ড.ওয়াজেদ’র ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী, নয়াদিল্লীতে তাঁর সান্নিধ্যে ঘটনাবহুল কিছু স্মৃতি

ড: ওয়াজেদ মিয়া

ড: ওয়াজেদ মিয়া

বঙ্গবন্ধুর জামাতা বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল নয়দিল্লীতে ১৯৭৭ সালে। সে সময় ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে নয়াদিল্লীতে অবস্থানকালে জাতির পিতার  কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও ড. ওয়াজেদ মিয়ার সান্নিধ্যে কয়েকবারই থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। ওই সময়ের অনেক স্মৃতি ও অনেক ঘটনার কথা এখন মনে পড়ছে। বরেণ্য এই বিজ্ঞানীর সান্নিধ্যে থেকে তাঁর কর্মময় জীবনের অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি তখন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বরণের পর রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়া বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা তখন নয়াদিল্লীর পান্ড্রা রোডের একটি সরকারি আবাসিক এলাকার ৪ তালা ভবনের দোতালায় সপরিবারে থাকতেন। জয় ও পুতুল ছিলেন তখন খুব ছোট । ড. ওয়াজেদ থাকতেন বিজ্ঞান গবেষণায় ব্যস্ত। প্রথমবার নয়াদিল্লী যাওয়ার পর থেকে ওই বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল।

 ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনাকে যখন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত করা হয় তখন আমি নয়াদিল্লীতে অবস্থান করছিলাম। সেদিন রাতে নয়াদিল্লীর জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আমার বোন-ভগ্নিপতির ঘরে বসে টেলিভিশন দেখছিলাম। খবরে জানতে পারলাম যে, শেখ হাসিনাকে সর্বসম্মতক্রমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত করা হয়েছে। খবরটি শুনে খুবই উত্তেজনা অনুভব করলাম। ওইদিনই শেখ হাসিনার বাসা থেকে ঘুরে এসেছি। কিন্তু তখন এ সম্পর্কে কিছুই জানতে পারিনি। তাই, এই শুভ সংবাদটি পেয়ে উত্তেজনায় সারারাত ঘুমুতে পারিনি-‘কখন সকাল হবে আর আমি ফুলের তোড়া নিয়ে হাসিনা আপার সাথে দেখা করবো।’ রাত শেষ হলেই অপেক্ষার অবসান হলো। নিদারুণ কৌতুহল ও উত্তেজনা নিয়ে সেদিন ভোরে বসন্ত বিহার বাস স্ট্যান্ড থেকে প্রথম বাসেই পান্ড্রা রোডের আবাসিক এলাকার দিকে রওনা হলাম এবং প্রশান্ত মনে ওই বাড়িতে প্রবেশ করলাম। বাড়িতে গিয়ে দেখি হাসিনা আপা কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছেন। পরে আমাকে জানালেন ঢাকা থেকে আওয়ামীলীগ নেতা শেখ আব্দুল আজিজ ফোন করেছিলেন। আওয়ামী লীগের নতুন কমিটির প্রেসিডিয়ামে স্থান না পাওয়ায় তিনি খুব ভেঙ্গে পড়েছেন। তাই, ভারাক্রান্ত মন নিয়ে তিনি আপাকে ফোন করেছিলেন।

 ওই দিন ভারতীয় ও বিদেশী সাংবাদিকরা একে একে শেখ হাসিনার পান্ড্রা রোডের ওই বাড়িতে আসতে শুরু করলো। শেখ হাসিনা প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের সাথে প্রথমবারের মতো কথা বলতে শুরু করলেন এবং সাক্ষাৎকার দিতে লাগলেন। ওই সময় ড. ওয়াজেদের সাথে থেকে আমাকেও বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হয়েছিল। নয়াদিল্লীতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ায় ভারতের বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রে এ খবর বেশ ফলাও করে প্রচার ও প্রকাশ করা হচ্ছিল। সংবাদপত্রগুলোতে শেখ হাসিনাকে নিয়ে প্রকাশ করা হয়েছিল বিশেষ প্রতিবেদন। ওই দিন সকালে ড. ওয়াজেদ মিয়া আমাকে তাঁর পড়ার ঘরে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘শোন মিন্টু তোমার আপা আওয়ামীলীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ায় ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় অনেক সংবাদ ও প্রতিবেদন ছাপা হবে। এগুলো সংরক্ষণ করে রাখবে। তুমি প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত এসব সংবাদ কাটিং করে আমার কাছে দেবে। আমি এগুলো রেখে দেবো।’ এরপর ওই বাড়িতে প্রতিদিন আমার প্রথম কাজ ছিল ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত আওয়ামীলীগ ও শেখ হাসিনা সংক্রান্ত সংবাদ, প্রতিবেদন ইত্যাদি কাটিং করে ড. ওয়াজেদের কাছে জমা দেয়া। যতদিন এইসব সংবাদ ছাপা হয়েছিল ততদিন আমি আমার এই দায়িত্ব পালন করেছিলাম। জানি না ড. ওয়াজেদ পত্রিকার কাটিংগুলো সংরক্ষণ করে পরে কী করেছিলেন।

 আমার ভগ্নিপতি প্রয়াত প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ (চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য) ‘পিএইচডি’ করার জন্য ১৯৭৬ সালে নয়াদিল্লী যান এবং জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিনি তাঁর কার্যক্রম শুরু করেন।  একই সাথে আমার বোন বেগম রওশন আরাও ‘এমফিল’ করার জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ শুরু করেন। তারা সেখানে যাওয়ার পর প্রতিবছরই আমি নয়াদিল্লী গিয়েছি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের আবাসিক এলাকায় তাঁদের বাড়িতে  থেকে নয়াদিল্লীসহ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছি। নয়াদিল্লী যেয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও ড. ওয়াজেদের সাথে পরিচিত হয়েছি এবং তাদের সাথে পারিবারিকভাবে মিশেছি । আমি সৌভাগ্যবান যে শেখ হাসিনা আওয়ামীলীগের সভানেত্রী হওয়ার সময় আমি ঘটনাচক্রে নয়াদিল্লীতেই ছিলাম। তাই, সে সময় অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। নয়াদিল্লীতে শেখ হাসিনা ও ড. ওয়াজেদ, জয় ও পুতুলের সান্নিধ্য পেয়েছি।

 শেখ হাসিনার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর জামাতা ড. ওয়াজেদ মিয়ার সংস্পর্শে আসা আমার জীবনের এক বিরল ঘটনা। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি বাঙ্গালি ও প্রতিভাবান বিজ্ঞানী এবং যথার্থই একজন বিজ্ঞান গবেষক। প্রথম পরিচয়ে ঝাঁকড়া পক্ককেশী ড. ওয়াজেদকে সত্যিকার অর্থে একজন বিজ্ঞান গবেষক মনে হয়েছিল এবং তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। সম্পর্ক গভীর হওয়ার পর আমি তাঁর কাছে বেশি যেতাম এবং তিনি আমাকে অনেক ভালো ভালো কথা বলতেন। অনেক উপদেশ ও পরামর্শ দিতেন। তন্ময় হয়ে আমি তাঁর জ্ঞানগর্ভ কথা শুনতাম এবং তার কথায় মুগ্ধ হতাম। দেখতাম তিনি একাকী নিভৃতে পড়ার ঘরে গবেষণার কাজ করে যাচ্ছেন। বেশিরভাগ সময় তিনি পড়ার ঘরে পায়চারি করতেন। চিন্তা করতেন তাঁর গবেষণা নিয়ে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধে নিরহংকার ও স্পষ্টবাদী মানুষ। প্রায়ই সময় দেখতাম তাঁকে লেখালেখি করতে ও গবেষণায় ব্যস্ত থাকতে। ভারতে তাঁর গবেষণালদ্ধ অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। একদিন তিনি আমাকে দুটি বই দেখিয়ে বললেন যে, এই বই দুটি নয়াদিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হচ্ছে। শ্রীলংকা, ফিলিপাইন, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে দারুণভাবে সামাদৃত হয়েছে তাঁর লেখা বই। ভারতে তিনি একজন স্বনামধন্য বিজ্ঞান গবেষক হিসেবে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

 শেখ হাসিনা আওয়ামীলীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর নয়াদিল্লীতে একদিন আমি তাঁকে বলেছিলাম, ‘দুলাভাই আপনিতো ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের সহ-সভাপতিও ছিলেন আপনি। স্বাধীনতার আগে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১দফা ও আওয়ামীলীগের ৬দফা আন্দোলনে আপনার গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার পর আপনি কী ভূমিকা রাখবেন।’ তিনি বললেন, হাসু (শেখ হাসিনা) রাজনীতি করুক। নেপথ্যে থেকে আমি তাকে সহযোগিতা করবো। শক্তি ও সাহস যোগাবো।’ জীবনে সজ্ঞান অবস্থায় শেষে দিনটি পর্যন্ত তিনি তাই করেছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের  জামাতা। এজন্য আমি গর্ববোধ করি। কিন্তু আমি নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে চাই।’ দেশ জাতি ও সমাজ নিয়ে তিনি ভাবতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে থেকে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। নয়াদিল্লীতে তাঁকে বাসে যাতায়াত করতে দেখেছি। তিনি প্রায়ই নয়াদিল্লীর বিজ্ঞান গবেষণাগারে যেতেন। কয়েকবার আমাকেও তিনি সাথে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে গেছেন।

 শেখ হাসিনা আওয়ামীলীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর ড. ওয়াজেদ শেখ হাসিনার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে। তিনি যাবেন কি-না, কবে যাবেন, তাঁর যাওয়া ঠিক হবে কি-না, তা নিয়ে নয়াদিল্লীর ওই বাড়িতে তখন ব্যাপক আলাপ-আলোচনা চলছিল। শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ড. ওয়াজেদ, কাদের সিদ্দিকী, আমার ভগ্নিপতি আবু ইউসুফের মধ্যে এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল দফায় দফায়। আমিও সে সময় উপস্থিত ছিলাম। শেখ হাসিনার বাংলাদেশে যাওয়া নিয়ে ড. ওয়াজেদ কিছুটা দ্বিধা-দন্দ্ব ও সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে ছিলেন। সে সময় দেখেছিলাম শেখ হাসিনার দৃঢ়তা। তিনি বলেছিলেন, ‘এখন আমার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করলে চলবে না। দেশ ও দলের স্বার্থে আমাকে দেশে ফিরে যেতে হবে।  আব্বার হাতে গড়া ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামীলীগকে সুসংগঠিত করে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে দেশ পরিচালনায় অংশ নিতে হবে।’

 ওই সময় বাংলাদেশ থেকে আওয়ামীলীগের নেতারা নয়াদিল্লীতে শেখ হাসিনার বাড়িতে আসতে শুরু করেন। আওয়ামীলীগ প্রেসিডিয়ামের প্রথম সভা ওই বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। ড. ওয়াজেদ মিয়া এ সময় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। আওয়ামীলীগ নেতা জিল্লুর রহমান, তোফায়েল আহমেদ, সাজেদা চৌধুরীসহ অন্য নেতাদের সাথে তাঁর ভাল সম্পর্ক ছিল। ওই সময় আব্দুল মালেক উকিল, আব্দুল মান্নান, আমির হোসেন আমু, সালাহ উদ্দিন ইউসুফ, শেখ সেলিমসহ আওয়ামীলীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মী নয়াদিল্লীতে এসেছিলেন। শেখ হাসিনার চাচী ( শেখ হেলালের মা বেগম রিজিয়া নাসের) ছোট ছেলে নিয়ে এবং শেখ রেহানাও সেখানে এসেছিলেন। মনে পড়ে, শেখ হাসিনা আওয়ামীলীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ায় পর ড. ওয়াজেদের  ইচ্ছে অনুযায়ী ফকির, মিসকিন ও দুস্থদের খাওয়ানো এবং মাজারে শিরনি দেয়ার জন্য শেখ হাসিনার চাচী, কাদের সিদ্দিকিসহ অন্যদের সাথে আমিও নয়াদিল্লীর নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মাজারে গিয়েছিলাম। সেখানে মিলাদ মাহফিলে শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবার, বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিবসহ ১৫ আগষ্টের সকল শহীদ এবং বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের জন্য বিশেষ মোনাজাত ও দোয়া করা হয়েছিল।

 সে সময়আমি ড. ওয়াজেদের সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার সাক্ষাৎকার নেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। এখন হাসুর (শেখ হাসিনা) সাক্ষাৎকার বেশি প্রয়োজন। তুমি এটাই আগে করো।’ আমি তখন বাংলাদেশের বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক খবর পত্রিকার খুলনা ব্যুরো প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। বাংলাদেশ ত্যাগ করার আগে খবর সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান আমাকে বলেছিলেন, নয়াদিল্লী থেকে আমি যেন সুযোগ মতো শেখ হাসিনা ও কাদের সিদ্দিকীর সাক্ষাৎকার নিয়ে পত্রিকায় পাঠিয়ে দেই। নয়াদিল্লীতে আসার পর শেখ হাসিনাকে আমার এই ইচ্ছার কথা জানালে তিনি সে সময় সম্মত হননি। তবে, কাদের সিদ্দিকীর সাক্ষাৎকার আমি আগেই নিয়েছিলাম। কিন্তু শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ায় তাঁর সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ এসে যায়। তিনি রাজি হন এবং আমি তার সদ্ব্যবহার করি।

 নয়াদিল্লী থেকে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার সর্বপ্রথম বাংলাদেশের সাপ্তাহিক খবরে প্রকাশিত হয়। প্রথম পৃষ্ঠার ৮ কলামে ‘আমি সবই হারিয়েছি। আমার আর হারাবার কিছুই নেই’-এই প্রধান শিরোনামে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল। সাপ্তাহিক খবরে প্রকাশিত এই বিশাল সাক্ষাৎকার দেখে ড. ওয়াজেদ খুব খুশি হয়েছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, ‘সাক্ষাৎকারটি ভালোভাবেই সাজিয়েছ তুমি। ভালই ট্রিটমেন্ট দিয়েছে মিজান সাহেব।’ বলেছিলেন, ‘দোয়া করি ভবিষ্যতে তুমি ভাল সাংবাদিক হও।’ ১৯৮১ সালে ওই বছর এক মাসের ভিসা নিয়ে আমি নয়াদিল্লী গিয়েছিলাম। কিন্তু শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার কারণে আমার নয়াদিল্লীতে অধিক দিন অবস্থানের জন্য ভিসার মেয়াদ এক মাস বাড়াতে হয়েছিল। ওই সময় প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জত্তহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে প্রতিদিন সকালে শেখ হাসিনার পান্ড্রা রোডের বাড়িতে আসতাম এবং সারাদিন থেকে রাতে ফিরে যেতাম।

 শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে ১০ই মে বাংলাদেশে ফিরে এলেও ড. ওয়াজেদ নয়াদিল্লীতে থেকে যান। গবেষণা ও বই লেখার কাজে তিনি আরও কিছুদিন সেখানে ছিলেন। দেশে আসার আগে তাঁর যে সান্নিধ্য পেয়েছিলাম- দেশে ফেরার পর সেই সুযোগ আর হয়নি। দেশে ফিরে আসার পর পরমাণু শক্তি কমিশনে যেয়ে তাঁর সাথে কয়েকবারই দেখা করছি।  তিনি সে সময় আওয়ামীলীগের কর্মকান্ড ও দেশ নিয়ে অনেক কথাই বলতেন। তার কথার মধ্যে ফুটে উঠতো দেশপ্রেম ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। ক্ষমতার কাছাকাছি থেকেও তিনি কোন সুযোগ নেননি। নির্লোভ, নিবেদিত প্রাণ, সৎ, নিষ্ঠাবান অমায়িক, স্পষ্টবাদী ড. ওয়াজেদ ছিলেন একজন খাঁটি বাঙ্গালি।

 তাঁর জন্মস্থান রংপুরের পীরগাছা উপজেলার মানুষের কাছে  তিনি ছিলেন অতি আদরের মেধাবী সদাচঞ্চল, উচ্ছ্বল এক তরুণ ‘সুধা মিয়া’। এই নামের সাথে তার জীবনাচারের অদ্ভুত মিল ছিল। জানা যায়, ছোটবেলায় সুধা মিয়া তরকারি ছাড়া সাদা ভাত খেতে ভালবাসতেন। এজন্য তাঁর ডাক নাম রাখা হয়েছিল সুধা মিয়া। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি সাদাসিধা জীবন- যাপন করে গেছেন। তাঁর জীবনে কোনো ভোগ বা বিলাসিতার ওপর কোন মোহ ছিল না। তাঁর ছিল নিজ হাতে কষ্ট করে গড়া এক সংগ্রামী জীবন। আত্মসম্মানবোধে তিনি ছিলেন আপসহীন এক ব্যক্তিত্ব। এক কথায় তিনি ছিলেন বহুগুণের অধিকারী নিভৃতচারী ও প্রচারবিমুখ এক অসাধারণ ব্যক্তি।

 ভারত থেকে দেশে ফিরে বহু ঝামেলা শেষে ওয়াজেদ মিয়া পরমাণু শক্তি কমিশনে যোগদান করেন। তাঁর পুরনো কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার পর কমিশনের সর্বাঙ্গীন উন্নতির জন্য তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। পরিশেষে চেয়ারম্যান পদ অলংকৃত করেন। তাঁর জীবনের এক বড় চাওয়া ছিল রূপপুর পরমাণু কেন্দ্রটিকে শান্তিপূর্ণ কাজে চালু করা। অসুস্থ অবস্থায়ও এই বিষয়ে খোঁজখবর রাখতেন এবং সাহায্য করার চেষ্টাও অব্যাহত রেখেছিলেন। এটি চালু হলে তাঁর দীর্ঘদিনের আশা সার্থক হবে।

 কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে তাঁর স্মৃতির ওপর একটি বই এবং চলমান রাজনীতির ওপর তিনখনা গ্রন্থ রচনা করেন। এ ছাড়া ভারতে অবস্থানকালে তাঁর নিজস্ব বিষয় অর্থাৎ পদার্থ বিজ্ঞানে কয়েকটি জটিল বিষয়ের ওপর মোট চারখানা গ্রন্থ রচনা করেন। বইগুলো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে রেফারেন্স বই হিসেবে ব্যবহৃত হয়।১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু পরিবারের নির্মম হত্যাকান্ডের সময় দেশে না থাকায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান। তাঁরা তখন ড. ওয়াজেদের সাথে জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ড. ওয়াজেদ ও তাঁর পরিবার শেখ রেহানাকে নিয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। সেখানে ড. ওয়াজেদকে ভারত সরকার তাঁদের আশ্রয়ের সাথে ভরণপোষণের জন্য ভাতা দেয়ার প্রস্তাব করে। কিন্তু একজন সচেতন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে ভাতা নেয়ার প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখান করে ড. ওয়াজেদ চাকরি করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। পরে তিনি ভারতীয় পরমাণু শক্তি কমিশনে যোগ দেন। দেশ ও পরিবারের এই চরম দুর্যোগের মুহূর্তে তাঁর আত্মসম্মান বোধ ছিল অত্যন্ত সজাগ। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তার দুই কন্য ও পরিবারকে তিনি বটগাছের মত আগলে রেখেছিলেন। দুঃসময়ে তিনি ছিলেন কান্ডারী। তাঁর সান্নিধ্যে থাকার সময় স্মৃতিপটে অনেক কথাই ভেসে আসছে। অনেক কথা মনে পড়ছে। তাঁর অনেক কথা-পরামর্শ, উপদেশ আমার চলার পথে উত্তরণ ঘটিয়েছে।

 বাংলাদেশে ফিরে আসার পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাঁর লেখা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ নামের বইটি  নিজে স্বাক্ষর করে তিনি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। গুরুতর অসুস্থ থাকার সময় তাঁকে সময় করে দেখতে যেতে পারিনি। তাই, আমার আফসোস রয়ে গেছে। ২০০৯ সালে ৯মে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সপ্তম মৃত্যু বার্ষিকীতে এই মহানুভব মানুষটির আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। ড. ওয়াজেদের মতো প্রথিতযশা পরমাণু বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞজনের অভাব পূরণ হবার নয়। অসাধারণ জ্ঞানী-গুণি, প্রতিভাবান মানুষটিকে সহজে ভুলবার নয়। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মকান্ড নিয়ে। আজকের এই দিনে তাঁকে আবারও গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।

(লেখকঃ মুক্তিযোদ্ধা, খুলনা প্রেসক্লাব ও খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি)।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ ,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *