সুন্দরবন সংরক্ষণে কার্যকর ভাবনা, গণভিত্তিক পরিবেশ বান্ধব পর্যটন

সুন্দরবন উৎসবে পটগান পরিবেশন জরছে সাংস্কৃতিক দল

সুন্দরবন উৎসবে পটগান পরিবেশন করছে সাংস্কৃতিক দল

সুন্দরবন সংরক্ষণে কার্যকর ভাবনা কম্যুনিটি বেইজ বা গণভিত্তিক ইকো-ট্যুরিজম,যা কাজ করবে কঞ্জারভেশন থ্রু ইকো-ট্যুরিজম বা পরিবেশ বান্ধব পর্যটনের মাধ্যমে সুন্দরবন সংরক্ষণে। অর্থাৎ সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামগুলির সুন্দরবন নির্ভর মানুষের জীবীকার জন্য সুন্দরবন নির্ভরতা কমিয়ে আনা এবং তাদের জন্য বিকল্প জীবীকার ব্যবস্থা সৃষ্টি করা। আর এ ক্ষেত্রে সুন্দরবন ধ্বংস (বিভিন্ন ধরণের সম্পদ আহরণ) না করে সুন্দরবন কে সংক্ষণ করেই বিকল্প জীবীকার ব্যবস্থা করা সম্ভব কম্যুনিটি বেইজ ইকো-ট্যুরিজম’র মাধ্যমে।

এ উদ্দেশ্যে ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটস্‌, ইউএসএ’র সহায়তায় ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে সুন্দরবন সংলগ্ন লাউডোব,বানিশান্তা ও কৈলাশগঞ্জ ইউনিয়নে ‘কঞ্জারভেশন থ্রু ইকো-ট্যুরিজম’ প্রকল্প হাতে নেয় বেসরকারী সংস্থা ‘রূপান্তর ইকো-ট্যুরিজম।’ প্রকল্পের প্রাথমিক কর্ম পরিকল্পনা হ’ল উল্লিখিত এলাকার গ্রামগুলিতে পর্যটন পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং সে উদ্দেশ্যে মানব সম্পদ উন্নয়ন। এ ছাড়া সুন্দরবন রক্ষায় ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্ঠির লক্ষ্যে প্রচারণার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে তৃণমূল থেকে কাজ শুরু করা।

বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হ’ল সুন্দরবনের পাশাপাশি সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার গ্রামগুলির অধিবাসিদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি, তাঁদের তৈরী বিভিন্ন পণ্য সহ নানাবিধ বিষয়।

উৎসব উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত র‌্যালী

উৎসব উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত র‌্যালী

যদি এই গ্রাম্য ঘরগুলিতে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন টয়লেট, থাকার ঘর, বিদেশীদের চাহিদা অনুযায়ী খাদ্যের ব্যবস্থা করা যায়, যদি মুটামুটি মান সম্পন্ন হস্তশীল্প তৈরী সম্ভব হয় যা আদৌ কঠিন নয়, তবে পর্যটকদের রাত্রী যাপন,খাদ্য সরবরাহ,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রদর্শন ও বিভিন্ন ধরনের হস্তশীল্প বিক্রয়ের মাধ্যমেই এক একটি পরিবার হাজার হাজার টাকা আয় করতে সক্ষম হবে, যা তাঁদের বন নির্ভরতা থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করবে।

জনসচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সংস্থাটি গ্রহণ করে একটি ব্যাতিক্রমি মৌলিক কার্যক্রম। উল্লিখিত এলাকায় অবস্থিত ১২টি প্রাথমিক ও ছয়টি মাধ্যমিক স্কুলের সকল ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে সংস্থাটি আয়োজন করে সুন্দরবন ভিত্তিক চিত্রাঙ্কন ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা উৎসব। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার বিষয় ছিলো ‘সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্য’ এবং বিতর্ক প্রতিযোগীতার বিষয় ছিলো ‘সুন্দরবন সংক্ষণে স্থানীয় জনগণের ভূমিকাই প্রধান।’ ২০১৪ সালের পুরো মার্চ মাস জুড়ে চলে এ প্রতিযোগিতার বিভিন্ন পর্ব।

কৈলাশগঞ্জের বঙ্গবন্ধু মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কৈলাশগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বানিশান্তার আমতলা বানিশান্তা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও তালুকদার আখতার ফারুক মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং লাউডোবের বুড়িরডাবুর এসইএসডিপি মডেল হাই স্কুল ও লাউডোব বাদামতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ১৫০০ জন শিক্ষার্থী ও ৬০ জন শিক্ষকের অংশগ্রহণে পরিচালিত হয় বিতর্ক প্রতিযোগীতা।

হস্তশিল্পীদের তৈরী নঁকশি কাথা

হস্তশিল্পীদের তৈরী নঁকশি কাথা

অন্যদিকে, তিনটি ইউনিয়নের ১২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৪০০ শিক্ষার্থী এবং এ সকল বিদ্যালয়ের প্রায় ৬০ জন শিক্ষক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগীতার কার্যক্রমে অংশ নেন। মাসব্যাপি এ সকল কার্যক্রমের যাচাই-বাছাই চলে। বিতর্ক প্রতিযোগীতার চূড়ান্ত পর্বে উন্নিত হয় কৈলাশগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং লাউডোব বাদামতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়। চিত্রাংকন প্রতিযোগীতায় প্রাথমিক পর্বে ১২টি স্কুলের ৩২০ জন শিক্ষার্থী মনোনিত হয় এবং এদের মধ্য থেকে চূড়ান্ত পর্বে উন্নিত হয় ৮০জন শিক্ষার্থী। প্রতিযোগীতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হয় গত ৪ এপ্রিল।

চূড়ান্ত পর্বে বিতর্ক প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হয় লাউডোব বাদামতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগীতায় প্রথম হয় কৈলাশগঞ্জ শ্যামাপদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেনীর ছাত্র পলাশ দাশ।

মাসাধিক কাল যাবৎ পরিচালিত এই ব্যাতিক্রমধর্মী প্রচারণায় তিনটি ইউনিয়নের প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ নিজিদের একটি উৎসব হিসেবে অংশ নেয়, যা দীর্ঘকাল যাবৎ তাদের দৈনন্দিন জীবন কে প্রভাবিত করবে বলে মনে করেন এলাকাবাসি।

অন্যদিকে, পর্যটনকেন্দ্রিক মানব সম্পদ উন্নয়নে যে সকল কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয় সেগুলি হ’ল ইকো-ট্যুর গাইড ট্রেইনিং, ইউনিয়ন ভিত্তিক সাংস্কৃতিক দল গঠন এবং হস্তশিল্প দল গঠন।

কর্মরত হস্তশিল্পী দল

কর্মরত হস্তশিল্পী দল

তিনটি ইউনিয়ন থেকে ১০ জনের একটি দলের সঙ্গে ট্যুর অপারেটর কোম্পানীর ১০ জন সদস্য ও বন বিভাগের ১০ জন কর্মী কে একত্রে ইকো-ট্যুর গাইড ট্রেইনিং প্রদান করা হয়। এ ছাড়া উল্লিখিত প্রতিটি ইউনিয়ন থেকে ১৫ জন কে নিয়ে তিনটি সাংস্কৃতিক দল গঠন করে তাদের সঙ্গিত, নাটক ও পটগান’র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। একই ভাবে প্রতিটি ইউনিয়ন থেকে ১৫ জন কে নিয়ে তৈরী করা হয় হস্তশিল্প দল, যাদের দেওয়া হয়েছে টেইলারিং ও সুচিকর্মের প্রশিক্ষণ।

এর ফলে উল্লিখিত এলাকায় গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের সামনে সুন্দরবন এলাকার নিজস্ব সংস্কৃতি তুলে ধরতে সক্ষম সাংস্কৃতিক কর্মীদল এবং লোকশিল্প কে সুচিকর্মে ফুটিয়ে তুলে পরিবেশন করতে সক্ষম হস্তশিল্পী দলও।

কৈলাশগঞ্জ হস্তশিল্প দলের দলনেতৃ সর্মিলা সরকার জানান, তাঁর দলের কর্মীরা প্রকল্প চলাকালিন সময়ে  দেশী-বিদেশী পর্যটকদের নিকট তাঁদের তৈরী ১৫ হাজার টাকার বিভিন্ন সামগ্রি বিক্রয় করতে সক্ষম হন। যা তাদের সক্ষমতা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে।

প্রকল্পের সমাপনি উপলক্ষে আয়োজন করা হয় সুন্দরবন উৎসব। উৎসবের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো ‘পরিবেশ বান্ধব পর্যটন, নিরাপদ সুন্দরবন।’ ২৪ মে, ২০১৪ তারিখে কৈলাশগঞ্জ শ্যামাপদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে ছিলো মানব সম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় যে সকল কর্মকান্ড পরিচালিত হয় যেমন, সাংস্কৃতিক দল গঠন, হস্তশিল্প দল গঠন ইত্যাদি, তাদের প্রশিক্ষণ কতটুকু মানসম্পন্ন হয়েছে তা পর্যবেক্ষণ করা। এ উদ্দেশ্যে উৎসবে হস্তশিল্প মেলা’র আয়োজন করা হয়, যাতে অংশ নেয় উল্লিখিত দলগুলি। তিনটি স্টলে তাঁরা তাদের হস্তশিল্প কর্ম প্রদর্শন করে। এ ছাড়া সাংস্কৃতিক দলগুলি উৎসবে সঙ্গিত, পটগান ও নাটক পরিবেশন করে, যা উৎসবে আগত সকলের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে।

উৎসবে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খুলনা-১ আসনের সংসদ সদস্য পঞ্চাণন বিশ্বাস, দাকোপ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আবুল হোসেন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেষ্ট্রি এন্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান, সহকারী বন-সংরক্ষক,খুলনা, মোঃ তৌফিকুল ইসলাস সহ বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ ,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *