মোবাই টওয়ার থেকে বিকিরিত উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় তরঙ্গ জীব ও উদ্ভিদ জগতের বিপর্য ডেকে আনছে চলছে গোপণীয়তা রক্ষা

কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণহীন বে-পরওয়া মোবাইল ফোন কোম্পানীগুলির টাওয়ার থেকে নির্গত বিপুল পরিমান তেজস্ক্রিয় ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ বা বৈদ্যুতিকচুম্বকীয় তরঙ্গ মানুষ তথা জীব ও উদ্ভিদ জগতের স্বাভাবিক জীবনকে ঠেলে দিচ্ছে ক্যান্সার সহ বিভিন্ন জানা অজানা ভয়ঙ্কর রোগ-বালাইয়ের কবলে। এই বিপদজনক কর্মকান্ড যাতে সামনে না আসে সে জন্য প্রতিনিয়ত খরচ করা হচ্ছে বিজ্ঞাপন ও উৎকোচের জন্য শত শত কোটি টাকা। অন্যদিকে জীব ও উদ্ভিদ জগতকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েও নির্দিষ্ট করা হচ্ছে না তেজস্কৃয় বিকিরণের পরিমাণ!

ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ কি ঃ মোবাইল ফোনের টাওয়ার থেকে যে সিগনাল নির্গত হয়ে মোবাইল ফোন ব্যাবস্থা চালু রাখে তা হ’ল ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ বা বেদ্যুতিকচুম্বকীয় তরঙ্গ হ’ল বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘের এক ধরনের তেজস্ক্রিয় তরঙ্গ যা অবস্থান করে সাধারণ আলো, রেডিও তরঙ্গ, মাইক্রোওয়েভ, অবলহিত রশ্মি, আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি, এক্স-রে ও গামারশ্মির মাঝে। এই বৈদ্যুতিকচুম্বকীয় তরঙ্গ তেজস্ক্রিয় বিধায় মানুষ তথা জীব ও উদ্ভিদ দেহে এই তরঙ্গ ক্যান্সার সহ মারাত্মক সব জান অজানা রোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম। আর এই তরঙ্গের ক্ষতি করার ক্ষমতা কত তা নির্ভর করে প্রতি মিটারে এই তরঙ্গের পরিমাণের উপর। এই তরঙ্গের গতি খোলা প্রান্তরে প্রতি সেকেন্ডে আলোর গতির সমান অর্থাৎ ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল।

গোপনীয়তা কার সার্থে ঃ আমাদের দেশে মোবাইল ফোনের টাওয়ার থেকে যে বৈদ্যুতিকচুম্বকীয় তরঙ্গ নির্গত হয় তার পরিমাণ কত তা জানার কোন উপায় নেই! অথচ বৈদ্যুতিকচুম্বকীয় তরঙ্গ নির্গমনের পরিমাণের উপরই নির্ভর করে এর ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা। বিকিরণের পরিমাণ যত বেশী মানবদেহ সহ জীব জগতের উপর তার ক্ষতিকর প্রভাবও তত বেশী। কিন্তু কেন তা গোপন করা হচ্ছে? তা হলে কি বর্তমানে এই তরঙ্গ নির্গমনের মাত্রা বিপদজনক পরিমাণের চাইতেও বেশী? সাধারণ মানুষের প্রশ্ন কার সার্থে এই বিপদজনক বিষয়টি গোপন রাখা হচ্ছে?

জনবসতির মধ্যে স্থাপিত টাওয়ারগুলি যে বিকিরণ ছড়াচ্ছে তার প্রভাব পড়ছে মস্তিষ্ক ও হৃদযন্ত্রে। বিকিরণের ফলে ঘুমের ব্যাঘাত, অবসাদ, ঝিমুনিভাব বেড়ে যাওয়া, মনঃসংযোগে সমস্যা, স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া, মাথাব্যাথা, হজমের ক্ষমতা কমে যাওয়া, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়ার মত নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। মোবাইল ফোন ব্যবহার না করেও এই তেজস্ক্রিয় বিকিরনের শিকার হচ্ছে শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী মহিলারা। কুপ্রভাব এড়াতে পারছে না পশুপাখী ও উদ্ভিদ জগতও। এ সকল কথা প্রকাশ করা হয়েছে মোবাইল ফোনের টাওযার থেকে বিকিরিত বৈদ্যুতিকচুম্বকীয় তরঙ্গ’র প্রভাব ক্ষতিয়ে দেখতে গঠিত ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আন্তঃমন্ত্রক কমিটির রিপোর্টে।

২০১২ সালে এই রিপোর্ট প্রকাশের পরপরই নড়েচড়ে বসে ভারত সরকার। সে সময় ভারতের মোবাইল ফোন কোম্পানীর টাওয়ারগুলি থেকে নির্গত বৈদ্যুতিকচুম্বকীয় তরঙ্গ’র পরিমাণ ছিলো প্রতি মিটারে ৪ ইলেক্ট্রন ভোল্ট বা তার থেকে কিছু বেশী। উল্লিখিত আন্তঃমন্ত্রক কমিটির রিপোর্ট প্রদানের পর ভারতীয় টেলিকম এনফোর্সমেন্ট রিসোর্স এন্ড মনিটরিং সেল মোবাইল কোম্পানীগুলিকে নির্দেশ প্রদান করে যে, টাওয়ারগুলি থেকে নির্গত বৈদ্যুতিকচুম্বকীয় তরঙ্গ’র বিকিরণের পরিমাণ বর্তমানের ৪ ইলেক্ট্রন ভোল্ট থেকে ১০ গুন কমিয়ে ০.৪ ভোল্ট করতে হবে। কোন টাওয়ার থেকে বিকিরণের পরিমান এর থেকে বেশী হলে তা বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং সংশ্লিষ্ট কোম্পানীকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে, যে নির্দেশ সাথে সাথে কার্যকর করা হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) কি বলছে ঃ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১১ সালে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, মোবাইল ফোনের টাওয়ার থেকে বিকিরিত বৈদ্যুতিকচুম্বকীয় তরঙ্গ’র কারণে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। ১০ বছর ধরে ১৩টি দেশের উপর করা তাদের সমীক্ষা বলছে, দিনে এক-দু’ ঘন্টা মোবাইল ফেনে কথা বললেই গ্লিয়োমা (মস্তিষ্কে টিউমার) হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। সেই সঙ্গে ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা সহ যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা মোবাইল ফোনের টাওয়ারগুলির বিকিরণও বিপদ ডেকে আনছে নিঃশব্দে প্রাণী ও উদ্ভিদজগতের। বিশেষজ্ঞদের নির্দেশনা, অবশ্যই ঘনবসতি এলাকায় মোবাইল ফোনের টাওয়ার বসানো বন্ধ করা উচিৎ, বিকিরণের পরিমাণ নির্ধারণ বাধ্যতামূলক করা এবং টাওয়ারগুলির উচ্চতা হওয়া উচিৎ টেলিফোনের সুউচ্চ টাওয়ারগুলির মত।

বাংলাদেশের মোবাইল ফোন কোম্পানীগুলির টাওয়ারগুলি থেকে নির্গত বৈদ্যুতিকচুম্বকীয় তরঙ্গ’র পরিমাণ প্রতি মিটারে কত? এটি একটি গোপন ও নিষিদ্ধ বিষয়! এ বিষয়ে মুখ খোলা নিষেধ। খুলনা মহানগরীতে তাদের মোট কতগুলি টাওয়ার আছে এবং সেগুলি থেকে বিকিরিত বৈদ্যুতিকচুম্বকীয় তরঙ্গ’র পরিমাণ প্রতি মিটারে কত এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলালিঙ্ক মোবাইল ফোন কোম্পানীর খুলনা এরিয়া বিজনেস ম্যানেজার এ বিষয়ে কথা বলতে অস্বিকার করেন। তিনি বলেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর এবং এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।

একই বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনা গ্রামীন ফোনের টেকনোলজি ডিভিশনের ম্যানেজার বলেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর এবং সিক্রেট। এ বিষয়ে তার কিছু বলার এক্তিয়ার নেই। এ বিষয়ে তিনি এ প্রতিবেদকের সাথে পরে যোগাযোগের কথা বললেও তিনি আর যোগাযোগ করেন নি।

জীবজগৎ ও উদ্ভিদ হুমকির মুখে ঃ গবেষকরা জানিয়েছেন, মোবাইফোনের টাওয়ারের মাত্রাতিরিক্ত বিকিরণের জেরে বদলে যাচ্ছে জীবজন্তুর আচরণ, দ্রুত কমে যাচ্ছে ময়না, টিয়া, শালিক, টুনটুনি, বুলবুলিদের মত পাখিদের সংখ্যা, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিভিন্ন উদ্ভিদের উৎপাদন ক্ষমতা যেমন নারকেল গাছে মড়ক লাগা।

বাংলাদেশের যে সকল এলাকা মোবাইল টাওয়ারের আওতাভুক্ত সে সকল এলাকাগুলিতে বিগত বেশ কয়েক বছর থেকে শুরু হয়েছে নারকেরের মড়ক। নারকেল একটু বড় হয়েই শুকিয়ে ঝরে যাচ্ছে, আর যে সামান্য কিছু হচ্ছে তারও আকার ছোট এবং সবুজ থাকতেই গায়ে পুড়ে যাওয়া ছোপ ছোপ দাগ যা তেজস্কৃয়তার কথা স্বরণ করিয়ে দেয়। বিশেষ কোন এক গোষ্ঠি থেকে বলা হয়েছে যে এর জন্য এক ধরনের সাদা অতিক্ষুদ্র মাকড়োসারা দায়ি, কিন্তু বিষয়টি সত্য নয় কারণ, উপকূল আঞ্চলে বিশেষ করে সুন্দরবনের কটকা-কচিখালি এলাকায় যেখানে মোবাইর টাওয়ার নেই (ইদানিং কটকায়ও একটি টাওয়ার বসানো হয়েছে) সেখানকার প্রতিটি নারকেল গাছ সবুজ সুন্দর নারকেলে ভর্তি, কোন একটি গাছেও মড়ক লাগেনি।

পরিবেশের উপর মোবাইফোনের টাওয়ারগুলি থেকে বিকিরিত বৈদ্যুতিকচুম্বকীয় তরঙ্গ’র প্রতিক্রিয়া কি জানতে চাইলে খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন আলোকিত সংবাদকে বলেন, মোবাইফোনের টাওয়ারগুলি থেকে বিকিরিত বৈদ্যুতিকচুম্বকীয় তরঙ্গ মানবদেহ তথা জীব ও উদ্ভিদের জন্য মারাত্মক হুমকি। তিনি বলেন, অবশ্যই এর নিঃসরণের মাত্রা নির্দিষ্ট হতে হবে। তিনি আরও বলেন, পরিবেশ দপ্তর এক সময় বিষয়টি নির্দিষ্ট করার উদ্যোগ নিলে কোম্পানীগুলি উচ্চ আদালতের মাধ্যমে উদ্যোগের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ পায়, পরে বিষয়টি নির্ধারণের ক্ষমতাও পরিবেশ দপ্তরের হাত থেকে চলে যায়। তিনি মনে করেন সচেতন জনগণ সোচ্চার হলে ব্যবস্থা গ্রহণের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *