জালানি তেলে মেশানো হচ্ছে উচ্চমাত্রার সিসাযুক্ত কনডেনসেট

জালানি তেল কেরোসিন, ডিজেল, পেট্রল ও অকটেনে উচ্চমাত্রার সিসাযুক্ত কনডেনসেট (অপরিশোধিত তেল) মেশিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। জালানি তেলে এই ভেজাল মেশানোর ফলে তেলচালিত যানবাহনের ইঞ্জিনসহ মূল্যবান যন্ত্রপাতির ব্যাপক ক্ষতি ছাড়াও পরিবেশের ভয়াবহ দূষণ ঘটছে। এ দিকে উচ্চমাত্রার সিসাযুক্ত কনডেনসেটের অবৈধ ব্যবসা করে একটি প্রভাবশালী চক্র মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

জালানি তেলে ভেজাল দেওয়ার ক্ষেত্রে এই কৌশল অবলম্বন করছেন মূলত পেট্রল পাম্প মালিকরা। তারাই পেট্রল ও অকটেনের সঙ্গে কনডেনসেট মিশিয়ে বিক্রি করছেন। অভিযোগ উঠেছে, এই ভেজাল তৈরিতে পেট্রল পাম্প মালিকদের সহায়তা করছে বেসরকারি রিফাইনারিগুলো। সম্প্রতি কয়েকটি বেসরকারি রিফাইনারির কনডেনসেট উত্তোলন এবং পরিশোধিত জালানি বিক্রির পরিসংখ্যান থেকে এই ভয়াবহ চিত্র পেয়েছেন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অফিসাররা।

এদিকে অন্যত্র কনডেনসেট বিক্রির অপরাধে এরই মধ্যে তিনটি বেসরকারি রিফাইনারিতে কনডেনসেট সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে পেট্রোবাংলা। রিফাইনারিগুলো হলো চিটাগাং ভেজিটেবল অয়েল (সিভিও) রিফাইনারি, গোল্ডেন কনডেনসেট অয়েল রিফাইনারি ও লার্ক পেট্রোলিয়াম কম্পানি লিমিটেড। এ ছাড়া ভেজাল জালানি বিক্রির অভিযোগে বিভিন্ন জেলার ১৪টি ফিলিং স্টেশন (পেট্রল পাম্প), ২২৪ এজেন্ট ও ৩৫৮ প্যাক্ড পয়েন্ট ডিলারের লাইসেন্স বাতিল করেছে বিপিসি কর্তৃপক্ষ। বাতিল করার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে ২০৫ এজেন্ট ও ১৫৫ প্যাক্ড পয়েন্ট ডিলারের লাইসেন্স। বিপিসির কয়েকজন অফিসার জানান, যেসব এজেন্ট ও প্যাকড পয়েন্ট ডিলারের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে তারা বিপিসির নিয়ন্ত্রণাধীন বিপণন কম্পানিগুলো (পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল) থেকে জালানি তেল উত্তোলন না করে অন্য উৎস থেকে জালানি সংগ্রহ করে বিক্রয় কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছিল। তাদের মধ্যে যমুনা অয়েলের এজেন্ট সবচেয়ে বেশি।

সূত্র জানায়, গ্যাসফিল্ড থেকে গ্যাস উত্তোলনের সময় গ্যাসের সাথে উচ্চমাত্রার সিসাযুক্ত কনডেনসেট (গ্যাসের সহজাত ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত তেল) বেরিয়ে আসে। রিগ মেশিনে গ্যাস ও কনডেনসেট আলাদা হয়ে যায়। পরে উত্তোলিত কনডেনসেট রিফাইনারিতে রিফাইনের জন্য পাঠানো হয়। পরে গ্যাসের এই উপজাত পরিশোধন করে অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিন প্রভৃতি পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন করা হয়। গ্যাসফিল্ডগুলোতে উত্তোলিত কনডেনসেটের সঠিক হিসাব নেই। এ সুযোগে গ্যাসফিল্ডের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা গোপনে উচ্চমাত্রার সিসাযুক্ত কনডেনসেট জালানি তেল ভেজালকারীদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। জানা গেছে, অকটেন, পেট্রল, ডিজেল ও কেরোসিনে কনডেনসেট মেশানোর উদ্দেশ্য বেশি মুনাফা করা। কনডেনসেট থেকে পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদনের জন্য রয়েছে সরকারি এশটি প্রতিষ্ঠান- রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিজিএল)। এর বাইরে সরকার পাঁচটি বেসরকারি কোম্পানিকে কনডেনসেট রূপান্তরের দায়িত্ব দিয়েছে। এসব বেসরকারি কোম্পানি কনডেনসেট থেকে অকটেন, পেট্রল, ডিজেল, কেরোসিনসহ বিভিন্ন পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন করে। অকটেন, পেট্রল, ডিজেল ও কেরোসিন খোলাবাজারে বিক্রির কোনো বিধান নেই। বেসরকারি রিফাইনারি কোম্পানিগুলো পরিশোধিত জ¦ালানি তেল বিপিসির পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা এই তিনটি কোম্পানির কাছে বিক্রি করবে।

জানা গেছে, বেসরকারি রিফাইনারি কোম্পানিগুলো গ্যাসফিল্ড থেকে প্রাপ্ত কনডেনসেট রিফাইন করে পেট্রল ও অকটেন তৈরি করে সেগুলো আবার বিপিসির কাছে বিক্রি করে থাকে। তবে অভিযোগ রয়েছে, অনেক রিফাইনারি কোম্পানি কনডেনসেট রিফাইন না করে বেশি লাভের আশায় সরাসরি পেট্রল পাম্প মালিকদের কাছে তা বিক্রি করে দেয়। আর পেট্রল পাম্পগুলো ডিজেল, অকটেন ও পেট্রলের সঙ্গে সরাসরি কনডেনসেট মেশানোর কারণে নষ্ট হচ্ছে গাড়ির ইঞ্জিন। বিভিন্ন পেট্রল পাম্পে ভেজাল তেল সরবরাহ করা হচ্ছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে বিএসটিআই ও বিপিসি সম্প্রতি বিভিন্ন পেট্রল পাম্পে অভিযান চালিয়ে ভেজাল তেল বিক্রির প্রমাণ পেয়েছে। ১৯৯৭ সালে প্রথম সরকার বেসরকারি রিফাইনারিগুলোতে গ্যাসক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত গ্যাসের উপজাত হিসেবে উৎপাদিত কনডেনসেট বিক্রি শুরু করে। বেসরকারি রিফাইনারিগুলোর প্রক্রিয়া শেষে তাদের কাছ থেকে পেট্রল ও অকটেন কিনে বাজারে বিক্রি করে বিপিসি। বর্তমানে দেশে তিনটি সরকারি ও ১২টি বেসরকারি তেল রিফাইনারি কোম্পানি রয়েছে। তারা পেট্রোবাংলার কাছ থেকে কনডেনসেট কিনে। কনডেনসেট থেকে পেট্রল, অকটেন ও অন্যান্য জালানি তেল উৎপাদন করে বিপিসির কাছে বিক্রি করে। জ¦ালানি তেলে এই ভেজাল রোধ করা প্রসঙ্গে জালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, পেট্রল পাম্পে ভেজাল দেওয়া বন্ধের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে, যখন হিসাব রাখা হবে; কোন রিফাইনারি কোম্পানি প্রতিবছর কী পরিমাণ কনডেনসেট সংগ্রহ করেছে এবং কী পরিমাণ পরিশোধিত তেল বিপিসির কাছে বিক্রি করেছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, এখনো পেট্রোবাংলা এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে অধিকাংশ রিফাইনারি কোম্পানি পেট্রোবাংলার কাছ থেকে কনডেনসেট সংগ্রহ করে সেটা বেশি লাভের আশায় পেট্রল পাম্প মালিকদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। বিপিসি সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি রিফাইনারি কোম্পানিগুলো মোট চাহিদার দুই-তৃতীয়াংশ পেট্রল ও অকটেন সরবরাহ করে থাকে। দেশে প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ টন পেট্রল ও অকটেনের চাহিদা রয়েছে।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *