ধানের জন্ম ইতিহাসঃ শেষ পর্ব

খাদ্য হিসাবে ধানের ব্যবহার ও উৎপাদনের ক্রমবিকাশঃ

ধানের আদি গল্পে জানা যায়, ধান ভেজে খই করে খাওয়া হ’ত। হয়তো এ প্রথা অনেক দিন ছিল। এরপর হয়তো কোনো গৃহস্থ বধূ বা কিষান পাখিকে দেখল সে কিভাবে ঠোঁট দিয়ে ঠুকে ঠুকে ধান থেকে চাল বের করে খায়। এটা দেখে মানুষ ধান থেকে চাল বের করার বিভিন্ন পদ্ধতি বের করতে থাকার এক পর্যায়ে আবিস্কার করে কাহিল ছিয়া ও পরবর্তীকালে ঢেঁকি ওযাঁতা। আরও পরে কক্সবাজারে ধান ভাঙ্গানোর দেশী কল ডোলন দিয়ে ধান ভাঙ্গানোর প্রযুক্তি উদ্ভাবন হয়।

এভাবেই হয়তো আতপ চাল করার প্রযুক্তি তৈরী করে চাল ভাজা হতো এবং পরবর্তীকালে চাল সেদ্ধ করে ভাত রান্নার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়। ধান প্রথমে পানিতে ভিজিয়ে পরদিন ধান সেদ্ধ করে তা ফের রোদে শুকিয়ে তারপর শুকনো ধান থেকে চাল ও তা পানি দিয়ে সেদ্ধ করে ভাত রান্না করার কলাকৌশল রপ্ত করতে হয়তো হাজার বছর লেগেছিল। এই সমুদয় কাজের সঙ্গেও ধান জাতির উন্নতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল।

ধান থেকে চিঁড়া তৈরি করার কৌশল আবিস্কার করতেও মানুষের অনেক সময় লেগে যায়। এই চিঁড়া কিন্তু অল্প আয়াসে ভাত তৈরী করার একটা চমৎকার পদ্ধতি। মার্কিন মুল্লুকে এক ধরনের চাল পাওয়া যায় যা থেকে একটু রান্না করেই ভাত পাওয়া যায়। তারা এ পদ্ধতিটিকে বলে ইনস্ট্যান্ট রাইস। এ দেশের চিঁড়াও কিন্তু এক ধরনের ইনস্ট্যান্ট রাইস।

মানুষের সবচেয়ে বেশী সময় লেগেছে চাল থেকে মুড়ি তৈরী করার হেকমত আবিস্কার করতে। ধান ভাজলে খই হয় চাল ভাজলেই মুড়ি হয় না। ভাজা চাল আর মুড়ির ভেতর আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ধানকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় চাল করে নিয়ে সে চালের ভেতর লবণ-পানি দিয়ে চাল ভিজিয়ে তা প্রায় ৩০০ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার গরম বালিতে ঢেলে দিয়ে নিমিষেই মুড়ি তৈরী করা হয়। একটু হেরফের হলেই চাল পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

অনেক সময় নিশাদল মেশানো পানি দিয়ে মুড়ির চাল ভেজানো হয়। ওই নিশাদল ৩০০ ডিঃ সেঃ গরম বালির সংস্পর্শে এসে তৈরী করে ইউরিয়া গ্যাস আর সে গ্যাস মুড়িকে ধবধবে সাদা করে দেয়। আজকাল নিশাদল না দিয়ে লবণ পানিতে সামান্য পরিমাণ ইউরিয়া দিয়েও একই কাজ হয়। মুড়ি করার সময় এ ভাবে ইউরিয়া ব্যবহার করা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি বলে মনে করেন অনেকে। আবার অনেকে বলেন, ভাজা মুড়িতে ইউরিয়া থাকে না। কেননা, ৩০০ ডিঃ সেঃ তাপে ইউরিয়া ভেঙ্গেচুরে এমোনিয়া গ্যাস হয়ে বাতাসে মিশে যায়, মুড়িতে থাকে না।

সে যা-হোক, ধান চাল শিল্পে মুড়ি তৈরির কলা-কৌশল গৃহস্থ বধূর আবিস্কার। তবে এ জন্য গৃহস্থ বধূকে কোনো ব্যাক্তি বা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো পুরস্কার দেওয়া হয় নি।

বিংশ শতাব্দীর উফশী ধানঃ

এ দেশে গৃহস্থ এখনো ক্রীতদাসের ভূমিকা পালন করে চলেছে। এ দেশের বেশির ভাগ ধানচাষি বর্গা, পত্তনি বা প্রান্তিক চাষি। এরা বিনা সারে ক্রমাগত ভাবে ধান চাষ করতে গিয়ে নেগেটিভ সিলেকশন পদ্ধতিতে ধান জাতের ক্রমাবনতি ঘটিয়েছে। কেননা, যে সব জাতের ধান চাষ করতে বেশি সার-পানি যত্নআত্তি চায়, তা এসব প্রান্তিক চাষি দিতে পারেন না।ফলে এসব ধানচাষি বাধ্য হয়েই কম উর্বর জমির জন্য কম ফলনশীল জাত বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। অন্যদিকে জাপানি চাষিরা তাঁদের জমিতে উন্নত পদ্ধতিতে বেশি সার, বেশি পানি ও বেশি যত্ন দিয়ে ভালো ভালো আর উচ্চ ফলনশীল ধান জাত তৈরি করে ফলন বাড়িয়েছেন।

অর্থাৎ জাপানি ধানচাষিদের উল্টো দিকে আমাদের ধানচাষিরা চলতে বাধ্য হয়ে উফশী ধান জাত সৃষ্টি না করে তাঁরা তৈরী করেছেন নিফশী বা নিম্ন ফলনশীল ধান।

১৯৬০ সালের দিকে ধান বৈজ্ঞানিকদের ওপর রাষ্ট্র দায়িত্ব চাপিয়ে দেয় যে এ দেশে উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত সৃষ্টি করে দেশের খাদ্য ঘাটতি কমাতে হবে। প্রথমেই চীন, জাপান,তৎকালীন ফরমোজা (বর্তমান তাইওয়ান), অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ প্রভৃতি দেশ থেকে নতুন নতুন ধানের জাত এনে সে সব বোরো মৌসুমে চাষ করা হতে থাকে। কয়েক বছরেই ফুকোবোজা, নবীন, তাইপাই, তাইন্ন প্রভৃতি জাপানি জাতের ধান বোরো মৌসুমে বিঘা প্রতি ২৫-২৬ মণ ফলাতে সক্ষম হয়।

কিন্তু অসুবিধা হলো এসব ধান শুধু বোরো মৌসুমেই ভালো হয়, আউশ বা শাইল মৌসুমে নয়। তা ছাড়াও এদের পাকা ধান গরু দিয়ে মাড়িয়ে খড় থেকে পৃথক করা কঠিন। ধান মাড়াই করতে প্রয়োজন হয় ধান মাড়াই কল। তার পরও দেখা গেল রান্না করা ভাত দলা পাকিয়ে যায়। এসব কারণে এসব উফশী ধান এ দেশের ধানচাষিদের কাছে কদর পায়নি।

তবে তাইচুঙ্গ-৬৫, তাইপাই ১/৭৭ এবং কলুছা জাতগুলো মোটামুটি ভালো। কুমিল্লা একাডেমি থেকে তাইপাই ১/৭৭ কে চাষাবাদ করার জন্য সুপারিশও করা হয়। তবে সে সময় পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর চীন থেকে দুটো উফশী চীনা ধান আনেন। তার মধ্যে চেনচু আই নামক ধান সব ঋতুতেই ভালো ফলন দিতে সক্ষম হয় এবং এ ধান মাড়াই করা সহজতর ও ভাত দলা পাকায় না বিধায় এ দেশের জন্য চেনচু আই কে পূর্ব-পাকিস্তানের পূর্ব আর চীনের চী মিলিয়ে পূর্বচী নাম দিয়ে চাষবাস করার জন্য জোর চেষ্টা করে সফল হওয়া যায়। সুতরাং দেখা যায় যে সে সময় যে সব উফশী ধান জনপ্রিয় হয়ে যায় তার মধ্যে পূর্বচী অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

এরপর মালয়েশিয়া থেকে আনা মালিনজা নামক ধানটিও জনপ্রিয় হতে থাকে এবং তা কুমিল্লা একাডেমি থেকে পাজাম নাম দিয়ে বাজারে ছাড়া হয়। এক সময় এ পাজাম ধান খুবই জনপ্রিয় ছিল। এ পজাম (পাকিস্তানের ‘পা’জাপানের ‘জা’আর মালয়েশিয়ার ‘ম’দিয়ে হয় পাজাম) আজ এ দেশের বাজারে পাইজাম নামে প্রচলিত ও জনপ্রিয়।

এরপর আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট যা দেশে ইরি নামে পরিচিত, সে সংস্থা থেকে প্রায় ৩০০ নব-জাতক ধান আই আর-৮ এবং আই আর-৯ নামক দুটো লাইন এ দেশে চাষ করার জন্য সার্বিক চেষ্টা চলে ১৯৮৬ সাল থেকে এবং তা অচিরেই কৃষক সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে ধানচাষে সবুজ বিপ্লবের গোড়া পত্তন করে।

পূর্বে প্রতিষ্ঠিত ইস্ট-পাকিস্তান রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা ইপিআরআরআই, স্বাধীন বাংলাদেশে যার নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা সংক্ষেপে ব্রি।

১৯৬৮ সাল থেকেই এ দেশে ধান গবেষণার শক্ত ভিত তৈরি হয়। ফোর্ড ফাউন্ডেশন, ইরি, ইউএসএইড, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ান সরকারের ধান গবেষণা কাজে সহায়তার ফলে দেশে ধান গবেষেণার আধুনিক কাল শুরু হয়।

স্বাধীনতার পরপরই ভালো ভালো উফশী জাতের ধান সৃষ্টি কারা হয়। যেমন-চান্দিনা (বিআর-১) যা কিনা হাইব্রিড ধানের জনক। বিপ্লব বা বিআর-৩, ব্রিশাইল বা বিআর, দুলাভোগ বা বিআর-৫ ইত্যাদি। এ সব ধান গৃহস্থ’র কাছে সমাদর পায়।

 চান্দিনা, ব্রি-শাইল ওবিপ্লব ধানের ফলন অনেক বাড়িয়ে দেয়। ধান চাষের জন্য বেড়ে যায় সার ও সেচের পানির পরিমাণ। ফলে কয়েকটি নতুন সার কারখানা স্থাপন করা হয়।বিদেশ থেকে আনা ফসফেট ও পটাশ সার আর সেই সঙ্গে জিঙ্ক সালফেট সারও আনতে হয় জমির দস্তার অভাব মেটাতে। ১৯৭৮-৭৯ সালের দিকে বিআর-১১ ধান সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। অগভীর ও গভীর নলকূপ দিয়ে পানি সেচের জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা নেওয়া হয় এবং যার ফলে ১৯৯০ সালের দিকে দেশের চালের চাহিদা পুরোমাত্রায় পূরণ করা সম্ভর হয়।যার ফলে দেশে খাদ্যাভাব দূর হয়ে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। এর ফলে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিকদের দেওয়া হয় স্বর্ণ পদক।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *