প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেছেন, শাসন বিভাগের সঙ্গে তিনি আর কোনো ‘দ্বন্দ্ব’ চান না। তিনি বিচার বিভাগকে ধারণ করতে নির্বাহী বিভাগের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। দুই বছর আগে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নেয়ার পর কয়েকটি ঘটনায় নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে মতানৈক্যের প্রেক্ষাপটে গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে একথা বলেন তিনি।
চট্টগ্রামে নবনির্মিত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিচারপতি সিনহা বিভিন্ন দেশে বিচার বিভাগের সঙ্গে শাসন বিভাগের দ্বন্দ্ব এবং এনিয়ে তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের রেশ ধরে প্রধান বিচারপতি বলেন, মাননীয় আইনমন্ত্রী আপনি আইনের শাসনের কথা বলেছেন, আপনাকে ধন্যবাদ। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে বার, বেঞ্চ এবং প্রশাসনে দ্বন্দ্ব থাকা উচিত নয়। এটা আমি সব সময় বলে আসছি। এটা সত্য, শুধু আমার বাংলাদেশে না, পৃথিবীর সব দেশেই, সর্বশ্রেষ্ঠ দেশ আমেরিকা যে সারাবিশ্বকে হাত নাড়িয়ে চালায়, তাদের দেশেও প্রশাসন ও বিচার বিভাগের টানাটানি আছে। বারাক ওবামা, উনি রিকমেন্ডেশন করার পরও সুপ্রিম কোর্টে একজন বিচারক নিতে পারলেন না। ইংল্যান্ডেও হচ্ছে । প্রতিবেশী দেশ ভারতের উদাহরণ দিয়ে বিচারপতি সিনহা বলেন, ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি ঠাকুর, উনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সামনে চোখের জল ফেললেন। হাই কোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে বিচারকের স্বল্পতা এবং সমন্বয়ের অভাবে বিচারক নিয়োগ দিতে পারছেন না।
নিজের ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, আমি যখন ভারতে গিয়েছিলাম, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি সুযোগ দিয়েছিলেন ওঁর সাথে চা চক্রের। যাওয়ার সাথে সাথে উনি বললেন বিচারক নিয়োগ নিয়ে। এই দ্বন্দ্ব আছে, এটা থাকবে -মন্তব্য করে প্রধান বিচারপতি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশ সরকার বেশ সাহায্য করছে। কিন্তু এই- সাহায্য সহযোগিতা শুধু এটা হলে হবে না। এক্সিকিউটিভ, বিচার বিভাগকে ওন করতে হবে। মুখে বললে হবে না। যদি ওন না করে মুখে বলে, বিচার বিভাগ কোনোদিনই এটা করতে পারবে না। আমি কী বলতে চাচ্ছি এক্সিকিউটিভ ভালো করে জানে। আমি আর কোনো দ্বন্দ্ব চাই না। আমি চাই যে, এক্সিকিউটিভ বিচার বিভাগকে ওন করে কাজ করবে। তা হলে আমাদের অনেকগুলা দূরত্ব দূরীভূত হবে, বলেন বিচারপতি সিনহা।
প্রায় ৫০ মিনিটের বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি বিচারক স্বল্পতা, জুডিশিয়াল ট্রেইনিং ইন্সটিটিউটে অবকাঠামোগত অপ্রতুলতা, ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমি না থাকা, বিচারকদের আবাসনের জন্য জুডিশিয়াল কমপ্লেক্স নির্মাণ, নতুন আইন বিষয়ে বিচারকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, চট্টগ্রামের হাই কোর্ট বেঞ্চসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন। বাংলাদেশে ৮০ ভাগ বিচারক উচ্চ আদালতে আইনজীবীদের থেকে নেয়ার বিষয়টি তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি বলেন, তাদের আইন পেশার অভিজ্ঞতা থাকে। কিন্তু রায় লেখাসহ বিচারের বিভিন্ন বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকা দরকার। সরকারের কাছে আবেদন করব এটা সুবিবেচনার সাথে দেখবেন।
ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমি একটা নেহাত দরকার। ভারতের প্রধান বিচারপতির সাথে আলাপ করে সাময়িকভাবে উচ্চ আদালতের বিচারকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু এটা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য দুঃখজনক। একটা স্বাধীন দেশের বিচারকদের অন্য দেশের বিচারকরা ট্রেইনিং করাবে। পুলিশ প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য ট্রেইনিংয়ের ব্যবস্থা আছে। আমি মনে করি বিচারকদের আরও বেশি ট্রেইনিং এর দরকার। এটা সরকার যদি উপলব্ধি না করে, তা হলে এই দেশে কোনোদিনই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না। সরকারের কাছে আকুল আবেদন করছি ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমি হোক। চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ মো. হেলাল চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন- আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। বক্তব্য রাখেন আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম, চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. রুহুল আমীন এবং চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভাপতি কফিল উদ্দিন চৌধুরী।
by
সর্বশেষ মন্তব্যসমূহ