দুর্নীতির সূতিকাগার স্থায়ী আমলাতন্ত্র’র বিলোপ না হলে বাংলাদেশের দুর্নীতি নির্মূল হবে না

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) ২০১৪ সালের দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রকাশ করেছে। ১৭৫টি দেশ ও অঞ্চলের উপর পরিচালিত সমিক্ষার উপর ভিত্তি করে এ সূচক তৈরী হয়েছে। তাদের সমিক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশ পৃথিবীর ১৪ তম দুর্নীতিবাজ দেশ, গতবছর যা ছিলো ১৬ তম, অর্থাৎ দুর্নীতিতে আরও উন্নতি করেছে দেশ!

বাংলাদেশের সকল দুর্নীতি মূলত সরকারী দপ্তর কেন্দ্রিক। আমলাদের যোগসাজসেই সব দুর্নীতি সম্পন্ন করতে হয়। এ অবস্থায় বাংলাদেশের সব অর্জন ধ্বংস হয়ে যাবে আমলাদের জন্য, কারণ আমলারা চরম দুর্নীতিবাজ। বাংলাদেশের দুর্নীতির সূতিকাগার আমলাতন্ত্র এ দেশের দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদিয়েছে এবং তাকে প্রতিষ্ঠিত রেখে তাকে নিয়ন্ত্রণও করছে। আর এ ভাবে তারা তাদের চাকুরিদাতা অর্থাৎ জনগণের নিকট থেকে ঘুষ ও তাদের (জনগণের) সম্পত্তি লুট করে দুর্নীতির মাধ্যমে প্রতি বছর কামিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। আবার তাদের এই অপকর্মের জন্য এই দেশ ও দেশের মানুষদের দুর্নীতিবাজ বলে গালি দিচ্ছে সারা বিশ্বের মানুষ! তা হলে কি এই আমলা অর্থাৎ চাকর গোষ্ঠি (public servent)’র লুটপাট আর দুর্নীতি প্রতিষ্ঠিত করতে ৩০ লাখ মানুষ রক্ত দিয়ে আর দুই লাখ মা-বোন ইজ্জত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে ? তা হলে কি শহীদদের রক্ত আর মা-বোনদের ইজ্জতের বিনিময় মূল্য হ’ল আমলাদের দুর্নীতির অধিকার প্রতিষ্ঠা আর বিশ্ববাসির প্রদেয় চোর খেতাব ? এ জন্যই দেশ স্বাধীন করা হয়েছে ? চাকরদের অপকর্মের দায়ে দেশ ও দেশের জনগণকে চোর খেতাব নিতে হচ্ছে, এর দায় কে বহন করবে ?

আচ্ছা মুক্তিযুদ্ধে কতজন আমলা অংশ নিয়েছিলো ? নিশ্চই হাতের কর গুনেই সে প্রশ্নের উত্তর হয়ে যাবে। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষ যুদ্ধ করে এ দেশ স্বাধীন করেছে। যে নারীরা দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনের চেয়েও মূল্যবান ইজ্জত দিয়েছে, সেই নারীরাই আজ ঘাম ঝরিয়ে সারা বিশ্বের মানুষের ইজ্জত বাচিয়ে অর্থাৎ বস্ত্র যুগিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির নেতৃত্ব দিচ্ছে। সেই কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষের সন্তানরা ঘাম ঝরিয়ে বিদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি ডলার দেশে পঠিয়ে অর্থনীতি চাঙ্গা করছে, আর দেশে সেই কৃষক-শ্রমিক আজ উৎপাদনে বিপ্লব ঘটিয়েছে। তাদের শ্রমেই মধ্যম ও উচ্চ আয়ের স্বপ্নে বিভোর বাংলাদেশ। বাঙালীর এ সব অর্জনই মূহুর্তে ভূ-লুন্ঠিত হবে এক গোষ্ঠি চাকরের দৌরাত্মে ? বাঙালীর সব ত্যাগ এত সস্তায় হাত ছাড়া হয়ে যাবে ? বাঙালী কখন ঘুরে দাড়াবে ? বাঙালীর সব আত্মসম্মান বোধ, সব পৌরুষ কি সুবিধাবাদের চোরাগলিতে হারিয়ে যাবে ?

আসলে বাংলাদেশের প্রধানতম বিষফোঁড়া হ’ল এ দেশের ‘স্থায়ী’ আমলাতন্ত্র। আর পারস্পরিক যোগসাজসে দুর্নীতির ফল ভোগ ও চরম স্বেচ্ছাচারী শাসন ব্যবস্থা ধরে রাখতে রাজনৈতিক সরকারগুলিই এ ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছে। কোন স্বাধীন রিপাবলিক-এ ‘স্থায়ী আমলাতন্ত্র’ রিপাবলিক’র নিতীর সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যহীন, কাঠালের আমসত্ত্ব’র মত ! সিন্দাবাদের ভূতের মত পিপলস্‌ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’র ঘাড়ে চেপে বসা আমলাতন্ত্র’র জন্ম বৃটিস দখলদারদের জঠরে।

কেমন ছিলো সে আমলা ? ইতিহাস বলছে, বৃটিস জলদস্যু ক্লাইভ (কোম্পানীর মোড়কে) ১৭৫৭ খৃঃ বাংলা দখল করলে বাংলার শাসন ব্যবস্থা ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে চলে যায়, যা (কোম্পানীর শাসন) পরবর্তী একশ’ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। প্রশাসন চালাতে কোম্পানী রাইটার (বার্ষিক বেতন ৫ পাউন্ড), ফ্যাক্টর, জুনিয়র মার্চেন্ট ও সিনিয়র মার্চেন্ট (বার্ষিক বেতন ৪০পাউন্ড) নামে চার পদের কর্মচারী আমদানী করে ইংল্যান্ড থেকে। আর বিভিন্ন ধরনের কেরানী বা ‘মুন্সি’ ও অন্যান্য কর্মচারী সংগ্রহ করে এ দেশ থেকে। কেরানী বা মুন্সি তৈরী করতে ১৭৮১ খৃঃ ওয়ারেন হেস্টিংস্‌ নির্মান করেন ‘কলকাতা মাদ্রাসা আলীয়া।’ এখানে তৈরী হ’ত ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর জন্য ফার্সি ভাষায় (তখনও সরকারী কাজকর্ম সম্পাদন হ’ত ফার্সি ভাষায়) হিসাব-নিকাশ লেখা মুন্সি (আজকের সরকারী কর্মচারীদের আতুড় ও শিশুকাল)। এই কর্মচারীরা শিশুকালেই রাক্ষস শিশু।

ইংরেজ কোম্পানীর কেরানী-মুন্সি হিসেবে ইংরেজের চাকর-নফর হলেও দেশের মানুষের কাছে এরা তখন জমিদার-লাটবাহাদুর (হেস্টিংস্‌’র দেওয়ান বা ম্যানেজার কোলকাতার জমিদার মহারাজা নবকৃষ্ণ)। এ ক্ষমতা শুধু ইংরেজের কর্মচারী হিসেবে নয়, বিস্তর টাকার মালিক হিসেবে এ সকল মুন্সি-কেরানীরা তখন এক একটা ক্ষুদে নবাব। তাদের এই টাকার প্রধান উৎস হ’ল দুর্নীতি বা ‘ঘুষ’ যা তারা প্রভু ইংরেজের নিকট থেকে খুব ভালো ভাবে রপ্ত করেছিলো।

কোম্পানী প্রশাসনের কর্মচারীদের আয়ের প্রধান উৎস ছিলো ঘুষ। বড় থেকে ছোট সকল কর্মচারীই ছিলো ঘুষ খোর। History of India’র লেখক ‘জেমস্‌ মিল’ (আইরিশ) লিখেছেন, এ দেশে (ভারতে) ইংরেজরা ঘুষ গ্রহণের কৌশলটাকে প্রায় ‘চারুকলার’ পর্যায়ে উন্নিত করেছিলো। প্রত্যেক ক্ষেত্রে পদে পদে যখনই তারা ঘুষ নেওয়ার সুযোগ পেত তখনই তা বিনা দ্বিধায় ও নিঃসঙ্কোচে নিতো। তিনি এর বিস্তর উদাহরণ দিয়েছেন, যেমন- বর্ধমানের ডিসি (ডেপুটি কালেক্টর) জন ব্যাথো (John Batho) স্থানীয় জমিদারকে লবন ব্যবসায় অবৈধ সুযোগ-সুবিধা (২ বছরের জন্য) প্রদানের বিনিময়ে ঘুষ নেয় ২৮ হাজার টাকা (বর্তমানে প্রশাসন যে ভাবে নদী-খালগুলি ইজারা দিচ্ছে)। এর মধ্যে সে নিজে রাখে ১৪ হাজার টাকা, আর ভাগা হিসেবে ১৪ হাজার টাকা প্রদান করে কোম্পানীর কাউন্সেলর চীফ জর্জ ভ্যান্সিটার্ট (৪১৪৮ টাকা) সহ অন্যান্য অফিসারদের। ঘুষের ভাগা সিস্টেম তখন থেকেই এদেশে চালু হয়!

এ ভাবে পুরো দেশটাই ইংরেজের ঘুষের রাজ্যে পরিণত হয়। আর কোম্পানী শাসনের বিচার বিভাগ বা এ দেশের বিচার বিভাগের যাত্রা অর্থাৎ ইংরেজ প্রণিত আইন ও বিচারের নমুনা চরম নির্লজ্জ বেহায়াকেও লজ্জা দেবে। ১৭৯৫ সালের ১ আগষ্ট কোলকাতা সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণ সিঁদ কেটে চুরির অপরাধে ৬ জন কে প্রাণদন্ড দেয়। এর নয় বছর পর ১৮০৪ সালের ৪ নভেম্বর সুপ্রীম কোর্টের বিচারকগণ জন, ম্যাথু ও মোহাম্মদ কে খুনের দায়ে প্রত্যেকের খুনি কে ১টাকা জরিমানা ও ১ মাসের কারাদন্ড প্রদান করে। বলা বাহুল্য এ সকল বিচারিক তেলেসমাতি ঘটেছিলো ঘুষ নামক ভেল্কির জোরে, যা এ দেশে বর্তমানেও রকমফের-এ বহাল অছে। তাইতো প্রধান বিচারপতি প্রায়সই বিচারকদের হুশিয়ারী দেন সৎ ভাবে বিচারীক কার্য করতে।

১৮৫৮ খৃঃ প্রথম ভারতীয় জাতীয় বিপ্লব (তথাকথিত সিপাহী বিপ্লব) দমনের সাথে সাথে শেষ হয় ভারতে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন ব্যবস্থা। শুরু হয় ভারতে বৃটিস রাজ’র প্রত্যক্ষ শাসন, তবে পূর্বের প্রশাসনিক অবকাঠামো অক্ষুন্ন থাকে, এর সাথে সেকশন ৩২, ইন্ডিয়া এ্যাক্ট ১৮৫৮’র মাধ্যমে প্রশাসনে যোগ হয় ICS বা ইম্পেরিয়াল সিভিল সার্ভিস (পরে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস)। এতে প্রথমে শুধু ইংরেজরাই সুযোগ পেত। পরে ICS অফিসার পদে কালো ইংরেজদেরও নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রথম কালো ইংরেজ ICS অফিসার হন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ খৃঃ)।

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে বৃটিসরা ভারতবর্ষ থেকে পাততাড়ি গোটালে তার জঠরে উৎপন্ন আমলাতন্ত্রের পরিচয় দাড়ায় ICS ও PCS (পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস)। এর পর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আমলাতন্ত্রের পরিচয় হয় BCS। আমাদের দুর্ভাগ্য বৃটিস এবং পাকিস্তানীদের তাড়ানো গেলেও জাতীর ঘাড় থেকে দুর্নীতির ল্যাবরেটরী বৃটিস প্রেতাত্মা এই আমলাতন্ত্রকে তাড়ানো সম্ভব হয় নি, অথচ একটি স্বাধীন রিপাবলিকে স্থায়ী আমলাতন্ত্র হ’ল গণস্বার্থ বিরোধী ব্যবস্থাপনা। এখানে আমলাতন্ত্র হতে হবে সরকারের নিজস্ব সেটআপ। যে সরকার ক্ষমতায় আসবে সে তার সময়কালের জন্য সেক্রেটারিয়েট গঠন করবে। সরকারের সময় শেষ সেক্রেটারীদের চাকরিও শেষ। দুই সরকারের আমলারা হবে পরস্পরের প্রতিপক্ষ, এজ সরকারের আমলাদের পেছনে লাগবে অন্য সরকারের আমলারা, ফলে দুর্নীনি করলে তাদের  ঠেকানোর কেউ থাকবে না। অথচ এখন সরকার যায় সরকার আসে আমলার কোন পরিবর্তন হয় না। এ কারণে তার শিকড় এখন গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করেছে, এটা তার দুর্নীতির শিকড়ও।

সরকারের সকল নির্বাহী বিভাগগুলি স্থায়ী আমলাতিন্ত্রের নিয়ন্ত্রনে। এখানে চোরও আমলা, পুলিশও আমলা, দুর্নীতিবাজও আমলা আবার বিচারকও (দুর্নীতির তদন্তকারী) আমলা। সরকার চলেগেলেও তারা থাকে তাদের দৃঢ় ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়েই। তা হলে কে কার বিচার করবে ? আমলারাই রাষ্ট্রের একমাত্র স্থায়ী কর্র্তৃপক্ষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে, তাই তার অপরাধের নিরপেক্ষ বিচার হওয়া এ রকম একটি ব্যবস্থায় আদৌ সম্ভব নয়। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে টিকে থাকা বাংলাদেশের দুর্নীতি ‘স্থায়ী আমলাতন্ত্র’ কে উৎপাটন না করে নির্মূল করা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *