জীববৈচ্যিত্রে অনন্য সুন্দরবন -শেষ পর্ব

সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত গন্ডার

সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত গন্ডার

সুন্দরবনের বিলুপ্ত ও বিপন্ন বিভিন্ন প্রজাতীর প্রাণীকূলঃ

মানুষের লোভ আর দখলদারিত্বের কারণে বিগত ২০০ বছরে সুন্দরবন তার আয়োতনের প্রায় অর্ধেক হারিয়েছে,সেই সাথে চিরতরে বিলুপ্ত (Extinct) হয়ে গেছেতার বিবিধ প্রজাতীর অমূল্য উদ্ভিদ ও প্রাণিকূল।যে সকল প্রাণি ও উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়েছে তাদের বিলুপ্তির মূলে আছে নগদ লোভে জঙ্গল কেটে আবাদ প্রতিষ্ঠা আর প্রাণী হত্যা।

বিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে যে সকল প্রাণী সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম হ’ল জাভান রাইনোসোরাস(Javan rhinoceros)বা গন্ডার,হগ ডিয়ার(Hog deer),জল মহিশ(water buffalo),জলাভূমির হরিণ(swamp deer),মার্স ক্রোকোডাইলস(Mugger crocodiles)বা ঝিল’র কুমির অন্যতম।

এ সকল প্রাণীদের মধ্যে বৃটিশ শিকারিদের লোভের বলী হয়েছে সুন্দরবনের গন্ডার এবং মার্স ক্রোকোডাইল।তাদের সাথে যোগ দিয়েছিলো স্থানীয় চোরা শিকারীরাও,কারণ কুমিরের চামড়া ও গন্ডারের শিং,মাথা ও চামড়া সে কালেও মূল্যবান বস্তু ছিলো(বর্তমানে এক কিলোগ্রাম গন্ডারের শিং’র মূল্য ৩০ হাজার ডলার)।সুন্দরবনের অন্যান্য প্রাণীরা মূলত বিলুপ্ত হয়েছে বন উজাড় হওয়ার কারণে বাস্তুচ্যূত হওয়া ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করায়।

সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত ঝিল কুমির

সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত ঝিল কুমির

বর্তমান কালেও সুন্দরবনের অনেক প্রজাতীর প্রাণীর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে।এদের কারো জীবন হুমকির কাছাকাছি,কারো জীবন ঝুকিপূর্ণ,কেউ বিপন্ন,কারো জীবন আবার আসঙ্কাজনক ভাবে বিপন্ন।এর প্রধান কারণ পরিবর্তিত পরিবেশ এবং পরিস্থিতির সাথে সাথে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করে মানুষ(রাষ্ট্র বা বন বিভাগ ও নাগরীক)প্রতিনিয়ত অবিবেচনাপ্রসূত কর্ম-কান্ড করে চলেছে,ফলে বিপন্ন হয়ে পড়ছে সুন্দরবনের প্রাণীকূল।

আসঙ্কাজনক ভাবে বিপন্ন প্রাণীঃ সুন্দরবনের যে সকল প্রাণী মারাত্মক বিপদজনক অবস্থায় আছে তারা হ’ল – রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বা বাঘ,ইলশা হাঙ্গর,ইরাবতি ডলফিন ও লবন পানির কুমির।

বিপন্ন প্রাণীকূলঃ যারা বিপদজনক অবস্থায় আছে তারা হ’ল – মায়া হরিণ,সজারু,মেছো বাঘ,বন বিড়াল,বাঘডাস,ভোদড়,লাল মাছরাঙ্গা,মাস্কড্‌ ফিনফুটার,কালো গুই সাপ,জলপাই কচ্ছোপ,পিট ভাইপার,অজগর,সঙ্খচূড় সাপ,কালনাগিনী,মদনটাক ও শুশুক।

ঝুকিপূর্ণ প্রানীঃ যারা ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় আছে তারা হ’ল – বানর,শিয়াল,সোনা গুই,টক্কে,গোখরো সাপ,দাড়াশ সাপ,সূতানলি সাপ,মেছোপেচা,ভুতুম পেচা।

হুমকির সম্মুখিন প্রাণীকূলঃ যাদের জীবন হুমকির মুখে তারা হ’ল – ধুষর মাথা মেছোচিল,নোনা বন সুমচা,খয়রি মাছরাঙা।

সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত জল মহিস

সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত জল মহিস

একটা সময় ছিলো যখন সুন্দরবন কেটে আবাদী জমি তৈরী করলে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সে জমির মালিক হওয়ার সুযোগ দেওয়া হ’ত, আর রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার হত্যা করতে পারলে জুটতো বীরের খেতাব।কিন্তু সময়ের পরিক্রমার সাথে সাথে পরিস্থিতি বদলে গেছে।আজকের পরিস্থিতি হ’ল সুন্দরবনকে তার নিজের মত থাকতে দিতে হবে।সুন্দরবনকে ব্যবহার করতে হবে দায়ীত্ব ও জবাবদিহীতার সাথে।সুন্দরবন এখন সারা বিশ্বের পর্যটন কেন্দ্রে রূপ নিয়েছে।প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমন করছে।সে ক্ষেত্রে নির্ধারিত আইন-কানুন সকল পক্ষকে মেনে চলতে হবে।সুন্দরবনে একই সাথ বা অল্প সময়ের ব্যবধানে হাজার হাজার মানুষের প্রবেশ নিরুৎসাহিত করতে নিয়ম করা হয়েছিলো ‘যতো বড় জাহাজই হোক না কেন,৫০ জনের বেশী মানুষ কোন জাহাজেই সুন্দরবন যেতে পারবে না,এবং জাহাজে প্রত্যেকের জন্য নিজস্ব বেড থাকতে হবে।’ কিন্তু বনবিভাগের দায়ীত্বরত কর্মীদের সহয়তায় এক শ্রেনীর ব্যবসায়ী এক একটি জাহাজে (এর অনেকগুলিই যাত্রীবাহি লঞ্চ)৩০০ থেকে ৫০০ যাত্রী নিয়ে সুন্দরবন ভ্রমনে হর-হামেশাই যাচ্ছে।বন বিভাগের দায়ীত্বরত কর্মীরা এ ক্ষেত্রে ৫০ থেকে ৭০ জনের ভ্রমন কর দপ্তরে জমা দিয়,বাকি টাকা নিজেরা হাতিয়ে নেয়,আর এই অবৈধ টাকার লোভে তারা সুন্দরবনকে নীলামে তুলছে।এ সকল বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হলেও অবস্থার পরিবর্তন হয় নি। তবে অবস্থার পরিবর্তনের আভাস মিলছে, আসছে সুন্দরবনে পর্যটনের নীতিমালা, যে নীতিমালা সুন্দরবনকে রক্ষা করতে সার্বিক আইন-কানুন প্রণয়ন করবে বলেই সকলের বিশ্বাস। রসুন্দরবনকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে,আর সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকেই জবাবদিহীতার আওতায় আসতে হবে,অন্যথায় এখনও যা আছে তাও  হয়ে যাবে বিলুপ্ত।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *