মেডিকেল কলেজগুলোতে তীব্র শিক্ষক সঙ্কট: তৈরি হচ্ছে হাতুড়ে চিকিৎসক

তীব্র শিক্ষক সঙ্কটে দেশের সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো। ফলে তৈরি হচ্ছে হাতুড়ে ডাক্তার। তাতে জনজীবনে হুমকি বাড়ছে। বর্তমানে দেশের শতাধিক সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ২৫ হাজার ৩শ’ অধিক শিক্ষক দরকার সেখানে রয়েছে মাত্র ৯ হাজার ৪০৩টি। অর্থাৎ  প্রয়োজনীয় ৬৩ শতাংশ শিক্ষকই নেই। বর্তমানে দেশে কার্যক্রম চালাচ্ছে  ১০৫টি মেডিকেল কলেজ। তার মধ্যে সরকারি ৩৬টি আর বেসরকারি ৬৯টি। ওসব কলেজে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫২ হাজারের কিছু বেশি। এমন পরিস্থিতিতে মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তারপরও দেশে বেড়েই চলেছে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা।

বিগত ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪৭টি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিটি জেলায় একটি করে সরকারি মেডিকেল কলেজ খোলারও পরিকল্পনা আছে সরকারের। যদিও আশির দশক পর্যন্ত দেশে মাত্র ৬টি সরকারি ও ৩টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ছিল। কিন্তু ১৯৯২ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ৪৯টি মেডিকেল কলেজ অনুমোদন দেয়া হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের অধিকাংশ মেডিকেল কলেজেই ভৌত অবকাঠামো ও শিক্ষা উপকরণে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিশেষ করে অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। ওসব প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার নীতিমালা মানা হচ্ছে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব অনুসন্ধান ও পর্যালোচনাতেও নতুন সরকারি কলেজগুলোর দুর্বলতা ও বেসরকারি কলেজগুলোর অনিয়ম ধরা পড়েছে। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয় সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর পরিস্থিতি মূল্যায়ন করেছে। বিশেষজ্ঞরা দেশে নতুন কোনো মেডিকেল কলেজ না করার সুপারিশ জানিয়েছে। যদিও ২০০৯ সালে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) মানসম্পন্ন মেডিকেল শিক্ষার জন্য কোন বিষয়ে কতোজন শিক্ষক (অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, প্রভাষক এবং কিছু ক্ষেত্রে নির্দেশনাকারী) থাকতে হবে তার নির্দেশিকা তৈরি করে। তাতে ৫০, ১০০ ও ২০০ জন শিক্ষার্থীর জন্য অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, ফার্মাকোলজি, প্যাথলজি, ফরেনসিক মেডিসিন, কমিউনিটি মেডিসিন, মেডিসিন, সার্জারি, মাইক্রোবায়োলজি ও গাইনিতে কতোজন শিক্ষক থাকবেন তার উল্লেখ আছে নির্দেশিকায়। কোনো কলেজে প্রতিবছর যদি ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন তাহলে সেখানে অন্তত ১৯৮ জন শিক্ষক দরকার। ১০০ জন হলে শিক্ষক থাকতে হবে ২৯৩ জন আর ২০০ জন ভর্তি হলে শিক্ষক থাকতে হবে প্রায় ৪০০। কিন্তু শিক্ষক স্বল্পতায় তা মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে না।

সূত্র জানায়, বিএমডিসির মানদন্ড অনুযায়ী ৩০টি সরকারি মেডিকেল কলেজে কমপক্ষে ৮ হাজার ৩০০ শিক্ষক প্রয়োজন। কিন্তু ওসব কলেজে এখন কাজ করছেন ৩ হাজার ৪৬ জন শিক্ষক। তাতে প্রয়োজনের ৬৩ শতাংশ শিক্ষকই কম। তবে আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ ও ৫টি আর্মি মেডিকেল কলেজ এই হিসাবের বাইরে। সরকার নতুন সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে শিক্ষক দিতে পারছে। যেমন ২০১৪ সালে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হয়েছে কিন্তু অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, ফার্মাকোলজি, কমিউনিটি মেডিসিন ও ফরেনসিক মেডিসিনের শিক্ষকের স্বল্পতা আছে। তাছাড়া যশোর, সাতক্ষীরা, টাঙ্গাইল, জামালপুর, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ (কিশোরগঞ্জ) ও শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজে (গাজীপুর) প্যাথলজি, ফরেনসিক মেডিসিন, কমিউনিটি মেডিসিন ও মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ে কোনো অধ্যাপকই নেই। তাছাড়া ওই ৬টি কলেজের কোনোটিতেই বায়োকেমিস্ট্রি নেই। ওই বিষয়ে ৬টি কলেজে মাত্র একজন অধ্যাপক। সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপকও খুব কম। অ্যানাটমির অধ্যাপক নেই ৩টি কলেজে, সহযোগী অধ্যাপক নেই ৪টি কলেজে, সহকারী অধ্যাপক নেই ৩টি কলেজে। পরিস্থিতি আরো খারাপ ফিজিওলজির ক্ষেত্রে। ওই বিষয়ে উল্লিখিত কলেজগুলোর মধ্যে মাত্র ২টি কলেজে অধ্যাপক আছেন, সহযোগী আছেন ৩টি কলেজে, সহকারী অধ্যাপক আছেন একটি কলেজে। ৬টি কলেজের কোনোটিতে বায়োফিজিকসের শিক্ষক নেই। ওসব কলেজের শিক্ষার্থীরা মূলত প্রভাষকদের ওপর নির্ভরশীল। মূলত নতুন ১০টি মেডিকেল কলেজে শিক্ষকের পদ সৃষ্টি না করেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। যদিও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মরত চিকিৎসকদের প্রেষণে ওসব কলেজে সংযুক্তি দেয়া হয়েছে।

সূত্র আরো জানায়, সরকারি কলেজগুলোর মত বেসরকারি কলেজগুলোতে তীব্র শিক্ষক সঙ্কট ভুগছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর দেশে কর্মরত ৬৯টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে ৬২টি কলেজের শিক্ষকের হিসাব পেয়েছে। ৭টি কলেজের কাছে তথ্য চেয়েও অধিদফতর পায়নি। অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী ৬২ কলেজে শিক্ষক আছেন ৬ হাজার ৩৫৭ জন। আর বিএমডিসির মানদন্ড অনুযায়ী ওসব কলেজে অন্তত ১৭ হাজার ৫০০ শিক্ষক প্রয়োজন। অর্থাৎ বেসরকারি খাতও ৬৩ শতাংশ শিক্ষকের কমতি নিয়ে চলছে। ওসব কলেজের একটিতেও ফিজিক্যাল মেডিসিন ও ক্যাজুয়ালটি বিভাগে শিক্ষক নেই। কোনো কোনো কলেজে ফিজিয়াট্রি, ফরেনসিক মেডিসিন, কমিউনিটি মেডিসিন, ডারমাটোলজি, ব্লাড ব্যাংক, পেডিয়াট্রিক সার্জারি এমনকি মেডিসিন বিভাগে একজন শিক্ষকও নেই। অথচ প্রতি ১০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক দরকার। অথচ দেশের ১০০টি মেডিকেল কলেজই ৫০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে। ওই হিসাবে প্রতিবছর ৫ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে। যার জন্য ৫শ’ শিক্ষক প্রয়োজন হলেও দেশে ১৫০ জনও অ্যানাটমির শিক্ষক নেই।

এদিকে মেডিকেল কলেজগুলোতে  শিক্ষক স্বল্পতার কথা স্বীকার করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন) অধ্যাপক এএ রশিদ জানান, মেডিকেল কলেজগুলো চলছে প্রকল্পের আওতায়। ওসব কলেজে শিক্ষক স্বল্পতা দূর করার জন্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে। এ নিয়ে সম্প্রতি সভাও হয়েছে।

অন্যদিকে একই প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জানান, সরকার দেশে মেডিকেল শিক্ষার প্রসার ঘটাতে চায়। নতুন মেডিকেল কলেজের অনুমোদনের ব্যাপারে কড়াকড়ি করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে শর্ত না মানা ৪টি কলেজে ভর্তি বন্ধ রাখা হয়েছে। তা থেকে অন্যরা শিক্ষা না নিলে আরো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এমনকি মেডিকেল কলেজ বন্ধও করে দেয়া হবে।

facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmailby feather

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Current ye@r *