্‌ একটি দলে থাকে।এরা গ্রীষ্ম-মন্ডলীয় ও উষ্ণ-মন্ডলীয় উপকূল থেকে খাড়ি,নদী এবং ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে প্রবেশ করে।পূর্বে উত্তর অষ্ট্রেলিয়া থেকে দক্ষিণ চীন এবং ইন্দোনেশিয়া ও ভারত মহাসাগরের উপ-কূলীয় অঞ্চল থেকে আফ্রিকার দক্ষিণাংশ পর্যন্ত এদের বিচরণ ক্ষেত্র।ম্যানগ্রোভ বন উজাড় হওয়া এদের জন্য হুমকি স্বরূপ।

পাখনাবিহীন শুশুক বা পরপয়িসঃ পাখনাহীন বা ফিন্‌লেসশুশুকদের পিঠে কোন পাখনা থাকে না।মসৃন পিঠের এই শুশুকদের অন্য সকল শুশুক থেকে সহজে আলাদা করা যায়।এদের শরীর পাইপ সদৃশ্য এবং ঘাড় অত্যন্ত নমনীয়।এদের কোন ঠোট নেই।গোলাকৃতির কপালের প্রান্তে সামান্য খাজ আছে।পরিণত বয়সের পুরুষ স্ত্রীদের চেয়ে আকারে বড় হয়।এরা সাধারণত ১.৯মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়।পরপয়িস গাঢ় ধুসর রঙের হয় এবং গলা ও জননেন্দ্রীয় এলাকা একটু ফিকে হয়ে থাকে।সাধারণত এরা একা অথবা ছোট দলে থাকে।সুন্দরবনে এদের সবচেয়ে বড় দল পাওয়া গেছে যে দলে এদের সংখ্যা ছিলো ২৫টি।এরা নৌকা বা জলযানেরনিকট আসতে অপছন্দ বা অস্বস্তি বোধ করে।এরা মিষ্টি ও লবন সব ধরনের পানিতেই বাস করে।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *