ঘুষ-দুর্নীতি বেড়েছে কয়েক গুণ, এক বছরেও মেলেনি এমপিও কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণের সুফল

ঘুষ-দুর্নীতি ও হয়রানি রোধ করার লক্ষ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের হাতে থাকা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার (এমপিও) বা বেতন-ভাতা বাবদ মাসিক সরকারি অনুদানসংক্রান্ত কার্যক্রম ৯টি আঞ্চলিক শিক্ষা কার্যালয়ে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল এক বছর আগে। কিন্তু এক বছরে এই লক্ষ্য পূরণ না হয়ে অনিয়ম, ঘুষ-দুর্নীতি ও হয়রানি বেড়েছে কয়েক গুণ।

এমপিও কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতিরও বিকেন্দ্রীকরণ হয়ে গেছে। বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন আঞ্চলিক শিক্ষা কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। যোগ্যতা থাকলেও ঘুষ ছাড়া কোনো শিক্ষকের পক্ষেই এমপিও পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে ঘুষ দিয়ে যোগ্যতার ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও এমপিও মিলছে অনায়াসে। একজন শিক্ষককে এমপিও পেতে ঘুষ দিতে হচ্ছে ৩৮ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। আর যোগ্যতা বা কাগজপত্রে কোনো ঘাটতি থাকলে ঘুষের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে কয়েক গুণ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি অধিদপ্তর ও ভুক্তভোগী শিক্ষকদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ভুক্তভোগী শিক্ষকরা বলেছেন, ঘাটে ঘাটে ঘুষ না দিলে এমপিও পাওয়া যায় না। উপজেলা, জেলা ও আঞ্চলিক কার্যালয় এই তিন জায়গায় ঘুষ দিলে তবেই এমপিও পাওয়া যায়। প্রথমে ঘুষ দিতে হয় স্কুল থেকে নথিপত্র তৈরির জন্য নিম্নমান সহকারীকে (কেরানি)। এরপর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে ঘুষ দিতে হয়। টাকা দিলেই অনলাইন ফাইলে সঠিক মন্তব্য করা হয়, না হলে নানা কারণ দেখিয়ে তা বাতিল করা হয়। নতুন এমপিওর ক্ষেত্রে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে পদ সৃষ্টি করতে ঘুষ দিতে হয় তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা। এরপর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস থেকে অনলাইনে ভালো মন্তব্য পেতে ঘুষ দিতে হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে প্যাকেজ হিসেবে দিলে প্রতিটি এমপিওর জন্য শিক্ষকদের দিতে হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। আর আলাদাভাবে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপপরিচালককে দিলে এই টাকার পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে প্রতি শিক্ষকের এমপিওতে মোট ঘুষ দিতে হয় ৩৮ থেকে ৫০ হাজার টাকা। তবে জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা প্যাকেজের বাইরে আলাদাভাবে কোনো এমপিও করাতে গেলে ঘুষের ভাগ দিতে হয় সংশ্লিষ্ট উপপরিচালককেও।

দেশে এখন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ২৮ হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী। মাউশি অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০ জন শিক্ষক-কর্মচারী অবসরে যান। এর বিপরীতেই নতুন শিক্ষকদের এমপিও দেওয়া হয় দুই মাস পরপর। প্রতি দুই মাসে সারা দেশে প্রায় আড়াই হাজার নতুন শিক্ষক এমপিওভুক্ত হন। প্রতি দুই মাস অন্তর এক থেকে দেড় হাজার শিক্ষক উচ্চতর গ্রেডসহ নানা সুবিধা পান। এমপিও বিকেন্দ্রীকরণের ফলে সব কাজই এখন হয় আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে। অভিযোগ রয়েছে, এমপিও দেওয়ার আগ মুহূর্তে প্রতিটি আঞ্চলিক কার্যালয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়। ফলে দুই মাসে শুধু শিক্ষক এমপিওভুক্তি ও উচ্চতর গ্রেড দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রায় ১৩ কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়। এ ব্যাপারে মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এস এম ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, শিক্ষকদের বলব, তাঁরা ঘুষ দেন কেন? যদি কোনো কাগজে সমস্যা থাকে তাহলে তাঁরা সেটা ঠিক করে দিক। তবে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী যদি অন্যায়ভাবে, অনৈতিকভাবে কারো কাছ থেকে ঘুষ নেন তাহলে অবশ্যই আমরা তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। এরইমধ্যে এসব ব্যাপারে তদন্তও চলছে। আর কোনো শিক্ষক যদি একবার এমপিও মিস করেন তাহলে তিনি দুই মাসের প্রাপ্য বেতন থেকে বঞ্চিত হন, এটাও কর্মকর্তাদের মনে রাখতে হবে। তিনি বলেন, আসলে সমস্যা অন্য জায়গায়। দেখা যায়, সার্টিফিকেটে সমস্যা আছে বা অন্য সমস্যা আছে; সেগুলোই টাকা দিয়ে রফাদফা হয়। তবে অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।

সূত্র মতে, শিক্ষকরা আঞ্চলিক শিক্ষা কার্যালয়ের উপপরিচালক এবং জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার প্রমাণসহ প্রায়ই অভিযোগ জমা দিচ্ছেন মাউশি অধিদপ্তরে। আঞ্চলিক শিক্ষা কার্যালয়ের ৯ জন উপপরিচালকের মধ্যে চারজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তাধীন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক) চৌধুরী মুফাদ আহমেদ বলেন, আমরাও শিক্ষক এমপিওতে দুর্নীতির বিষয়ে প্রচুর অভিযোগ পাচ্ছি। আসলে বিকেন্দ্রীকরণের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতিও ছড়িয়ে পড়েছে। এর অর্থ এই নয় যে কেন্দ্রে দুর্নীতি ছিল না। তবে আমরা ঘুষ গ্রহণের জেনুইন ক্লু চাই। যাতে আমরা ধরতে পারি। তবে অনেক ক্ষেত্রেই যাঁরা ঘুষ দেন তাঁরা প্রকাশ্যে আসতে চান না, যা একটি বড় সমস্যা। এর পরও আমরা অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করি। সূত্র জানায়, গত বছরের অক্টোবর থেকে ৯টি আঞ্চলিক কার্যালয়ে সব এমপিও কার্যক্রম চলছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি চিঠিতে এমপিও বিকেন্দ্রীকরণের জন্য নির্দেশ দিলেও প্রথমে পাইলট প্রকল্প হিসেবে এবং ২০১৮ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে এমপিও বিকেন্দ্রীকরণের নির্দেশ ছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ না মেনে একযোগে সব আঞ্চলিক কার্যালয়েই এমপিও কার্যক্রম চালু করা হয়। কিন্তু আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে দক্ষ লোকবল না থাকায় শিক্ষকরা নানা কাজে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, আঞ্চলিক কার্যালয়ে সম্প্রতি পরিচালকের একটি পদ সৃষ্টি করে পদায়ন করা হলেও এমপিওর সব দায়িত্বই রেখে দেওয়া হয়েছে উপপরিচালকদের হাতে। ফলে এসব উপপরিচালক বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। এমনকি এখন শিক্ষা প্রশাসনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পদ হয়ে দাঁড়িয়েছে আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপপরিচালকের পদগুলো। ২০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েও এসব পদে যেতে আগ্রহী অনেক কর্মকর্তা।

 

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ ,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *