সোনালি আঁশ পাট: পর্ব-৩

চাষাবাদঃ২

বীজের হারঃ দেশি পাট প্রতি হেক্টরে ৮ থেকে ১০ কেজি। প্রতি একরে সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চার কেজি। তোষা পাট প্রতি হেক্টরে ৬ থেকে ৮ কেজি (প্রতি একরে আড়াই থেকে সাড়ে তিন কেজি) এবং কেনাফ প্রতি হেক্টরে ১৪ থেকে ১৯ কেজি (একর প্রতি ৬ থেকে ৮ কেজি)।

বীজ বপনের পর জমির পরিচর্যাঃ বপনের এক থেকে দেড় সপ্তাহ পর ‘জো’ অনুযায়ী আঁচড়া দিলে মাটি হালকা হয় ও জমিতে রস সংরক্ষিত হয় এবং অল্প খরচে আগাছাও দমন করা সম্ভব হয়। গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য প্রাথমিক অবস্থায় একর প্রতি দুই থেকে আড়াই লাখ চারা থাকা উচিত। বীজ বপনের ৩০-৪০ দিনে সব আগাছা নির্মূল করে সুস্থ ও সবল পাট গাছ রেখে বাকি গাছগুলো জমিতে উর্বরতা ও গাছের বৃদ্ধির সঙ্গে সামাঞ্জস্য রেখে ধাপে ধাপে উঠিয়ে ফেলতে হবে। জলাবদ্ধতা পাটের ফলন ব্যহত করে। তাই পাটের জমিতে যেন বর্ষার পানি দাঁড়াতে না পারে কিংবা পানি জমে গেলেও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পানি বের করে দিতে হবে। আগাছা পাটের চারার বড় শত্রু। বপনের পর থেকে যথাসময়ে দুই বা ততোধিকবার নিড়ানি দিয়ে আগাছা উঠিয়ে ফেলা উচিত এবং আঁচড়া কিংবা ‘হুইল হো’ দিয়ে মাটি আলগা করা প্রয়োজন।

সার ব্যবহারের পরিমাণ এবং পদ্ধতিঃ পাটের জমিতে সঠিক সময়ে পরিমানমতো সার ব্যবহার করে পাটের ফলন সহজেই বৃদ্ধি করা যায়। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, রাসায়নিক সারের মধ্যে নাইট্রোজেন সার (ইউরিয়া) ফলন বৃদ্ধির প্রধান সহায়ক। ফসফরাস ও পটাশ সার (টিএসপি ও এমপি) এককভাবে ব্যবহার করে বেশী ফলন পাওয়া যায় না। বিশেষ করে ফসফরাস আঁশের গুণগত মান বৃদ্ধি করে ও পটাশ সার গাছের রোগ প্রতিরোধ করে। অন্যদিকে নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশ একসঙ্গে জমিতে প্রয়োগ করে সাধারণ ফলনের চেয়ে প্রতি হেক্টরে ১ হাজার কেজি অর্থাৎ একরে ৩৭২ কেজির অধিক এবং কোনো কোনো অঞ্চলে আরো বেশি ফলন পাওয়া যায়। বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলের মাটিতে গন্ধক ও দস্তার অভাব রয়েছে, সে সব জমিতে পরিমানমতো গন্ধক ও দস্তা সার প্রয়োগ করে ভালো ফলন পাওয়া যায়। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলো এবং বিভিন্ন অঞ্চলের পাটচাষিদের জমিতে পরীক্ষা করে পাট চাষের জন্য সার প্রয়োগের বিধিব্যবস্থা ও সারের পরিমান নির্ধারণ করা হয়েছে, যদিও মাটি পরীক্ষা করে সারের পরিমাণ নির্ণয় করাই প্রকৃষ্ট উপায়।

কিন্তু যে সব কৃষক মাটি পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন না তারা নিম্নলিখিত সুপারিশ অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে পারেন। যদি গোবর বা অন্য যে কোনো প্রকার জৈব সার পাওয়া যায় তবে অবশ্যই পাটের জমিতে যথাসম্ভব প্রয়োগ করতে হবে। কারণ জৈব সার মাটির উর্বরতা শক্তি ও পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এছাড়া জৈব সারে গাছের প্রয়োজনীয় প্রায় সব ধরনের খাদ্য উপাদান থাকে বলে অন্যান্য রাসায়নিক সার কম লাগে। বাংলাদেশ পাট গবেষনা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত ডি-১৫৪, সিভিএল-১, সিসি-৪৫, সিভিই-৩, কেনাফ, মেস্তা, ও-৪ এবং ও-৯৮৯৭ (ফাল্গুনী তোষা) জাতের জন্য প্রতি হেক্টরে ৪.৬ টন অর্থাৎ প্রতি একরে ১৮.৬ কুইন্টাল গোবর সার বীজ বপনের ২-৩ সপ্তাহ আগে জমিতে সমভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

যদি উপরোক্ত পরিমাণে গোবর সার ব্যবহার করা হয় তাহলে বীজ বপনের দিন ডি-১৪৫, সিডিএল-১, সিসি-৪৫, সিভিই-৩ এবং ও-৪ জাতের জন্য প্রতি হেক্টরে ১৪.৫ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। টিএপি এবং এমপি সারের প্রয়োজন নাই। ফাল্গুনী তোষা জাতের জন্য প্রতি হেক্টরে ৪৯ কেজি ইউরিয়া, ৫ কেজি টিএসপি, ১৪ কেজি এমপি; ওএম-১ জাতের জন্য ৩৭.৫ কেজি ইউরিয়া, ৫ কেজি টিএসপি; কেনাফ এইচসি-৯৫ জাতের জন্য ১৫.৫ কেজি ইউরিয়া, ৫ কেজি টিএসপি এবং মেস্তা-২৪ জাতের জন্য ৪ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে।

গোবর ও অন্যান্য জৈব সারের অভাবে যদি শুধু রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হয়, তাহলে বীজ বপনের দিন ডি-১৫৪, সিভিএল-১, সিসি-৪৫, সিভিই-৩, ও-৪ জাতের জন্য হেক্টরপ্রতি ৮৩ কেজি জিপসাম, ১৭.৩ কেজি জিংক সালফেট একত্রে মিশিয়ে জমিতে ছিটিয়ে চাষ ও মই দিয়ে মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ফাল্গুনী তোষা এবং ওএম-১ জাতের জন্য যথাক্রমে হেক্টর প্রতি ১০০ কেজি ইউরিয়া, ৫০ কেজি টিএসপি, ৬০ কেজি এমপি এবং ৮৮.৫ কেজি ইউরিয়া, ৪০ কেজি এমপি সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে উভয় জাতের জন্য প্রতি হেক্টরে ৯৭ কেজি জিপসাম ও ১৭.৩ কেজি জিংক সালফেট প্রয়োগ করতে হবে। মেস্তা এইচএস-২৪ এবং কেনাফ এইচসি-৯৫ জাতের জন্য যথাক্রমে ৫৫ কেজি ইউরিয়া, ২৫ কেজি টিএসপি. ৩০ কেজি এমপি এবং ৬৬.৫ কেজি ইউরিয়া, ২৫ কেজি টিএসপি, ৪০ কেজি এমপি সার মিশিয়ে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।

মাটিতে গন্ধক (সালফার) ও দস্তার (জিংক) অভাব অনুভব না হলে জিপসাম ও জিংক সালফেট ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই। বীজ বপনের সময় জমিতে উপরোল্লিখিত পরিমাপের গোবর ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করলেও বীজ বপনের ৬-৭ সপ্তাহ পর জমি নিড়ানি দিয়ে আগাছামুক্ত করে ডি-১৫৪, সিভিএল-১, সিসি-৪৫, সিভিই-৩, ও-৪ জাতের জন্য হেক্টর প্রতি ৮৩ কেজি; ফাল্গুনী তোষার জন্য ১০০ কেজি, ওএম-১ জাতের জন্য ৮৮.৫ কেজি, মেস্তা এইচএস-২৪ জাতের জন্য ৫৫ কেজি এবং কেনাফ এইচসি-৯৫ জাতের জন্য ৬৬.৫ কেজি ইউরিয়া সার কিছু পরিমান শুকনো মাটির সঙ্গে মিশিয়ে জমিতে ছিটিয়ে দিয়ে হো অথবা নিড়ানি যন্ত্রের সাহায্যে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে।

দ্বিতীয়বার সার প্রয়োগের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন প্রয়োগকৃত সার গাছের কচি পাতায় এবং ডগায় না লাগে। আরো লক্ষ্য রাখতে হবে যেন দ্বিতীয় কিস্তির সার দেয়ার সময় মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে রস থাকে।

পাট, মেস্তা ও কেনাফের কিছু মারাত্মক রোগঃ চারা মোড়ক, ঢলে পড়া, কান্ডপচা, শুকনো ক্ষত, কালোপট্টি, গোড়াপচা, আগা শুকিয়ে যাওয়া, পাতায় সাদা গুড়া পড়া।এছাড়া ভাইরাস জনিত রোগ পাতায় হলদে গুঁড়া পড়া এবং ক্রিমি কীটঘটিত ও শিকড়ে গিট রোগ।

পাটের ক্ষতিকর পোকামাকড় ও তাদের দমন পদ্ধতিঃ পোকা মাকড়গুলো হলোঃ ১. উড়চুংগা পোকা, ২. বিছা পোকা বা শুয়ো পোকা, ৩. ঘোড়া পোকা ও ৪. কাতরী পোকা

রোগ ও পোকা দমনের জন্যঃ  সাধারণত ৪০ শতাংশ হেক্টাক্লোর পাউডার একর প্রতি ৪ পাউন্ড অথবা ২০ শতাংশ ডায়েলড্রিন পাউডার ব্যবহার করতে হবে। জোয়াজিনন ৬০ শতাংশ ছমি, নুভাক্রম ৪০ শতাংশ ইসি, ইকালঙ্ ডো ইসি ব্যবহার করা হয়। তোষা, দেশি ১২০ থেকে ১৩২ দিন পর কেটে এবং কেনাফ ও মেস্তা ৯০ থেকে ১০০ দিন পরপর কেটে পাতা ঝরিয়ে নিতে হয়। পরবর্তী সময়ে তা পানিতে জাগ দিয়ে পচন দিলে পাটকাঠি থেকে আঁশ ছাড়াতে হয়। ওই আঁশ শুকিয়ে চাষিরা বাজারে বিক্রয় করেন। মহাজন শ্রেণী শুকনা পাট ক্রয় করে বি বটম, সি বটম, ডি বটম, শামলা, লালী, কাকটা বিভিন্ন শ্রেনীতে বিভাগ করে দেশীয় মিলে বিক্রয় বা বিদেশে রফতানি করে। বাংলাদেশে পাট উৎপাদনে অনেক প্রাকৃতিক উপাদান রয়েছে বিধায় প্রচুর উন্নতমানের পাট উৎপাদন হয়।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *