লালন উৎসবে লালনের নামেই তাঁর দর্শনের বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে

লালন উৎসবের মূল অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে লালনের নামেই তাঁর দর্শন তথা গানের বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে, অভিযোগ উৎসবে আগত লালন ঘরানার বাউল সহ বাউল ফকিরদের।

কুষ্টিয়ায় লালন ঘরানার যে সকল বাউল-ফকিরগণ বর্তমান আছেন তাঁদের অন্যতম হ’ল রব ফকির, টুনটুন ফকির, বজলু ফকির, আনু শাহ্ সহ আরও অনেকে। তাঁদের বক্তব্য হ’ল, “লালন দর্শন একটি গুরুমুখী বিদ্যা যা শুধুমাত্র লালন ঘরানার কোন গুরুর নিকট থেকেই আয়ত্ত করা সম্ভব। গুরুর গৃহে থাকে লালন ভাব-দর্শনময় এক বিশেষ পরিবেশ বা সংস্কৃতি (কালচার), যা দীর্ঘদিন অভিনিবেশ সহ অধ্যয়ন ও চর্চান্তেই শুধু আত্মস্থ করা সম্ভব। এ ভাব-দর্শন কোন একাডেমীতে পাওয়া সম্ভব নয়। আর এ কারণেই কোন একাডেমী থেকে শুদ্ধসুর শুদ্ধ ভাব-দর্শনময় লালনগীতি শেখা সম্ভব নয়, কারণ লালনের গানের সুর শুদ্ধ ভাব নির্ভর, যে ভাব একাডেমীতে নেই।”

সাম্যবাদি এ মানুষটির সারা জীবন কেটেছে মানুষ ও তার সমাজের উন্নতির কথা চিন্তা করে। মানুষের কূপ্রবৃত্তি ও কুপমন্ডুকতা দূর করে অধিকতর উন্নত সমাজ বিনির্মাণই হল তার দর্শনের মূল বক্তব্য যা তিনি গানের আকারে ব্যক্ত করেছেন। আর তাঁর গানের ধারারও আছে বিশেষ বিশেষত্ব। এ হ’ল গুরুমুখী বিদ্যা যা গুরু থেকে শিষ্য পরম্পরায় এর ভাব সহ অর্জন করতে হয়। আর সে ভাব শুধু গুরুর ঘরানায়ই মেলে, অন্য কোথাও নয়।

লালনের গান মূলত জীবনদর্শন সমাজদর্শন রাষ্ট্রদর্শন, যে কারণে তাঁর শিষ্য-ভক্তগণ তাঁর গানকে বলেন ‘কালাম’ বা জ্ঞান। সেই জাহেলীয়ার যুগে অর্থাৎ বৃটিস জাহেলদের দখলী ভূমিতে যখন সর্বত্র সন্ত্রাস বৃটিস প্রতিষ্ঠিত দুর্নীতি ক্ষুধা-মৃত্যু-হত্যাযজ্ঞ-অমানিশা অন্ধকার, তখন লালন ছিলেন আলোকবর্তিকাস্বরূপ। ভিতসন্ত্রস্ত মানুষের বুকে তিনি আশার আলো জ্বেলেছেন, লাঠি তুলেছেন আশিষ্য জমিদার-শাসকদের বিরুদ্ধে, সাহস যুগিয়েছেন বিদ্রোহের তাঁর গানের মাধ্যমে। তিনি তার গানে বিদ্রুপ করেছেন বৃটিস দখলদার জলদস্যুদের ‘বম্বেটে দস্যু’ বলে।

তাঁর গানে আছে বহুমাত্রিক তত্ত্বজ্ঞান। তিনি পাত্র বুঝে জ্ঞান দিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন ধর্মের সাধারণ সত্য সমন্বয়ে গান করেছেন সহজ ভাবে, যাতে নিরক্ষর মানুষও বুঝতে সক্ষম হয়। আবার জ্ঞান-বিদ্যায় অগ্রসর মানুষের জন্য ভিন্ন মাত্রার গানও করেছেন যেখানে দর্শন আরও উচ্চমার্গের।

কুষ্টিয়ার লালন ঘরানার বাউল টুনটুন ফকির বলেন, ‘সাঁইজী’ তাঁর জীবদ্দশায় ফাল্গুন মাসের দোল পূর্ণীমায় সাধুঁ-বাউলদের নিয়ে উৎসব করতেন। সেটাই মূলত লালন উৎসব, আর তাঁর মৃত্যুর পর পহেলা কার্তিক তাঁর জন্ম ও মৃত্যু দিবসে লালন স্মরণ উৎসব পালিত হয়। কিন্তু লালনকে নিয়ে এখন ব্যবসা চলছে। তাঁর মৃত্যু দিবসেও পাঁচ দিনের উৎসব পালিত হচ্ছে। আর এ উৎবের গানের মূল মঞ্চ থেকেই করা হচ্ছে তার গানের বিকৃতি।

গত ১ কার্তিক ছিলো বাউল দার্শনিক লালন সাঁই’র ১২৫তম মৃত্যু দিবস। এ উপলক্ষ্যে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় লালন’র আখড়াবাড়িকে কেন্দ্র করে শুরু হয় পাঁচ দিনের স্মরনোৎসব, যার আয়োজক ছেউড়িয়ার লালন একাডেমী। উৎসব উপলক্ষ্যে করা হয় মেলার আয়োজন যেখানে শতাধিক ষ্টলে নানা ধরনের পসরা নিয়ে চলে বেচাকেনা। মেলার মাঠে স্থাপন করা হয় উৎসবের গানের মূল মঞ্চ। মঞ্চে অনুষ্ঠিত গান সরাসরি টিভি সম্প্রচার করা হয়।

অনুষ্ঠানের প্রথম দিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লালন ঘরানার বাউল ভক্ত অনুরাগীগণ একা ও পরিবার-পরিজন নিয়ে ছেউড়িয়ায় লালনের আখড়াবাড়িতে এসে অবস্থান করেন। এ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসেন বিদেশী লালন ভক্ত অনুরাগি ও বাউলগণ। সন্ধ্যায় আখড়াবাড়িতে অবস্থানরত লালন ঘরানার বাউলদের অধিবাস সেবা (খাবার) দিয়ে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। এ সময় আখড়াবাড়িতে অবস্থানরত বাউলগণ গান করেন, লালনের দর্শন আলোচনা করেন। অন্যদিকে আখড়াবাড়ির বাইরে মাঠে লালন একাডেমী স্থাপিত মঞ্চে রাতভর চলে গান। রাত ১২টার পর আখড়াবাড়িতে অবস্থানরত বাউলগণকে আবার সেবা দেওয়া হয়। দ্বিতীয়দিন সকালে বাউলদের দেওয়া হয় বাল্যসেবা আর দুপুরে পুণ্যসেবা ও প্রণামী দিয়ে সাধুদের বিদায় জানানোর মাধ্যমে অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়।

উৎসবের শুরুতেই সমাগম ঘটে দূরদুরান্ত থেকে আগত হাজার হাজার ভক্ত-শ্রোতা-অনুরাগীদের। এ সময় উৎসব এলাকায় তিলধারনের ঠাই থাকে না। মানুষের এই ঢল রাত বাড়ার সাথে সাথে বাড়তেই থাকে, তখন মেলার মাঠ আখড়াবাড়ি সহ সমগ্র এলাকা পরিণত হয় এক মানুষের মিলন সমূদ্রে। তবে আগত মানুষের মধ্যে তিন ধরনের মানুষ থাকে। এদের মধ্যে প্রথম হ’ল সাধু-বাউল সহ বোদ্ধা শ্রেণীর মানুষ যারা লালন ঘরানার বাউলদের সুদ্ধ সুরের গান শুনতে ও গান গাইতে আসেন। দ্বিতীয় শ্রেণীর ভক্তরা হ’ল সাধারণ সহজ মানুষ যারা মূল বিষয়টি বুঝতে চায় আর ভালো গান চায়, এঁরা গানের বোদ্ধা ভক্ত। আর তৃতীয় এক শ্রেণীর মানুষ আসে যারা হ’ল হৈচৈ চিৎকার চেচামেচিকরা মাথামোটা খ্যামটা প্রিয় মানুষ, শুদ্ধ যা কিছু তাতেই তাদের অরুচী।

বাউলদের অভিযোগ, বর্তমানে লালনকে নিয়ে ব্যবসায় মেতে উঠেছে ছেউড়িয়ায় লালনের আখড়ার ‘নামে’ গড়েওঠা কমিটি, যার প্রধান একজন ‘সরকারি আমলা।’ আর তারা সচেতন ভাবে প্রকাশ্যেই লালনের দর্শন তথা গানের বিকৃতি ঘটাচ্ছে। তাদের বক্তব্য এভাবে তারা না-কি লালনকে জনপ্রিয় করে তুলছে!

লালন ঘরানার বাউল রব ফকির বলেন, এ সমাজে যারা লুটেরা, দুর্নীতিবাজ, সব ক্ষেত্রে দখলদার, যারা সত্যকে ভয় পায়, মানুষের জ্ঞানের বিস্তারকে ভয় পায় তারা লালন সাঁই’র দর্শনকে ভয় পায়। এরাই রাষ্ট্রের ছায়া, রাষ্ট্র ক্ষমতার পাশে পাশে থেকে এরা কাজ করে। এরা সত্যকে বিদ্রোহের মন্ত্র বলে মনেকরে, তাই সত্যকে বিকৃত করে, যাতে সাধারণ মানুষ সত্যটাকে চিনতে না পারে, ভুল শেখে। এদের জানা আছে অনেক ছলাকলা।

এরা লালনকে হত্যা করছে লালনের নামেই, আবার এর মাধ্যমেই তারা করছে বিস্তর ব্যবসা। লালনকে ধ্বংস করা হচ্ছে তাঁর শিক্ষাকে বিকৃত কলুশিত করে। তাঁর ‘নামের’ ভক্তিদাররা তাঁর কালাম’র (গানের) বিকৃতি গাইছে, যাতে আছে নষ্টামীর ঠমকও। সাঁইজীর দর্শনকে ওরা একদম বাজারের জিনিস বানিয়ে ছাড়ছে। তাঁর শিক্ষার বৌদ্ধিক বিকৃতি ঘটিয়েই তাকে হত্যা করা হচ্ছে। আর তার মহত্মকে হত্যা করার পরও তার নামেই চলছে জমজমাট ব্যবসা!

বাউলদের অভিযোগ, মূলধারার বাউলদের বাইরে যাদের দিয়ে গান গাওয়ানো হচ্ছে তাদের অধিকাংশেরই যোগ্যতাই নেই লালনের গান গাওয়ার। তারা বিকৃত সুরে অশ্লিল অঙ্গভঙ্গি করে যে গান করে তা এক পর্যায়ে লালন জারি, লালন খ্যামটা, লালন ব্যান্ড সঙ্গিতে পরিণত হচ্ছে, আর এ সবই করা হচ্ছে সচেতন ভাবে, যার পেছনে কাজ করছে বিশেষ কোন হীন স্বার্থ। লালন ঘরানার বাউল ফকিরগণ বলেন, বিগত বছরগুলি থেকে এ ধারাই চলছে, তাঁরা দেশের জ্ঞানী-গুনি মানুষকে এগিয়ে এসে এই নষ্টামী ও বিকৃতি প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়েছেন।

বাউল বজলু ফকির বলেন, লালন সাঁই ছিলেন সাম্যবাদি মানুষ। তিনি সাম্যবাদি সমাজের স্বপ্ন দেখতেন এবং বিশ্বাস করতেন একদিন মানুষ সাম্যবাদি সমাজ গড়বে যা তিনি তাঁর এই গানের মাধ্যমে স্পষ্ট ব্যক্ত করেছেন –
যে দিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে
এমন মানব সমাজ
কবে গো সৃজন হবে
ভোলায়ে লোভের বুলি
নেবে না কেউ কাধের ঝুলি
ইতর আতরাব বলি
দূরে ঠেলে নাহি দেবে
আমীর ফকির হয়ে এক ঠাই
সবার পাওনা পাবে সবাই
আশরাফ বলিয়া রে হায়
ভবে কেউ তো নাহি পাবে
ধর্ম কুল আর গোত্র জাতির
তোলবে না আর কেউ তো জিগির …….

এ গানেই তিনি পরিস্কার করেছেন তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সাম্যবাদি এবং সাম্যবাদি বিপ্লবের প্রত্যাসি ও বিশ্বাসি। ১৭৭৪ সালে পরাধীন সামন্ততান্ত্রিক বৃটিস ভারতে, বর্তমান বাংলদেশের কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় জন্ম নেওয়া (ভিন্নমত আছে) ক্ষণজন্মা লালন ছিলেন চিন্তা ও মননে তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক অনেক অগ্রসর মানুষ। তাঁর সারা জীবন কেটেছে মানুষ ও সমাজ ভাবনায়। সমাজের বিবর্তন ও বিকাশের এক পর্যায়ে সম্যবাদি সমাজ গড়ে উঠবে এটা তিনি বুঝেছিলেন। আর সে সমাজ এমনি এমনি গড়ে উঠবে না, মানুষের বৈপ্লবীক প্রচেষ্টায় সে সমাজ গড়ে উঠবে। তাইতো তিনি তাঁর গানে বলেছেন, এমন সমাজ কবে ‘সৃজন’ হবে, অর্থাৎ কবে সৃষ্টি করা হবে। এ গানে তিনি যে সমাজ চিত্র এঁকেছেন তা শুধু সমাজতান্ত্রিক সমাজ নয় একেবারে সমাজতন্ত্রের চূড়ান্ত ধাপ সাম্যবাদ’র ছবি।

বৃটিস গোয়েন্দাদের তৈরী ভারতবর্ষ তথা এ দেশের তথাকথিত বেমো-কমিউনিস্ট নয়, সঙ্গতিনিষ্ঠ কমিউনিস্ট বা মার্কসবাদের সিরিয়াস পাঠকমাত্র জানেন কার্ল মার্কস বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের যে তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন সেখানে সমাজতান্ত্রিক সমাজ এবং সমাজতন্ত্রের চূড়ান্ত পর্ব সাম্যবাদি সমাজের রূপরেখা অংকণ করেছেন। তাতে তিনি সমাজতন্ত্র এবং সাম্যবাদি সমাজ কেমন হবে তা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন, এবং কেন সেরূপ হবে তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। কার্ল মার্কস’র তত্ত্বানুযায়ী পুঁজিবাদের চূড়ান্ত বিকাশের পর কোন রাষ্ট্রে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরী হবে, আর সমাজতন্ত্রের বিকাশের পর তৈরী হবে সাম্যবাদ।

তিনি দেখিয়েছেন ‘সাম্যবাদি সমাজে কোন বিশেষ জাতি, কোন ধর্ম, গোত্র থাকবে না, সমাজে কেউ উচু-নীচু (আশরাফ-আতরাব) থাকবে না, আমীর-ফকির সব একত্র হবে এবং সবাই সবার পাওনা পাবে, আর তখন ধর্ম-কুল-গোত্র-জাতির জিগির তুলে বিশেষ ফায়দা লোটার কেউ থাকবে না।’ কেন থাকবে না মার্কস তা সবিস্তারে ব্যখ্যাও করেছেন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সাহায্যে।

কিন্তু মহামতি দার্শনিক লালন ফকির কার্ল মার্কস’র ৪৬ বছর আগে পরাধীন অনগ্রসর এক ভূখন্ডে জন্ম নিয়েও সমাজ বিবর্তনের ধারাটিকে সঠিক ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, এবং সমাজের চূড়ান্ত বিবর্তন সাম্যবাদি সমাজের জন্য প্রাণের আকুতি প্রকাশ করেছিলেন ও নিজেকে একজন সাম্যবাদি মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়ে ছিলেন। আর তাইতো তিনি কোন জাত-পাত মানেননি, মানেননি কোন বিশেষ ধর্মও, কারণ একজন সাম্যবাদির বিশেষ কোন জাত, কোন ধর্ম থাকতে পারে না, লালনেরও ওসব কিছু ছিলো না। তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানাও মানেননি, সাম্যবাদি ধারায় শিষ্যদের নিয়ে ‘কমিউন’ বা যৌথ জীবন জাপন করেছেন।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *