ময়ূরনদী হত্যাকারিদের বিচার হোক, নদী নিয়ে ভাওতাবাজি’র প্রকল্প বন্ধ হোক

ময়ূর বাঁচাও পরিবেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও

একদা  ¯্রােতস্বিনী স্বচ্ছ পানির আধার খুলনা মহানগর সংলগ্ন ময়ূরনদী এখন গণ অত্যাচারে মূমুর্ষূ, মৃত প্রায় ড্রেনের নোংরা পানির আধারে পরিণত হয়েছে। খোদ কেসিসি’র পিলখানার বর্জ্য ও ড্রেনগুলির মিলনক্ষেত্র ময়ূরনদী আজ নগরীর মহাড্রেনে রূপ নিয়েছে। আর এই মহাড্রেনের সংস্কারের নামে আবার চলছে কোটি কোটি টাকার জগাখিচুড়ি প্রকল্প। প্রকল্পের শেষে যে ড্রেন সেই ড্রেনই থাকছে, মাঝখান থেকে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে! এই মৃত ময়ূরনদীই (ড্রেন বলা ভালো) হয়ে উঠেছে আবার ভাওতা দিয়ে টাকা কামানোর কামধেণু!

 কেন ময়ূর নদীর এ অবস্থা ঃ মূলত খুলনা সিটি কর্পোরেশনই ময়ূর নদীকে নষ্ট করার জন্য দায়ি। নদী দুষনের প্রধান কারণ খুলনা সিটি কর্পোরেশনের ২২টি ড্রেনের মুখ এ নদীর সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে, যে প্রক্রিয়া শুরু হয় গত শতাব্দির শেষ দশক থেকে এবং যা এখনও বর্তমান। ফলে খুলনা মহানগরীর হাজার হাজার টন জৈব-অজৈব সব ধরনের বর্জ্য কেসিসি’র ড্রেন দিয়ে বছরের পর বছর এ নদীতে জমে এর তলদেশ ভরাট করে ফেলেছে এবং নদীর পানি ড্রেনের পানিতে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া নদী পাড়ের অনেক বাসিন্দা বাড়ির পয় নিষ্কাশনের ড্রেনের মুখও নদীর সাথে সংযুক্ত করেছে এবং একই সাথে ভূমি সন্ত্রাসীরা নদী জবরদখল করে নিয়েছে। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, দুষনের দ্বারা নদী ধ্বংস করে নদির জমি দখল করে নেওয়াও প্রভাবশালীদের (সমাজের দাগি মানুষদের) একটা কৌশল।

 ময়ূর নদী বাঁচাও আন্দোলনঃ ময়ূর নদী ও খুলনা মহানগর সংলগ্ন ২২টি খালকে অবৈধ দখল ও দূষণ থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে ২০০৭ সাল থেকে সাধারণ নাগরীক সমাজের ব্যানারে গড়ে ওঠে ময়ূর বাঁচাও আন্দোলন যাতে নেতৃত্বদেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ সামাজিক ব্যক্তিত্ব প্রিন্সিপাল ওয়াহিদুর রহমান। এ আন্দোলনে সমবেত হয় সকল রাজনৈতিক দল ও শ্রেণী-পেশার মানুষ। এ আন্দোলন পূর্ণতা পায় সে সময়ের নবনির্বাচিত সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক আন্দোলনে সামিল হলে।

 ময়ূর নদী নিয়ে নগরবাসির স্বপ্ন ঃ ময়ূর নদী ও খুলনা মহানগর সংলগ্ন ২২টি খালকে অবৈধ দখল ও দূষণ থেকে মুক্ত করার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক। নগরবাসি ও নাগরীক নেতৃবৃন্দের সাথে ময়ূর নদী ও খালগুলিকে নিয়ে তিনি একটি ভবিষ্যৎ রূপকল্প গড়ে তোলেন। ময়ূর নদী ও খালগুলিকে সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ শেষে একটি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় যার ভিডিও চিত্র নগরবাসিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নগর ভবনে প্রদর্শন করা হয়। সেখানে বলা হয় যে সর্বাগ্রে নদী-খালগুলির অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে সীমানা নির্ধারন করা হবে। এর পর নদী-খালগুলি খনন করে দূষণ মুক্ত করা হবে। নদী-খালগুলির পাড় বাধাই করে ওয়াক ওয়ে নির্মাণ করা হবে। পাড় দিয়ে গাচ লাগানো হবে, নগরবাসির বিশ্রামের জন্য পাতানো হবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সুদৃশ্য বেঞ্চ, আর নদী-খালগুলিতে চলবে বিভিন্ন ধরনের প্যাডেলবোট অর্থাৎ পুরো নদী-খালগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে একটি চমৎকার বিনোদন ও পর্যটন কেন্দ্র। আর এরকম একটি রূপকল্প বাস্তবায়িত হলে খুলনা মহানগরী হবে প্রাচ্যের ভেনিস!

 নগরবাসির স্বপ্ন ভঙ্গ ঃ উল্লিখিত রূপকল্প বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেন মেয়র খালেক। প্রাথমিক ভাবে তিনি ময়ূর নদীর অনেকাংশ সহ বেসকিছু খালের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে সীমানা পিলার স্থাপনের কাজ সমাপ্ত করেন। এ সময় তার মেয়র পদের মেয়াদ শেষ হয়। একই সাথে ফিকে হতে থাকে নগরবাসির বিনোদন ও পর্যটন কেন্দ্রের স্বপ্ন, তাদের দূষণ মুক্ত ময়ূর নদীর স্বপ্ন।

 ময়ূরনদী খনন ও পাড় বাধাইঃ পরবর্তিতে ময়ূর নদীর একটা অংশ খনন করতে নগর এরাকা উন্নয়ন প্রকল্পের (সিআরডিপি) আওতায় ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, যার উত্তোলিত মাটি দিয়ে সেই অংশের পাড় বাধানোর কথা। কাজ শুরু হয় এবং একই সাথে ড্রেনগুলি দিয়ে প্রতিদিন শত শত টন বর্জ্য ময়ূর নদীতে ফেলাও চলতে থাকে! আর কাজের সিডিউলে প্রত্যক্ষ ভাবে আর্থ কাটিং বা মাটি খননের কথা উল্লেখ থাকলেও এক কোদাল মাটিও কাটা হয় নি। নদী খননের নামে নদীতে জমে  থাকা পলিথিনের বর্জ্যই শুধু উত্তোলন করা হয়। কর্তৃপক্ষের দাবি তারা বিপুল পরিমাণ পলিও অপসারণ করেছে। তবে সে পলি কোথায় রেখেছে তার হদিস মেলেনি। এ ভাবেই ৬ কোটি টাকার নদী খনন প্রকল্প শেষ হয়েছে। ফলে নদী যা ছিলো তা-ই আছে।

একই সাথে নদীতে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে আবার কোটি কোটি টাকা দিয়ে তা অপসারণ করা হচ্ছে, এ কেমন বুজরুকী প্রকল্প, জানতে চাইলে প্রকল্পের একজন নির্বাহী প্রোকৌশলি বলেন, কর্তৃপক্ষ যে ভাবে বলেছে সে ভাবেই কাজ হয়েছে। এক ইঞ্চিও মাটি না কেটে, পাড় বাধাই না কেরে ৬ কোটি টাকার কাজ কি ভাবে সম্পন্ন হ’ল জানতে চাইলে প্রকল্পের একজন উর্ধ্বতন ‘নির্বাহী’ বলেন, কাজের সিডিউলে আর্থ কাটিং উল্লেখ থাকলেও আসলে স্লাজ  (পেড়ি) ইত্তোলনই মিন করা হয়েছে।

 ময়ূর নদীর বর্তমান অবস্থা ঃ সরেজমিনে অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, আলুতলা স্লুইস গেইট’র (যেখানে ময়ূর নদী রূপসা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে) নিকট থেকেই শুরু হয়েছে নদী জবরদখল। তবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনের চক্ মথুরাবাদ মৌজা থেকে রায়ের মহল হামিদ নগর স্লুইস গেইট পর্যন্ত দুই পাশের নদী ব্যাপক ভাবে জবরদখল করে নিয়েছে নদীসন্ত্রাসী ভূমীদস্যুরা। ফলে নদী এখানে সংকির্ণ খালে পরিণত হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এ সকল খাল দেখভালের দায়িত্বে থাকা কেসিসি’র সম্পত্তি শাখার আধিকারিক নুরুজ্জামান তালুকদার বলেন, বিগত মেয়রের আমলে যে খালগুলি দখলমুক্ত করা হয়েছিলো সেগুলির অধিকাংশই আবার বেদখল হয়ে গেছে। কেন, উল্লিখিত এ সময়ে কেসিসি’র সম্পত্তি শাখা (সম্পত্তি দেখভালকারী শাখা) বন্ধ ছিলো কি-না তা জানতে চাইলে নুরুজ্জামান কোন উত্তর দেননি।

 নদী মরে যাওয়ায় সবচেয়ে বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়েছে নদীর দুই পাড়ের বাসিন্দারা, কারণ তাদের দৈনন্দিন জীবন ও চাষাবাদের প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা মেটাত এই নদী। নদীর দুই তীরের পুটিমারী গ্রামের আক্কাস, তেতুলতলা গ্রামের কোরবান আলী, চক্ মথুরাবাদের ধীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস সহ গল্লামারীর নদী পাড়ের বাসিন্দা ও নগরবাসির অভিযোগ, কেসিসি’র ড্রেন এবং নদী দখলকারীদের অত্যাচারে নদী আজ অর্ধমৃত, প্রায় ড্রেনে পরিণত। ফলে পানির অভাবে নদীর পাড়ের বাসিন্দাদের জীবন-জীবীকা আজ হুমকির সম্মুখিন। ময়ূর অববাহিকার গণমানুষের দাবি, ময়ূরনদী হত্যাকারিদের বিচারের আওতায় আনতে হবে, এবং ময়ূরনদী বাঁচাতে নদী নিয়ে সকল প্রকার ভাওতাবাজি’র প্রকল্প বন্ধ করতে হবে।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather
ট্যাগসমূহঃ ,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *