মোড়কে পাট পণ্য ব্যবহার আইন দ্রুত বাস্তবায়ন ও রাষ্ট্রয়াত্ব পাটকল হোল্ডিং কোম্পানী করার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে

পাট ও পাট শিল্প রক্ষা কমিটির উদ্যোগে গত ২৩ জুলাই খুলনা প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক খালিদ হোসেন।

লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ নং চ.ঙ-২৭ অনুযায়ী ব্যাক্তি মালিকানাধীন ও পরিত্যাক্ত পাটকল সাবেক ইপিআইডিসি’র পাটকল সহ ৬৭ টি পাটকলের তদারকী, পারচালনা, নিয়ন্ত্রনের লক্ষে বাংলাদেশ পাট কল কর্পোরেশন (বিজেএমসি) গঠিত হয়। পরর্বীতে ১৯৭২ সালের মধ্যেই রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ৫১,৮৭ এবং ১৫৩ অনুযায়ী আরো ১০টি জুটমিল জাতীয়করণ করে বিজেএমসি’র নিয়ন্ত্রনে ন্যাস্ত্ম করা হয়। ১৯৭৪ ও ১৯৭৬ সালে ২টি নন জুট মিল বিজেএমসি’র অধিনে ন্যাস্ত্ম করা, বিজেএমসি কর্তৃক ১টি নন জুট মিল ও ২টি কার্পেট মিল স্থাপনের মাধ্যমে সর্বমোট মিলের সংখ্যা দাড়ায় ৮২টি। সরকার ঘোষিত নীতি অনুযায়ী মোট ৮২ টি পাটকল হতে ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮৬ সময়কালে (১৯৮০ সালে বিশ্বব্যাংকের সাথে চুক্তিনুযায়ী”জুট ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল রিহ্যাবলিটেশন” কর্মসুচির আওতায়) মোট ৪৩ টি পাটকল বিরাষ্ট্রীয়করণ এবং ১ টি পাটকল (বনানী) ময়মনসিংহ পাটকলের সাথে একীভুত করার পর বিজেএমসি’র নিয়ন্ত্রণাধীন মিল সংখ্যা ৮২ থেকে কমে ৩৮ টিতে দাড়ায়। ১৯৯৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাংকের পাট খাত সংস্কার কর্মসূচীর আওতায় সরকারী সিদ্ধান্ত্ম অনুযায়ী এ পর্যন্ত্ম বিভিন্ন সময়ে মোট ১১ টি মিল বন্ধ বা বিক্রি বা একীভুত করার ফলে বর্তমানে বিজেএমসি’র নিয়ন্ত্রণাধীন মিলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭টি।

উলেস্নখ্য যে, আমিন জুটমিলের মধ্যে অবস্থিত আমিন ওল্ডফিল্ড এবং কর্নফুলি জুটমিলের মধ্যে ডিডিএফ মিল বা ইউনিট ২ টি তালিকায় ধরলে বর্তমান মোট মিলের সংখ্যা দাড়ায় ২৯ টি।

 

বিশ্ব ব্যাংক ও আই এম এফ এর প্রেসক্রিপসন অনুযায়ী ৮০ দশক থেকে স্ট্রাকচারাল আডজাষ্টমেন্ট প্রোগ্রাম নামে মিল বন্ধ ও বিক্রির প্রক্রিয়া শুরম্ন হয়। সেই সময় পাট উৎপাদন হতো সাড়ে ৬ লাখ টন। ১৯৭৮ সাল থেকে পাটকল বেসরকারীকরন শুরম্ন হয়। ১৯৯৪ সালে বিশ্বব্যাংকের সাথে জুট সেক্টর এডজাস্টমেন্ট ক্রেডিট নামে ২৪৭ মিলিয়ন ডলার ঋন প্রপ্তির আশায় চুক্তি করে ঋন পায় মাত্র ৫২ মিলিয়ন ডলার, অথচ ১৯৯৩-১৯৯৪ সালে ৫টি রাষ্ট্রয়াত্ব পাটকল(ময়মনসিং জুটমিল,বাওয়ানি জুটমিল,মনোয়ার জুটমিল,পূর্বাচল জুটমিল ও হাফিজ টেঙ্টাইল) স্থায়ী ভাবে বন্ধ করা হয়। ১৭টি মিল পর্যয়ক্রমে টেন্ডার দেওয়া হয়। কিন্তু উলেস্নখযোগ্য দাম ও ক্রেতার অভাবে এগুলি বিক্রি করা যায়নি। চুক্তির শর্ত অনুযায়ি ২৫ হাজার শ্রমিক ছাটই করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালের ২৪ জানুয়ারী এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল বন্ধ করে দেওয়া হয়। খুলনার দৌলতপুর জুট মিল, টংগীর নিশাত জুটমিল বন্দ করা হয়। ২০০৭ সাল পর্যন্ত্ম ৫৮টি সরকারী পাটকল বিক্রি ও বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। শুধু আদমজীরই ৪০ হাজার শ্রমিক চাকুরিচ্যূত হয়।

 

তিনি বলেন, বর্তমান সরকার তার নির্বচনী অংগীকার অনুযায়ী বন্ধ/লীজে থাকা জুটমিলগুলি চালু করে। মিলের শ্রমিক – কর্মচারীদের বকেয়া পাওনা পরিশোধ করে। ব্যাংকের দেনা সরকার তার ঘাড়ে নেয়। মিলে সময় মত পাট ক্রয় সহ মিলের কিছু উন্নয়নমুলক কাজ করে। মিলে নতুন করে বেশ কিছু শ্রমিক কর্মচারী নিয়োগ দেয়। শ্রমিকদের মজুরি কমিশন ঘোষনা করে ও তা ২০০৯ সালের জুলাই থেকে বাস্ত্মবায়ন শুরম্ন হয়। এ সকল এরিয়ার’র টাকা কয়েক কিস্ত্মিতে প্রদান করা হয়েছে। তবে পুনঃচালুকৃত মিলগুলিতে এর বৈষম্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পুনঃচালুকৃত মিলের শ্রমিকদের এখনও দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করানো হচ্ছে। এর মধ্যে খালিশপুর জুটামল, দৌলতপুর জুটমিলের শ্রমিকরা দৈনিক ভিত্তিক মজুরি কমিশনের কিছু সুবিধা পেলেও কর্নফুলি, ফুরাত কর্নফুলি,ডিডিএফ জুটমিলের শ্রমিকরা এ সকল সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এমনকি তাদের মুজিরও খুব কম দেওয়া হয়।

আভ্যন্ত্মরীন বাজার ও বিদেশের বাজারের পন্য বিক্রির সংকটের কারণে পাট পণ্যের ন্যায্য মুল্য পাওয়া যাচ্ছেনা। তবে এটা সরকারের নীতি ও পরিকল্পনার অভাবে বেশী সংকট তৈরী হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম বিষয় মোড়কে পাটজাত পন্য ব্যাবহার আইন কার্যকর না হওয়া। সরকারী ভাবে কাঁচা পাটের মুল্য নির্ধারন না হওয়ায় কৃষকরা ন্যায্য মুল্য পাচ্ছেনা। ১৬০০টাকা থেকে ২২০০ টাকা মন দরের পাট এখন ৯০০টাকা থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। বিজেএমসির পাট ক্রয়কেন্দ্রগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে পাট উৎপাদনে কৃষকরা প্রযোজনীয় ভর্তূকি পাচ্ছে না ফলে কৃষকরা পাট উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে।

 

তিনি বলেন, মোড়কে পাটপণ্য ব্যবহার আইন-২০১০ পরিবেশ দুষন রোধ, পাট চাষিদের ন্যায্য মুল্য প্রপ্তি নিশ্চিত করতে এবং পাটের বহুমুখী ব্যবহারের লক্ষে প্রণিত বিলটি ৩ অক্টোবর-২০১০ সংসদে পাশ হয়। এ আইন দীর্ঘ ২ বছর পর গেজেট আকারে প্রকাশের মাধ্যমে কার্যকর হয়েছে বলে গেজেটে উলেস্নখ করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয় পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামুলক ব্যবহার আইন,২০১০ এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১২ ইংরেজি তারিখ কে উক্ত আইন কার্যকর’র দিন হিসাবে নির্ধারণ করিল।

 

পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামুলক বিষয়ে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে যে সকল পণ্য বানিজ্যে আইন দ্বারা বাধ্যতামুলক সেই সকল পণ্যের তালিকা –

 

(ক) খাদ্য অধিদপ্তর কর্তৃক সংগ্রহীত ধান,চাল ও গম এর ক্ষেত্রে বর্তমানে ১০০% পাটের বস্ত্মা ব্যহৃত হচ্ছে, চলতি অর্থ বছরেও এ হার অব্যাহত থকবে।

(খ) বেসরকারী মালিকানাধীন রাইস মিল/চাতাল মালিক ও চালের দোকানদারগণ ব্যবসার উদ্দেশ্যে বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে ১০০% পাটের বস্ত্মা ব্যবহার করবেন। বেসরকরী মালিকানাধীন রাইসমিল/চাতাল মালিক ও চালের দোকানদারদের কাছে ষ্টকে যে সকল পিপি ব্যাগ রয়েছে তা ডিসেম্বর/২০১৩ এর মধ্যে ব্যবহার শেষ করতে হবে।

(গ) দেশে উৎপাদিত সার ও আমদানীকৃত সার নির্বিশেষে চলতি অর্থ বছর ৫০% বাধ্যতামুলকভাবে পাটের বস্ত্মায় মোড়কীকরণ করতে হবে।

(ঘ) ধান, চাল, গম ও সারের জন্য সরকার ও কর্পোরেশন কর্তৃক পাটের বস্ত্মা ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিজেএমসি ৫০% ও বিজেএমএ-এর সদস্য পাটকল সমূহ ৫০% হারে পাটের বস্ত্মা সরবরাহ করবে।

(ঙ) চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন ও বেসরকারী চিনিকল কর্তৃক উৎপাদিত চিনির ৫০% লেমিনেটেড হেসিয়ান ব্যাগ(বিএসটিআই এর মান অনুযায়ী) দ্বারা মোড়কীকরণ করতে হবে এবং

(চ) তফসীলভুক্ত পণ্য ভুট্টা’র মোড়কীকরণে ১০০% পাটজাত বস্ত্মা ব্যবহার অব্যাহত থাকবে।

 

তিনি বলেন, দুঃখজনক হলোও সত্য যে এ আইন বাস্ত্মবায়নে মন্ত্রনালয় ও সংশিস্নষ্ট অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ২/১টি বিঞ্জাপন, কিছু পোষ্টার আর গুটি কয়েক ব্যাক্তিদের সাথে মত বিনিময় ছাড়া বাস্ত্মব ক্ষেত্রে কোন উদ্বোগ গ্রহণ করা হয়নি।

 

উলস্নখ্য যে, প্রতিবেশী দেশ ভারতে মোড়কীকরণের কাজে পাট জাত পণ্য ব্যবহার বাধ্যতামুলক করে ১৯৮৭ সালে আইন করা হয়েছে এবং পাট পণ্যের একটি বড় অংশ তাদের দেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এ আইন পাশের পর ভারত তার আভ্যন্ত্মরিন বাজারে ৬০ শতাংশ পাট পণ্য ব্যবহার করে। আর বাংলাদেশ ভারতে সবচেয়ে বেশী কাচা পাট রপতানী করে। আথচ বাংরাদেশে পাট পণ্য ব্যবহার হয় ১৫ শতাংশের নিচে।

 

পাট ও পাটপন্যকে লাভজনক করতে আমাদের দেশের মধ্যে যে সকল বাধা ও সমাস্যার সমাধান করা প্রয়োজন সেই সকল বিষয়ে বিজেএমসি বা সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোন উদ্বোগ আছে বলে এখনোও পর্যন্ত্ম মনে হচ্ছেনা। বৈদেশিক বাজার সমস্যা আর উৎপাদন খরচ কমানোর কথা বলা হচ্ছে। আর ব্যায় সংকোচন নীতিতে এ পর্যন্ত্ম শুধু শ্রমিক ছাটাই, মজুরী কম দেওয়া ও রাষ্ট্রায়ত্ব মিল বন্ধ করা হয়েছে, অথচ পাট পণ্য ব্যবহার আইন কর্যকর করে অন্ত্মত ৫০% পাট দেশে ব্যবহার করা গেলে আর দুর্নীতি রোধ করা গেলেই পাট পাটশিল্পকে লাভ জনক শিল্পে পরিণত সম্ভব।

 

পাটকে কৃষিপন্য ঘোষনার দাবী দির্ঘদিনের যা করলে কৃষিপন্য হিসাবে বিশ্ব বাজারে নানা বিধ রপ্তানী বাধা কমানো সহ অন্যান্য বানিজ্যিক সুবিধা পাওয়া যেত। সে সব না করে হটাৎ করে রাষ্ট্রয়াত্ব পাটকল কে হোল্ডিং কোম্পানী করার সিদ্ধান্ত্ম যা পাটশিল্পকে চূড়ান্ত্ম ভাবে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে। তিনি বলেন,মিলগুলি ক্রমান্বয়ে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। শ্রমিকরা মজুরি ও মিল চালুর দাবীতে রাজপথে আন্দোলন করছে। এমতাবস্থায় সরকারের সম্পুর্ন ব্যার্থতার জন্য মিলকে ছেড়ে দেওয়ার নামে হোল্ডিং কোম্পানী করার নীতির ‘আমরা’ তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *