ব্রিটেনে জঙ্গিসংগঠন হিসাবে জামায়াতে ইসলামী এবং ইস্ট লন্ডন মসজিদ অভিযুক্ত

ব্রিটেন এবং ইউরোপের কিছু দেশ থেকে জঙ্গিদের মদতদাতা, পৃষ্টপোষক এবং সংশ্লিষ্ট সংগঠন ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে গত ১৭ই ডিসেম্বর হাউজ অফ কমন্সে “মুসলিম ব্রাদার হুড রিভিউ : মেইন ফাইন্ডিং” নামে এগারো পৃষ্টার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রায় এক বছরের অধিক সময় ধরে যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের বারোটি দেশের পররাষ্ট্র দপ্তর এবং গোয়েন্দা বিভাগের সহায়তায় পরিচালিত হওয়া এই তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে ব্রিটেন এবং ইউরোপে মুসলিম ব্রাদারহুড, হামাস সহ নানা ধরনের ইসলামিক জঙ্গি সংগঠনের দীর্ঘদিনের ঐক্যসুত্র। যুক্তরাজ্যস্থ অন্য সংগঠনের পাশাপাশি এই দীর্ঘ ঐক্যসুত্র’র অন্যতম প্রধান অকুস্থল হিসাবে পূর্বলন্ডন মসজিদ এবং সংগঠন হিসাবে জামায়াতে ইসলামিকে অভিযুক্ত করা হয়।

ব্রিটেনের অভিজ্ঞ দুইজন সরকারী আমলা স্যার জন জেনকিন্স এবং চার্লস ফার কর্তৃক পরিচালিত এই তদন্তে উঠে আসে কিভাবে পশ্চিমা বিশ্বের উদার অভিবাসন নীতি এবং আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে নামে বেনামে বিভিন্ন চ্যারিটি সংগঠনের মাধ্যমে ফান্ড কালেকশন করে সেই টাকা গরিব দুঃস্থদের নাম ভাঙ্গিয়ে বিভিন্ন মুসলিম দেশের জঙ্গি সংগঠনকে আর্থিক সহায়তা দান করা হয়। তদন্ত রিপোর্টে বলা হয় ১৯২৮ সালে মিশরে নৈতিক শুদ্ধতা এবং ধর্মীয় সংস্কারের আহ্বান জানিয়ে হাসান আল বান্না মুসলিম ব্রাদারহুড নামে প্রথম সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৭০ সালে সংগঠনটি ধীরে ধীরে রূপ নেয় একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে। গঠিত হয় মুসলিম ব্রাদারহুড ছাত্র শাখা, পেশাজীবী শাখা এবং ট্রেড ইউনিয়ন শাখা। এরসাথে যুক্ত হয় বিভিন্ন ছোট বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং চ্যারিটি সংগঠন। ধীরে ধীরে সংগঠনটি তাদের আদর্শ এবং উদ্দেশ্য থেকে চ্যুত হয়ে রূপ নেয় এক জঙ্গি সংগঠন হিসাবে। মিসরের একনায়ক হোসনি মোবারক কতৃক নিষিদ্ধ মুসলিম ব্রাদারহুড।

তদন্তে বলা হয় মিশরের বেশিরভাগ মানুষই মনে করে মুসলিম ব্রাদারহুড তাদের আকাঙ্খা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। তদন্তে বলা হয় ১৯৫০ সাল থেকে মুসলিম ব্রাদারহুড নামের সংগঠনটি তাদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজে হাত দেয়। প্রাথমিক পর্যায়ে আরবের দেশ গুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করলেও ধীরে ধীরে তারা দক্ষিন এশিয়া সহ ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সমমনাদের সাথে সংযোগ স্থাপনের কাজে হাত দেয়। যে সংযোগে প্রথম এবং প্রধান হাতিয়ার হিসাবে তারা ব্যবহার করে ধর্মকে। আল কায়েদা, আই এস সহ আজকে বিশ্বে যত ধরনের ইসলামিক জঙ্গিবাদী সংগঠন এবং তাদের কার্যক্রম রয়েছে মুসলিম ব্রাদারহুডকে তাদের উৎপত্তিস্থল হিসাবে আখ্যা দিয়ে তদন্তে বলা হয় ১৯৫০ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডের আন্তর্জাতিক নেটয়ার্ক স্থাপনের উদ্দেশ্য এবং আজকে বিশ্ব জোড়া ইসলামিক জঙ্গিবাদ একই সুত্রে গাঁথা। তদন্ত রিপোর্টের ছয় নাম্বার পৃষ্ঠায় উঠে আসে পঞ্চাশ বছর ধরে ব্রিটেনে মুসলিম ব্রাদারহুড এবং জঙ্গিবাদী সংগঠন এবং তাদের কার্যক্রম। ব্রিটেনে উচ্চ শিক্ষার্থে আসা ছাত্র এবং নানা ভাবে আসা অভিবাসীদের হাত ধরেই ব্রিটেনে গড়ে উঠেছে জঙ্গিবাদী সংগঠনের শাখা এবং অর্থ যোগানদায়ী প্রতিষ্ঠান। ব্রিটেনে ধর্মীয় মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ এবং ধর্মীয় ঘৃনা ছড়াতে যে সকল সংগঠন কাজ করছে তাদের প্রধান হোতা এবং সমন্বয়কারী হিসাবে দক্ষিন এশিয়ার ইসলামী মৌলবাদী রাজনৈতিক নেতা আবু আ’লা মৌদুদী প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামীকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

শুরুর দিকে ব্রিটেনের সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে এদের তেমন কার্যক্রম চোখে না পড়লেও ১৯৯০ সালের দিকে ব্রিটেনস্থ এই সব ধর্মীয় সংগঠন সামাজিক এবং রাজনৈতিক ভাবে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। মুসলিম ব্রাদারহুড নিজেদের পর্দার আড়ালে রেখে বিভিন্ন নামে নানা দেশীয় মুসলিম কমিউনিটিতে ধর্মীয় সংগঠন তৈরী করে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। দক্ষিন এশীয় মুসলমান কমিউনিটিতে এই কার্যক্রমের নেতৃত্ব দেয় জামায়াতে ইসলামী এবং আবু আ’লা মৌদুদির অনুসারীরা। এর কয়েক বছর পরেই গঠিত হয় “ইসলামিক সোসাইটি অফ ব্রিটেন” (IBS), মুসলিম এসোসিয়েশন অফ ব্রিটেন (MAB) এবং মুসলিম কাউন্সিল অফ ব্রিটেন (MCB) ফিলিস্থিনে এবং ইরাকে মুসলমান দের উপর হামলা এবং নানা ধরনের ধর্মীয় ইস্যুকে পুঁজি করে ব্রিটেনস্থ মুসলিম কমিউনিটিকে রাজনৈতিক ভাবে একত্রিত করতে মুসলিম এসোসিয়েশন অফ ব্রিটেন (MAB) ব্রিটেনের রাজনীতিতে খুব সক্রিয় হয়। হাউজ অফ পার্লামেন্টে সমমনা মানুষদের প্রতিনিধি করতে নিজেদের সমর্থিত প্রার্থীদের জন্য নানা প্রচারনায় নাম মুসলিম এসোসিয়েশন অফ ব্রিটেন। লক্ষ্য একটাই ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছা।

প্রতিবেদনে উঠে আসে কিভাবে এসব জঙ্গি মদদদাতা চ্যারিটি সংগঠন ব্রিটেন থেকে তহবিল সংগ্রহ করে নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা জঙ্গিদের অর্থ যোগান দিয়ে থাকে। এদের মধ্যে অনেকেই সংগৃহিত তহবিল ব্রিটেনস্থ মুসলিম ব্রাদারহুডের জন্য ব্যায় করলেও বেশিরভাগ অর্থ প্রেরণ করা হয় হামাস সহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের ব্যায় সংকুলানে।মুসলিম এসোসিয়েশন অফ ব্রিটেন (MAB) এর সাথে সংযুক্ত ফাউন্ডেশন অফ ইসলামিক অর্গানাইজেশন অফ ব্রিটেন ইন ইউরোপ (FIOE) নামের সংগঠন ১৯৮৯ সালে তৈরী হয় যা মুসলিম ব্রাদারহুডের আরো একটি সহযোগী সংগঠন হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে। রিপোর্টে বলা হয় মৌদুদী অনুসারী এবং জামায়াত নিয়ন্ত্রনাধীন বিভিন্ন সংগঠন পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেট সহ গোটা ব্রিটেনে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রধান সহযোগী সংগঠন হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে। এদের মধ্যে দ্য ইউকে মুসলিম মিশনের নামে তাদের নিয়ন্ত্রণে অন্ততঃ পঞ্চাশটি মসজিদ রয়েছে যেখান থেকে সব ধরনের প্রচার প্রচারণা চালানো হয়। ইসলামিক ফোরাম ফর ইউরোপ (IFE) ব্রিটিশ মূল ধারার রাজনীতিতে খুবই সক্রিয়। পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটের স্থানীয় সরকারের কিছু অংশ রেসপেক্ট পার্টি এদের দ্বারা সমর্থিত। রিপোর্টে আরও বলা হয় ইস্ট লন্ডন মসজিদের ট্রাস্টি লন্ডন মুসলিম সেন্টার ও ইসলামিক ফোরাম ফর ইউরোপ (IFE) এর সাথে সম্পৃক্ত।

উক্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে তাঁর এক লিখিত বক্তব্যে বলেন, “আমরা ইতিমধ্যে এই তদন্ত রিপোর্ট গুরুত্বের সাথে আমলে নিয়েছি এবং যথাযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছি। ব্রিটেনে বসবাস করে ব্রিটেনে অথবা বিশ্বের যেকোনো দেশে জঙ্গিবাদের পৃষ্টপোষকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সরকার। ইতিমধ্যে নেওয়া নানা পদক্ষেপের সাথে আরও যে সব কার্যক্রম পরিচালিত হবে তা হলো -ব্রিটেনে জঙ্গিবাদ নির্মূলে ব্রিটিশ সরকার এখন থেকে মুসলিম ব্রাদারহুড সহ যেকোনো উগ্র ধর্মীয় সংগঠনের সাথে নুন্যতম সংশ্লিস্ট ব্যক্তিদের ভিসা আবেদন নাকচ করবে। সকল চ্যারিটি সংগঠনের উপর কড়া নজরদারী আরোপ করবে। -বিভিন্ন দেশের সাথে এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে চ্যারিটির অর্থ ব্যায় সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ এবং মনিটর করবে। -ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে হামাসের সাথে সংযুক্ত সকল সংগঠনের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবে, জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে বিচারের ব্যবস্থা করবে।”

তথ্যসূত্র- অনলাইন পোর্টাল পূর্বপশ্চিম

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *